Advertisement
২৫ ডিসেম্বর ২০২৪
varanasi

Varanasi: জাদুঘরের জাদুই যদি হারিয়ে যায়...

শিল্প মানে কাজ, কাজ মানে জীবিকা। তাই বলে কাশীতে ফ্যাক্টরি? পান আর বেনারসির বাইরে এক নতুন জগৎ শিকড় চারিয়ে দেবে মাটিতে?

ফাইল চিত্র।

বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়
বারাণসী শেষ আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০২১ ১০:১২
Share: Save:

“কাশী একদম নতুন হয়ে যাচ্ছে”, শুনলেই মনে হয় হিমালয় একদম নতুন হয়ে উঠছে। পুরনো সোনার মতো যা চিরনতুন, তা আবার নতুন হবে কী করে? প্রাচীনতম বলেই জগৎসংসারে যার পরিচিতি, ঝাঁ-চকচকে হয়ে ওঠা মানে তো তার অস্তিত্বেরই ইতি!

কিন্তু তোপসে, দুনিয়া এখন আর সিধুজ্যাঠার লাইব্রেরি নয়, যুগ পাল্টে সত্য থেকে কলি হয়ে গেল আর বারাণসীর সরু সরু গলি একই রকম থাকবে তা-ও কি হয়! তা ছাড়া, বিশ্বনাথ মন্দির চত্বরের আয়তন বেড়ে যদি ৩০০ বর্গমিটার থেকে ৩০০০ বর্গমিটার হয়, লাভ তো দর্শনার্থীদের। মন্দিরের ভিতরে নাকি পাঁচ হাজার মানুষ একসঙ্গে দাঁড়াতে পারবেন এখন থেকে। আর মন্দির চত্বরে জায়গা হবে পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি মানুষের! এক দিক দিয়ে দেখতে গেলে জরাজীর্ণ কাঠামোর এই সংস্কার দরকারই ছিল। কিন্তু কেমন যেন আনচান করে মন। সংস্কারের ভিতরেই যে ঘাপটি মেরে থাকে সংশোধন। দেবাদিদেব মহাদেব আসলে তো ভিখারি। রাজকীয় পুনর্নির্মাণের জগঝম্পে সেই অমোঘ সত্য অন্তরালে চলে গেলে?

“গেলে যাবে। ও সব নিয়ে ভাবছে কে?” তিন ঘণ্টার রাস্তা নবনির্মিত প্রশস্ত রিং-রোডের কল্যাণে দেড় ঘণ্টায় পাড়ি দেবার খুশিতে গাড়ির চালক আনন্দকুমার বলে উঠলেন। ওঁর মতে, বারাণসীর ইনফ্রাস্ট্রাকচার বিগত কয়েক বছরে আমূল বদলে গিয়েছে। অতএব খুব শিগগিরই নতুন নতুন কারখানা হবে এখানে।

শিল্প মানে কাজ, কাজ মানে জীবিকা। তাই বলে কাশীতে ফ্যাক্টরি? পান আর বেনারসির বাইরে এক নতুন জগৎ শিকড় চারিয়ে দেবে মাটিতে? মাটির কথায় মনে পড়ল কুড়ি বছর আগেকার কাশীতে এসে একটি ছড়া শুনেছিলাম, “উত্তরে কাশী বিশ্বনাথ/ দক্ষিণে বাঙালিটোলা/ পুব-পশ্চিম যেদিকেই যাও মুখে বলবে ‘বাবা ভোলা”! যিনি বলতেন, তিনি মাটির ব্যবসা করতেন। মানে পশ্চিমবাংলার মাটি লরি করে কাশীতে নিয়ে এসে টবের পর টবে বসিয়ে বিক্রি করতেন। তাঁর মুখেই শোনা, নদী যত সাগরের দিকে যায়, তত সরেস হয় তার পলি, গাঁদা আর চন্দ্রমল্লিকা অত ভাল কোথাও ফোটে না আর! বাবা বিশ্বনাথের পায়ে কিংবা গলায় যত মালা পড়ে, তাদের বেশির ভাগই বাংলায় না ফুটলেও আদতে যে বাংলারই, এই তথ্য জেনে চমৎকৃত হয়েছিলাম। কাশীর নতুন প্রজন্ম দশাশ্বমেধ ঘাটে দাঁড়িয়ে গঙ্গারতি দেখতে নয়, নটা-পাঁচটার অফিস করতে চায় জেনেও একটু অবাক হলাম কি?

ভিখারিকে শীর্ষপদ দেওয়ার কারণ ভিখারি কখনও স্বৈরাচারী হয় না। স্বামীর জটায় ঠাঁই নেওয়া গঙ্গাকে দেখে ত্রস্ত সতীকে আশ্বস্ত করতে শিব তাই হয়ে উঠেছিলেন অর্ধনারীশ্বর। বিষের কলসে অমৃতকে খুঁজে নেবার ধক তো তারই থাকে যে বিষ আর অমৃত, মহাকাল আর বাঘছালকে একই আঙ্গিকে ধরতে পারে।

সেই কবে প্রমথনাথ বিশীর ‘লালকেল্লা’য় পড়েছিলাম, “কাশীতে নদীর জলের মধ্য থেকে উঠে গিয়েছে সিঁড়ি… মনে হয়েছে—সমস্ত শহরটা অনেক উঁচু থেকে ঝাঁপ দিয়ে এসে পড়েছে নদীর জলে।” নতুন যে কাশী নতুনতর হওয়ার দিকে অগ্রসর, তাতে উন্নয়নের নেশা আছে, সমর্পণের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া কঠিন।

তবু, ফুরোয় যা তা শুধু চোখেই ফুরোয়। অসি ঘাটের কাছেই রবিদাস ঘাট এখনও বাঁধানো নয়। মাটিতে পা রেখে নামতে গিয়ে দু’-চারবার মাটিতে হাত রেখে বসে পড়তে হবেই। এই ঘাটের লাগোয়া হোটেলে ওয়াই-ফাই মোটে কাজ করে না। অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধারও খানিকটা অভাবই। তবে গঙ্গায় ধরা মাছ জেলেরা বিক্রি করতে নিয়ে আসে, ‘বোর্ডার’দের তা গরম গরম ভেজেও দেয় হোটেলের রাঁধুনি। চৌষট্টিঘাটে নাগনাগিনীর মিথুনমূর্তির মতোই জল আর মাছের সহাবস্থান। দেশভাগের পর মালোদের বড় অংশকে জায়গা দেওয়া হয়েছিল ওড়িশার মালকানগিরিতে, যেখানে বছরে একশো ফোঁটা বৃষ্টি পড়ে কি না সন্দেহ। তাঁদের একটা দল নাকি পালিয়ে গিয়েছিল কাশীতে। তাঁদেরই কেউ ধরে আনলেন নাকি এই টাটকা মাছ?

সাফল্য সমতল চায় কিন্তু সমতলে থেকে সমতলে তাকিয়ে গৌরী আর গৌরীশের মিলন অনুভব করা যায় না। নতুন কাশীর চৌকাঠে পা রেখেও তাই অহরহ মনে পড়তে থাকে ইয়েহুদা আমিখাই-এর ‘একদম নতুন জাদুঘরের ভিতর রয়েছে একটা পুরনো সিনাগগ/ সিনাগগ’এর ভিতরে আমি/ আমার ভিতরে আমার হৃদয়/ আমার হৃদয়ের মধ্যে একটি জাদুঘর… ’ জাদুঘরকে ‘ঘর’ বানাতে গিয়ে জাদুকে চাপা দেওয়া হচ্ছে না তো?

অন্য বিষয়গুলি:

varanasi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy