জিএসটি নিয়ে হঠাৎ মন বদলে নর্থ ব্লককে চিন্তায় ফেলে দিল নবান্ন।
বিধানসভার সংক্ষিপ্ত অধিবেশন ডেকে জিএসটি-র সংবিধান সংশোধনী বিলে সিলমোহর বসানোর কথা ছিল। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার শেষ মুহূর্তে সেই পরিকল্পনা বাতিল করেছে। জিএসটি নিয়ে এ দিন আলোচনা হওয়ার কথা থাকলেও বিধানসভার কার্যসূচি থেকে তা বাদ পড়েছে। আর এতেই উদ্বিগ্ন নরেন্দ্র মোদী সরকার। জিএসটি-র পথ মসৃণ করতে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি চাইছেন মমতার সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে ফেলতে। অর্থ মন্ত্রকের একটি সূত্রের কথায়, ‘‘রাজ্যের ট্রেজারিতে কেন্দ্র নজরদারি চালাতে চাইছে বলে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর মনে ভুল ধারণা তৈরি হয়েছে। সেটা কাটাতে কেন্দ্রীয় অর্থসচিব অশোক লাভাসা কলকাতায় রাজ্যের আমলাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন।’’
বহু কাঠখড় পুড়িয়ে সংসদে জিএসটি চালুর জন্য সংবিধান সংশোধনী বিল পাশ করিয়েছে মোদী সরকার। এ বার তাতে অন্তত ১৬টি রাজ্যের সিলমোহর প্রয়োজন। তা হলে সংবিধান সংশোধনের কাজ শেষ হবে। তার পরে শীতকালীন অধিবেশনে মূল জিএসটি বিলটি পাশ করাতে চায় কেন্দ্র। বিজেপি তথা এনডিএ শাসিত রাজ্যগুলিকে দ্রুত এই কাজ সেরে ফেলার নির্দেশ দিয়েছেন অমিত শাহ। কিন্তু তাতে সংখ্যাটি ১৬ ছোঁবে না। অন্যান্য রাজ্যেরও সহযোগিতা প্রয়োজন। কিন্তু মমতার সরকার হঠাৎ ব্রেক কষায় উদ্বেগে জেটলি।
মমতা নিজে অবশ্য জিএসটি প্রসঙ্গে এ দিন বিধানসভায় বলেন, ‘‘আমি জিএসটি সমর্থন করি। কিন্তু একদিনের এই বিধানসভায় সময়াভাবে আর আলোচনা হল না।’’ যদিও তৃণমূলের সূত্র বলছে, কেন্দ্র-বিরোধী জেহাদ বজায় রাখতেই জিএসটি নিয়ে ধীরে চলছেন মমতা। বিধানসভায় এ নিয়ে বিল পাসের আগে অ-বিজেপি রাজ্যগুলির সঙ্গে মমতার সরকার যোগাযোগ করতে চায়। এমনকী, কেন্দ্রের আর্থিক নীতির বিরুদ্ধে সুর চড়ানোর জন্য ওই রাজ্যগুলিকে নিয়ে কনক্লেভও করতে পারে তৃণমূল। সব মিলিয়েই ভাঁজ বাড়ছে বিজেপির কপালে।
কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের কর্তারা বলছেন, বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলির বাইরে দিল্লি, বিহার ও হিমাচলের বিধানসভায় ইতিমধ্যেই সংবিধান সংশোধনে সিলমোহর পড়েছে। তা ছাড়া পশ্চিমবঙ্গকে বাদ দিয়েও ১৬টি রাজ্যের লক্ষ্যমাত্রা ছোঁয়া সম্ভব। কিন্তু গোড়া থেকেই বিজেপির বড় ভরসা মমতা। মমতার সরকার প্রথম থেকেই জিএসটি প্রশ্নে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে। মমতার অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র রাজ্যের অর্থমন্ত্রীদের এমপাওয়ার্ড কমিটির চেয়ারম্যান। মূল জিএসটি বিলে ঐকমত্য গড়ে তুলতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবেন। কাজেই তৃণমূল বেঁকে বসলে জিএসটি চালুর কাজে বাধা পড়তে পারে।
আর সে কারণেই মমতার ধীরে চলার কৌশলে সিঁদুরে মেঘ দেখছে নর্থ ব্লক। মোদী সরকারের শীর্ষকর্তারা মনে করছেন, মমতা সম্প্রতি কেন্দ্রকে আক্রমণের মনোভাব নিয়েছেন। একাধিক কেন্দ্রীয় প্রকল্পে বরাদ্দ কমানো থেকে শুরু করে ট্রেজারিতে নজরদারি— একাধিক অভিযোগ রয়েছে তাঁর। জিএসটি বিলেও তারই ছায়া পড়েছে। সেই মেঘ কাটাতেই অর্থসচিবকে কলকাতায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রকের কর্তারা বলছেন, মমতা অভিযোগ মতো কেন্দ্রীয় প্রকল্পে বরাদ্দ কমানো নিয়ে তর্ক হতেই পারে। কেন্দ্রের পাল্টা যুক্তি হল যে, চতুর্দশ অর্থ কমিশনের সুপারিশ মেনে এমনিতেই রাজ্যকে বেশি টাকা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ট্রেজারিতে নজরদারির যে অভিযোগ মমতা করছেন, তা একেবারেই ঠিক নয়। মমতা বলেছিলেন, কেন্দ্র এখন ‘পাবলিক ফিনান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’-এর মাধ্যমে রাজ্যের ট্রেজারিতে নজরদারি চালাতে চাইছে। এ জন্য রাজ্যকে না জানিয়ে রাজ্যেরই অর্থ দফতরে কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মীদের পাঠানো হচ্ছে।
এ নিয়ে মোদী সরকারের যুক্তি, কেন্দ্রীয় প্রকল্পে প্রতি পাইপয়সা খরচের নজরদারির জন্য ‘পাবলিক ফিনান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ তৈরি হয়েছে ঠিকই। এর মাধ্যমে শুধু কেন্দ্র নয়, রাজ্যের যে কোনও দফতরও দেখতে পারবে, কত টাকা কবে কেন্দ্র থেকে এল। কবে সেই টাকা খরচ হল, শেষ পর্যন্ত কী ভাবে তা কাজে লাগল। কাগজে-কলমে নিচু তলায় স্থানীয় সংস্থাকে টাকা পাঠানোর পরও সেই টাকা সঙ্গে সঙ্গে হাত বদল হয় না। ফলে সুদ গুণতে হয়। এ ক্ষেত্রে সেই সুদের বোঝাও থাকবে না। রাজ্যের ট্রেজারিতে কেন্দ্রের অফিসারদের পাঠানোর পিছনে যুক্তি হল, আগামী বছরের ৩১ মার্চের মধ্যে দেশের ৩৬টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলকে এর সঙ্গে জুড়ে ফেলার সময়সীমা ঠিক হয়েছে। সেই কারণে রাজ্যের ট্রেজারি অফিসারদের প্রশিক্ষণ দিতেই কেন্দ্রের অফিসারদের পাঠানো হয়েছে। অসম, ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, উত্তরপ্রদেশ, কেরলের মতো গোটা দশেক রাজ্য ইতিমধ্যেই এই কাজ সেরে ফেলেছে।
অর্থ মন্ত্রকের চিন্তা হল, পশ্চিমবঙ্গের দেখাদেখি অন্য রাজ্যও আপত্তি তুললে ৩১ মার্চের মধ্যে কাজ শেষ করা যাবে না। একই ভাবে জিএসটি নিয়ে মমতার নেতিবাচক মনোভাব বজায় থাকলে ১ এপ্রিল থেকে জিএসটি চালু করতেও সমস্যা হতে পারে।
যদিও মমতা কেন্দ্রের উদ্বেগকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। বরং বঞ্চনা নিয়ে সুর আরও চড়া করারই ইঙ্গিত দিয়েছেন। এ দিন বিধানসভায় রাজ্যের প্রতি কেন্দ্রের বঞ্চনা নিয়ে একটি প্রস্তাবও আনে সরকারপক্ষ। বিরোধীরা সেই প্রস্তাবকে সমর্থন করলেও এই প্রসঙ্গে তৃণমূলের তীব্র সমালোচনা করেন। তাঁদের বক্তব্য, কেন্দ্রীয় বঞ্চনা নিয়ে রাজ্য দিল্লিতে দরবার করলে তাঁরা সঙ্গ দিতে রাজি। একই সঙ্গে সিপিএমের অশোক ভট্টাচার্যের মন্তব্য, ‘‘এখানে বিরোধী বিধায়কদের কোনও বৈঠকে ডাকা হয় না। বিরোধী পুরসভাকে কোনও টাকা দেন না। আপনারা আবার বঞ্চনার কথা বলছেন!’’ কংগ্রেস নেতা সুখবিলাস বর্মার অভিযোগ, এ রাজ্যের শাসক দল কেন্দ্রীয় বরাদ্দের টাকা উন্নয়ন খাতে খরচ না করে তা বিরোধী নেতা-কর্মীদের ভাঙাতে খরচ করছেন!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy