লুট: গোকুল পুরীতে নইমুদ্দিন। গিয়েছে রুটি-রুজির সরঞ্জাম। নিজস্ব চিত্র
টিনের তোবড়ানো বাক্সে রাখা ছিল গাড়ি সারাইয়ের গোটাকয়েক সরঞ্জাম। সারা দিনের কাজ সেরে ২৪ ফেব্রুয়ারিও তাতে তালা ঝুলিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা দিয়েছিলেন নইমুদ্দিন। কিন্তু ওই রাতে গোকুল পুরীর গাড়ি যন্ত্রাংশের বাজার পুড়ে ছাই হওয়ার পরে ফিরে দেখেছেন, লুট হয়ে গিয়েছে সেই টিনের বাক্সও! দশ মাস ধরে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা কষা ছেলের চিকিৎসার খরচ এ বার কোথা থেকে আসবে, বাক্সে অবশিষ্ট আধপোড়া তার, মরচে ধরা রেঞ্জ তার জবাব দিতে পারেনি।
হাজার হাতড়ে উত্তর পাচ্ছেন না মহম্মদ দানিশ, মহম্মদ শাহিদরা। ২৪ তারিখ থেকে পর পর তিন দিনের আগুনে পুড়ে খাক হয়েছে তাঁদের দোকান। দিল্লি সরকার ফের দোকান গড়ে দিতে এগিয়ে এসেছে ঠিকই। কিন্তু শাহিদ জানেন না, বিক্রির মালপত্র কেনার কড়ি জোগাড় হবে কোথা থেকে? কিডনি বদলাতে হয়েছে কুড়ি বছরের ভাইয়ের। তাঁর ওষুধের খরচ কোথা থেকে আসবে, সেই চিন্তায় ঘুম ছুটেছে দানিশেরও।
এই যে সংসদে দিল্লির সংঘর্ষ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, দুষ্কৃতীদের আটক ও গ্রেফতার করার কথা বলছে মোদী সরকার, এতে কি নতুন করে বুক বাঁধার কোনও জায়গা আছে তাঁদের? ফের এমনটা হবে না, আছে কি তার নিশ্চয়তা?
চার পাশে ভাঙা দেওয়াল, কালো ছাই, বেঁচে থাকা লোহার টুকরো আর টায়ারের পোড়া গন্ধের মধ্যে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলেন ওঁরা কয়েক জন। তাঁদের কাছে প্রশ্নটা পাড়তেই প্রায় মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে প্রশ্ন উড়িয়ে নইমুদ্দিন বললেন, ‘‘সরকারের কাছে গরিবের আবার প্রত্যাশা কী? তা থাকতেও নেই! ও-সব বড়লোকদের সাজে।’’ দানিশ ও শাহিদেরও এক জবাব, ‘‘প্রাণ বেঁচেছে। ফের দোকানঘর উঠবে। এই ঢের। আমআদমি এর বেশি আশা করে না।’’
গোকুল পুরীর পোড়া বাজারে মহম্মদ শাহিদ। বুধবার নয়াদিল্লিতে। ছবি: ইন্দ্রজিৎ অধিকারী (খবর: পৃঃ ৭)
এ দিন সন্ধ্যায় সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যারা দিল্লির সংঘর্ষে জড়িত, তাদের কাউকে রেয়াত করবে না পুলিশ। তাদের ধর্ম যা-ই হোক না কেন। জানিয়েছেন, যাঁদের বাড়ি-দোকান পুড়েছে— তাঁদের ক্ষতিপূরণের বন্দোবস্ত করতে দিল্লি হাইকোর্টের বিচারপতির নেতৃত্বে কমিশন গড়া হবে। দুষ্কৃতীদের চিহ্নিত করে বাজেয়াপ্ত করা হবে তাদের সম্পত্তি। ক্ষতিপূরণের টাকা আসবে সেখান থেকেও।
খাস রাজধানীতে এত বড় হিংসার পরে সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখ থেকে এটুকু প্রতিশ্রুতি প্রত্যাশিতই ছিল। কিন্তু গোকুল পুরীর পুড়ে ছাই কিংবা লুট হওয়া দোকানগুলির মালিক ও কর্মীদের মনের অবস্থা এমনই যে, সরকারের কথায় আস্থা রাখা তো দূর, ঠিক ভাবে তা শোনার অবস্থাও নেই তাঁদের অধিকাংশের। যন্ত্রাংশের বাজারটির ২২৪টি দোকানের মধ্যে পুড়ে খাক শ’খানেকের বেশি। লুট হয়েছে বাকিগুলি। যা ছিল তাঁদের রুটি-রুজির উৎস। তা খুইয়ে সরকারি আশ্বাসে আস্থা রাখা কতটা কঠিন, সেটা বুঝতে কষ্ট হয় না গোকুল পুরী মেট্রো স্টেশন থেকে কার্যত দু’পা দূরত্বে এই ধ্বংসপুরীতে দাঁড়িয়ে।
নাকে নল লাগিয়ে হাসপাতালে শুয়ে থাকা তরুণের ছবি দেখিয়ে নইমুদ্দিন বলছিলেন, ‘‘ফইম— আমার ছেলে। কাজ করত বেসরকারি বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থায়। কাজ করার সময়ে শক খেয়ে গত দশ মাস শয্যাশায়ী। প্রথমে হাসপাতালে, এখন বাড়িতে। নড়াচড়া, কথা বলার ক্ষমতা নেই। খাওয়াতে হয় নাকে নল দিয়ে। মাসে প্রায় ৮-১০ হাজার টাকা খরচ। কোনও মতে এত দিন চালিয়েছি। এ বার?’’
বাজারের ১৬৮ নম্বর দোকানটি শাহিদের। হাতে পোড়া লোহার তারের কুণ্ডলী। ম্লান হেসে বললেন, ‘‘চাকার স্পোক তৈরির জন্য রেখেছিলাম। সংসারের চাকাই বসে গেল। কী ভাবে যে ফের দোকান খাড়া করব, জানি না।’’ পাশের ১৬৯ নম্বর দোকানে সম্ভবত তারটুকুও বেঁচে নেই।
শাহিদ জানালেন, ওই দোকান তাঁর ভাই মহম্মদ সোহেলের! ১৪০ নম্বর দোকানের দানিশ মনে করালেন, ‘‘২০০১ সালে এই বাজার তৈরি করে দিয়েছিল অটলবিহারী বাজপেয়ীর সরকার। দোকান পেয়েছিলেন আব্বা। কিন্তু সংঘর্ষের মুখে মোদীরা সেই বাজার বাঁচাতে পারলেন কই?’’ দিল্লি সরকার ফের দোকানঘর তৈরি করে দিচ্ছে। ফের উঠে দাঁড়ানো যে অত সহজ হবে না, বোঝেন দানিশ। তাঁর প্রশ্ন, তত দিন কে জোগাবে মা-ভাইয়ের ওষুধ?’’ এমনই দুশ্চিন্তা ও হাহাকার গোকুল পুরীর পুড়ে খাক প্রতিটি দোকানে। সরকারের প্রতিশ্রুতি শোনার সময় কোথায়?
বাজারের পাশেই তেলের পাম্প। সেখানে বিজ্ঞাপন— উত্তরপ্রদেশের তুলনায় দিল্লিতে এখন পেট্রল সস্তা। উত্তরপ্রদেশ লাগোয়া বহু পাম্পেই এমন বিজ্ঞাপন থাকে। কিন্তু পোড়া বাজারের পাশে তা যেন অসম্ভব প্রতীকী! দোকানিরা বলছেন, ইন্ধনের তেল ছাড়া খাস রাজধানীর বুকে এত বড় আগুন সত্যিই জ্বলা অসম্ভব। আর সরকারের দাবি, ছাড়া হবে না এক জন দুষ্কৃতীকেও।
দেখা যাক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy