Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
Illegal Parking

পার্কিং থেকে সিন্ডিকেট, তুঙ্গে ‘গ্যাং ওয়ার’

নিজের অফিসেই টেবিলের উল্টো দিক থেকে আসা নিস্পৃহ স্বরের কথাগুলো শুনে হিমেল স্রোত বয়ে গিয়েছিল রমন সিংহের শরীরে। প্রতিষ্ঠিত পরিবহণ ব্যবসায়ী তিনি, দক্ষিণ হাওড়ার তৃণমূলের সহ-সভাপতিও।

শালিমার স্টেশনের এই সেই পার্কিং লট।

শালিমার স্টেশনের এই সেই পার্কিং লট। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার।

দেবাশিস দাশ
হাওড়া শেষ আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ০৭:১২
Share: Save:

‘যদি আমাকে পার্কিংয়ের বরাত না ছাড়ো, বোমা, গুলি চলবে। গুন্ডাগর্দি হবে। আমি ক্রিমিনাল পুষি। কারণ, ওরা মার খেতে জানে,মারতেও জানে।’

নিজের অফিসেই টেবিলের উল্টো দিক থেকে আসা নিস্পৃহ স্বরের কথাগুলো শুনে হিমেল স্রোত বয়ে গিয়েছিল রমন সিংহের শরীরে। প্রতিষ্ঠিত পরিবহণ ব্যবসায়ী তিনি, দক্ষিণ হাওড়ার তৃণমূলের সহ-সভাপতিও। তবু তাঁরই দলের ‘ছত্রছায়ায়’ থাকা এক দুষ্কৃতীর এই হুমকির পর সাহসে আর কুলোয়নি। বরাতের নির্ধারিত সময়সীমা শেষ হওয়ার আগেই, আর্থিক ক্ষতি মেনে নিয়ে শালিমারের পার্কিং ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন রমন।

রমনের কথায়, ‘‘আমি তো গুন্ডা-মস্তান নই। বোমা, রিভলভার ধরতে পারব না। দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে তৃণমূল করছি। তবে ক্ষোভ হয়, দলের পুরনো কর্মী হলেও মন্ত্রী-নেতাদের সাহায্য পাই না। শালিমার আমার জন্মস্থান ও কর্মস্থান, তবু আমিই অসহায়। সব থেকে বড় কথা, এত দিন দল করার পর দেখছি, এই এলাকায় দলের কর্মসমিতির মাথায় বসানো হচ্ছে তোলাবাজ ও দাগী আসামিদের। গোটা এলাকা চলে গিয়েছে কিছু দুষ্কৃতীর হাতে।’’ যদিও হাওড়া তৃণমূলের জেলা সভাপতি কল্যাণ ঘোষ বলেন, ‘‘আমাদের দলে দুষ্কৃতীদের জায়গা দেওয়া হয় না। যদি দক্ষিণ হাওড়ায় এমন কেউ পদাধিকার পেয়ে থাকে, খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেব। ’’

এ দিকে, হাওড়া সিটি পুলিশের এক পদস্থ কর্তার বক্তব্য, সাম্প্রতিক কালে শালিমার স্টেশনের পার্কিং এলাকায় গোলমালের অন্যতম কারণ— অবৈধ রোজগারের লক্ষ্যে দক্ষিণ-পূর্ব রেলের পার্কিং লটে দুষ্কৃতীদের প্রবেশ। এই গোলমালের দায় এড়াতে পারেন না রেল কর্তৃপক্ষও। অভিযোগ, সরকারি ভাবে পার্কিং ফি তোলার বরাত দেওয়ার পরও রেলের পক্ষ থেকে না করা হয়েছে কোনও কাউন্টার, না রয়েছে গাড়ি ঢোকা বা বেরোনোর টিকিটের জন্য কম্পিউটারাইজ়ড প্রিন্টিং মেশিন এবং টিকিট। অথবা সিসি ক্যামেরা। যে কারণে নিজেদের ছাপানো পার্কিং-এর কুপন নিয়ে তোলাবাজিতে ব্যস্তস্থানীয় দুষ্কৃতীরা। যাত্রী নামাতে বা তুলতে এলেও নেওয়া হচ্ছে ফি। কেন?

দক্ষিণ-পূর্ব রেলের এক পদস্থ আধিকারিক বলেন, ‘‘স্টেশন বলতে শালিমারে আগে গুডস শেড ছিল। সেখান থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রান্তিক স্টেশন তৈরি হচ্ছে। বতর্মানে যে সব সমস্যা হচ্ছে তা স্থানীয়। পার্কিং ফি আদায় নিয়ে সমস্যা মিটে যাবে। সবটাই কম্পিউটারাইজ়ড করে দেওয়া হচ্ছে। স্টেশনের আইনশৃঙ্খলানিয়ন্ত্রণে হাওড়া সিটি পুলিশের সঙ্গে রেলের কথা চলছে।’’

তবে ওই পার্কিং লটের প্রাক্তন এক ঠিকাদারের দাবি, ‘‘এদের দোষ নেই। গুন্ডাদের মাথার উপর যে সব নেতারা আছেন, তাঁরা বলে দিয়েছেন, রেলকে দেওয়া বরাতের লক্ষ লক্ষ টাকা যে ভাবে হোক তুলতে হবে। সে জন্য প্রয়োজনে গুন্ডাগর্দি চলবে। রেল পুলিশ, আরপিএফ, বটানিক্যাল গার্ডেন থানায় মাসোহারার ব্যবস্থা আছে। তাই নো কেস, নো অ্যারেস্ট।’’

যদিও এ বিষয়ে রেল পুলিশ ও আর পিএফের বক্তব্য, তাদের কাজের এলাকা মূলত স্টেশনের ভিতরে, বাইরেটা দেখে হাওড়া সিটি পুলিশ। স্টেশনের বাইরে অপরাধমূলক কাজকর্ম হলে তা পুলিশ দেখে। আর হাওড়া সিটি পুলিশের এক পদস্থ কর্তার দাবি, এই সব অভিযোগের বাস্তবতাই নেই। তিনি বলেন, ‘‘স্টেশন চত্বরের অধিকাংশটা দেখে আরপিএফ ও রেল পুলিশ। আইনঘটিত সমস্যা হলে আমরা সাহায্য করি। কয়েক দিন আগেই যাত্রীকে মারধর করায় ৭ জন গ্রেফতার করা হয়েছিল। এরআগেও দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’’

এখন শালিমার স্টেশনের যেখানে গাড়ি রাখার ব্যবস্থা, সেটি পেরিয়ে সামনে এগোলেই দেখা যাবে, রাস্তার বাঁ দিকে নতুন পার্কিং লট। তা পেরিয়ে রাস্তা বাঁ দিকে ঘুরলেই দেখা যাবে, ডান দিকে নদীর পাড়ে জাহাজ তৈরি ও মেরামতের কারখানা। খাসজমি দখল করে নাক বরাবর লম্বা রাস্তার দু’পাশে প্রায় দু’ কিলোমিটার লম্বা শ্রমিক বস্তি। গঙ্গাকে সামনে রেখে এই শ্রমিক বস্তির পিছনের ফাঁকা জমিতে শুরু হয়েছে বিভিন্ন নির্মাণ সংস্থার বহুতল নির্মাণের প্রতিযোগিতা। কেউ তুলছেন ১৫ তলা, কেউ তুলছেন ২৫ তলা। সবই বিলাসবহুল ফ্ল্যাট।

স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্য, এই জায়গা থেকেই বদলে গেছে শালিমারের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি। বিভিন্ন বস্তির বেকার যুবকদের স্টেশন এলাকায় অপরাধের পথে ঠেলে দিয়ে, সিন্ডিকেট দখলের মাথারা বটানিক্যাল গার্ডেন চত্বর ছেড়ে শালিমারের ফাঁকা জমিতে নজর দিয়েছে। তাদের প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে বহুতলের নির্মাণসামগ্রী সরবরাহের জন্য বোমা, গুলি চালিয়ে সন্ত্রাসের পরিবেশ তৈরি করছে সিন্ডিকেট চক্র। সহজে অনেক টাকা রোজগারের জন্য অপরাধেরআঁতুড়ঘর হয়ে উঠেছে শালিমার।

ভুক্তভোগীদের মতে, এই পরিবেশ মূলত তৈরি হচ্ছিল বাম আমলে, ২০০৯ থেকে। রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদলের প্রাক্কালে গুলি, বোমায় রক্তাক্ত হয়ে উঠেছিল দক্ষিণ হাওড়া বিধানসভা কেন্দ্রের বটানিক্যাল গার্ডেন এলাকা। ২০১১ সালে রাজ্যে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর ওখান থেকেই মূলত শুরু হয়েছিল ‘গ্যাং ওয়ার’। এলাকা দখলের ‘বেতাজ বাদশা’ হওয়ার জন্য বারবার রক্তাক্ত হয়েছে সেখানকার মাটি এবং রাজনীতি।

(চলবে)

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy