জি২০ সম্মেলন উপলক্ষে রাজধানীতে সাজ-সাজ রব। দিল্লিকে মুড়ে দেওয়া হয়েছে কড়া নিরাপত্তায়। লোগোর সামনেও অতন্দ্র প্রহরী। ছবি: পিটিআই।
চোখ ধাঁধানো ভারতমণ্ডপের পর্দা ওঠার অপেক্ষা। কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গিয়েছে দিল্লির জি২০ মঞ্চে। কূটনৈতিক শিবিরের মতে, লোকসভা নির্বাচনের আগে এই রাজসূয় যজ্ঞে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর পাখির চোখ দু’টি। প্রথমত, বিশ্বের কাছে এই বার্তা দেওয়া যে, ভূকৌশলগত নীতি আমেরিকা বা চিনের কুক্ষিগত নেই আর। গোটা বিশ্বে যে ভাবে একঘরে হয়ে যাচ্ছে চিন, তার পূর্ণাঙ্গ সুযোগ নিতে মরিয়া নয়াদিল্লি। দ্বিতীয়ত, গোটা বিষয়টিকে ‘জনআন্দোলনের’ চেহারা দিয়ে দেশবাসীকে সংযুক্ত করা, ঘরোয়া রাজনীতিতে যার সুফল মিলতে পারে। বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর আজ নিজে লিখেছেন, ‘‘দেশের বিভিন্ন রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের সাধারণ মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে জি২০ প্রকৃত অর্থেই জনসাধারণের আন্দোলন হিসেবে গড়ে উঠেছে।"
কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, মোদী জি২০-র দিকে তাকিয়ে রয়েছেন সুযোগসন্ধানীর মতোই। এক দিকে আমেরিকা-চিন সংঘাতের সুযোগ নেওয়া, অন্য দিকে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের সুযোগে নিজেদের স্বার্থ গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করাই তাঁর লক্ষ্য। ইউক্রেন যুদ্ধপর্বে কোনও পক্ষ না নিয়ে ভারসাম্যের কূটনীতিতে থিতু হয়ে রাশিয়া থেকে তেল, গম এবং অস্ত্র সস্তায় আমদানি করে গিয়েছে ভারত। বিদেশ মন্ত্রকের দাবি, জি২০-র মঞ্চে দেখা না গেলেও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদীর সেই বোঝাপড়া অটুট রয়েছে। তিনি ফোনে পুতিনের কথা বলেছেন সম্প্রতি। ক্রেমলিন জানিয়ে দিয়েছে, রাশিয়ার বিদেশমন্ত্রীই জি২০-তে বক্তৃতা দেবেন। ভিডিয়ো মাধ্যমেও পুতিন সংযুক্ত হবেন না ভারতমণ্ডপের পর্দায়। বিদেশ মন্ত্রকের একাংশের দাবি, নয়াদিল্লির জন্য এটা শাপে বর শুধু নয়, এই পরিকল্পনা ভারতকে না জানিয়েও করা হয়নি। পুতিন এবং আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এক টেবিলে থাকলে, আর যা-ই হোক, জি২০ একটি বহুপাক্ষিক মঞ্চ হিসাবে একটুও এগোতে পারত না। মাঝখান থেকে বদনাম হত ভারতেরই। পুতিন না আসায় সে দিক থেকে বাঁচোয়া।
আন্তর্জাতিক স্তরে নিজেদের প্রভাবকে বাড়িয়ে নেওয়ার পাশাপাশি মোদী সরকার খুব সচেতন ভাবে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও জি২০-কে কাজে লাগিয়েছে সমান ভাবে। মোদীর ভাবমূর্তিকে আরও উজ্জ্বল করে তোলা, দেশের সর্বত্র সরকারের সিলমোহর-সহ এই সম্মেলনকে ছড়িয়ে দেওয়া, বিভিন্ন শ্রেণি ও সম্প্রদায়কে সঙ্গে নেওয়ার মতো শাখা-প্রকল্প যুক্ত করে বিষয়টিকে দেশে গণ উৎসবে পরিণত করতে চেয়েছেন মোদী।
আজ এক নিবন্ধে বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর তাই লিখেছেন, ‘‘জি২০-র সভাপতিত্বকালে জন-ভাগীদারি অর্থাৎ, উন্নয়ন প্রচেষ্টার সঙ্গে জনসাধারণকে যুক্ত করার মতো বিষয়টিও ভারত বারংবার গুরুত্বের সঙ্গে বলে আসছে। জি২০-ভুক্ত দেশগুলির বিভিন্ন কর্মপ্রচেষ্টার সঙ্গে সাধারণ মানুষের সংযোগ স্থাপন যে একান্ত জরুরি, এ কথা ভারতই প্রথম বিশেষ জোরের সঙ্গে তুলে ধরেছে বিশ্বমঞ্চে। তাই এই সরকারি কর্মপ্রচেষ্টা এখন শুধুমাত্র সরকারের এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। দেশের বিভিন্ন রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের সাধারণ মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে জি২০ প্রকৃত অর্থেই জনসাধারণের আন্দোলন রূপে গড়ে উঠেছে।’’ জয়শঙ্কর যোগ করেছেন, ‘‘সহযোগিতামূলক যুক্তরাষ্ট্রীয় আদর্শকে ভারতের জি২০ সভাপতিত্বকালে বিশেষ ভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। জি২০ প্রতিনিধিবৃন্দকে স্বাগত জানানোর ক্ষেত্রে বিভিন্ন রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতার আবহ গড়ে উঠেছে বললেও অত্যুক্তি হয় না। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, এই উৎসাহ ও উদ্দীপনা এক অনুকূল পরিবেশ গড়ে তুলেছে দেশে। মণিপুরের লোকটাক হ্রদের পুনরুদ্ধার ও পুনরুন্নয়ন প্রচেষ্টা, মুম্বই শহরতলির স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো বা লখনউতে পরিকাঠামোর প্রসার এরই কয়েকটি দৃষ্টান্ত।’’
তবে জি২০ নিয়ে দেশে যে রাজনৈতিক বাদানুবাদ দেখা যাচ্ছে, এর আগে কোনও আন্তর্জাতিক সম্মেলনকে ঘিরে তেমন হয়নি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা। মোদী সরকারের আড়ম্বর এবং প্রচার এই সম্মেলনকে ঘিরে যত বেড়েছে, প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের পক্ষ থেকেও তির্যক মন্তব্য ততই ধেয়ে এসেছে। আজও কংগ্রেসের সাংসদ মণীশ তিওয়রি বলেছেন, ‘‘দুর্ভাগ্যজনক ভাবে এ বারে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং প্রেসিডেন্ট পুতিন দু’জনেই এলেন না। সরকারি ভাবে তাঁরা সরে দাঁড়ালেন। এখনও স্পষ্ট নয়, কত জন শীর্ষ রাষ্ট্রনেতা আসছেন।’’ কংগ্রেসের আর এক নেতা পবন খেরার মতে, ‘‘বিপুল পরিমাণ খরচ করা হল জি২০-র পিছনে। তাও দেখা যাচ্ছে, দু’টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রের শীর্ষ নেতা এলেন না। বিদেশ মন্ত্রকের অবশ্যই জানানো উচিত ভারতের সভাপতিত্বের কারণে দেশবাসী ঠিক কী ভাবে উপকৃত হচ্ছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy