Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

পশ্চিমবঙ্গের মতো পরিবর্তনের মেঘ ছত্তীসগঢ়ের আকাশেও!

একটানা ১৫ বছর ক্ষমতায় রয়েছে বিজেপি সরকার। উন্নয়ন হয়েছে বটে, কিন্তু তাকেও পাল্লা দিয়ে ছাপিয়ে উঠছে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার সুর।

ছত্তীসগঢ়ের মুখ্যমন্ত্রী রমন সিংহ। —ফাইল চিত্র।

ছত্তীসগঢ়ের মুখ্যমন্ত্রী রমন সিংহ। —ফাইল চিত্র।

তাপস সিংহ
রায়পুর (ছত্তীসগঢ়) শেষ আপডেট: ০৫ নভেম্বর ২০১৮ ১৮:২১
Share: Save:

পশ্চিমবঙ্গের ছায়া ঘনাচ্ছে না তো ছত্তীসগঢ়ের আকাশে?

একটানা ১৫ বছর ক্ষমতায় রয়েছে বিজেপি সরকার। উন্নয়ন হয়েছে বটে, কিন্তু তাকেও পাল্লা দিয়ে ছাপিয়ে উঠছে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার সুর। রায়পুর শহরের চা-বিক্রেতা থেকে শুরু করে গাড়ির চালক, মধ্যবিত্ত চাকরিজীবী— অন্তরঙ্গ কথাবার্তায় বেরিয়ে আসে, অনেক দিন তো হল, এ বার পাল্টানো দরকার।

কিন্তু কেন? সবই যদি ঠিকঠাক চলে তো, পাল্টানোর কী প্রয়োজন পড়ল?

আরও পড়ুন: ‘চূড়ান্ত সময়সীমা’ দিল আরএসএস, রামের চাপে নাকাল মোদী

এর উত্তর এককথায় দেওয়া কঠিন। অনেকে বলছেন, মুখ্যমন্ত্রী রমন সিংহের ভাবমূর্তি ভাল, কিন্তু তাঁর চার পাশে যাঁরা আছেন, তৃণমূল স্তরে বিজেপির যে নেতা-কর্মীরা আছেন, তাঁদের অনেকের ভাবমূর্তি একেবারেই সংশয়েরউর্ধ্বে নয়, বরং তা দলকে খাদে ফেলে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। অভিযোগ উঠছে, কার্যত ‘কমিশন রাজ’ চলছে ছত্তীসগঢ়ে।

অনেকের অভিযোগ, মুখ্যমন্ত্রী রমন সিংহের আমলে কার্যত ‘কমিশন রাজ’ চলছে ছত্তীসগঢ়ে।

এ যেন ২০১১-র আগের পশ্চিমবঙ্গ! সেখানেও তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ভাবমূর্তি অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন ছিল। বস্তুত, সিপিএমের শীর্ষস্তরের কোনও নেতার ভাবমূর্তিই খুব খারাপ ছিল না। তা সত্ত্বেও তীব্র অভিযোগ উঠেছিল শাসক দলের মাঝারি ও নিচুতলার নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। বলা হচ্ছিল, শীর্ষ নেতৃত্বের ভাবমূর্তি দিয়েই সুশাসন আসে না। দলের মাঝারি ও নিচুতলার উপরে কার্যত কোনও নিয়ন্ত্রণই নেই সিপিএম তথা বাম নেতৃত্বের।

আর এই ছত্তীসগঢ়ে পা রাখা ইস্তক সেই ভাষ্যেরই প্রতিধ্বনি শুনছি বলে মনে হচ্ছে!

কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে, ক্ষোভ নানা স্তরে। ক্ষোভ শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে, ক্ষোভ দৈনিক বেতনভোগী কর্মীদের, সহায়ক মূল্য ও বিপণনের যথাযথ পরিকাঠামো না পেয়ে ক্ষুব্ধ কৃষকেরা, অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকরা বিপন্ন বোধ করছেন। অন্তত প্রচারের ঢক্কানিনাদ যে কথাই জোর গলায় জানাতে চাক না কেন, বাস্তব যেন অন্য কথা বলছে।

দেখুন ভিডিয়ো

কংগ্রেস জোর গলায় দাবি করছে, এ বার ক্ষমতায় আসার সুবর্ণ সুযোগ এসেছে তাদের কাছে। রায়পুরের শঙ্করনগরে কংগ্রেস দফতর ‘রাজীবভবন’-এ বসেদলের মুখপাত্র ও মিডিয়া ইন-চার্জ শৈলেশ নিতিন ত্রিবেদী আনন্দবাজার ডিজিটালকে বললেন, ‘‘কংগ্রেস এ বার এককাট্টা। কমিশনভোগী প্রশাসন, মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর পরিবারের দুর্নীতি, উন্নয়নের নামে রাজ্যের মানুষকে ধোঁকা দেওয়া— এই সব কিছু নিয়েই এ বারে নির্বাচনী লড়াইয়ে নেমেছে কংগ্রেস। রাজ্য জুড়ে দুর্নীতি সহ্যের সীমা ছাড়িয়েছে। রমন সিংহ এই দুর্নীতিকে মান্যতা দিচ্ছেন।’’

আরও পড়ুন: মন্দির চাই, তবে তারও আগে মোদীকে চাই, বলছে সন্ত সমিতি

যদি ধরেও নেওয়া যায়, কংগ্রেস ক্ষমতায় আসতে পারে, তা হলে দলের মুখ্যমন্ত্রী-মুখ কে? দলের অন্তর্দ্বন্দ্বের কথা যে ভাবে উঠে আসছে সে ভাবে তো মুখ্যমন্ত্রী-মুখ ভাসছে না? পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দেন শৈলেশ? ‘‘বলুন তো, ২০০৩ সালে বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী-মুখ কে ছিল?’’ উত্তরটাও নিজেই দেন তিনি, ‘‘কেউ ছিল না। আসলে, কংগ্রেস এতে বিশ্বাস করে না। ক্ষমতায় এলে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিধায়ক যাঁকে পছন্দ করবেন, তিনিই পরিষদীয় দলের নেতা হবেন। এ কথা সংবিধানেও আছে।’’

কংগ্রেসের দাবি, ছত্তীসগঢ়ে এ বার ক্ষমতায় আসার সুবর্ণ সুযোগ এসেছে তাদের কাছে।

কংগ্রেস নেতৃত্ব এ কথা বললেও দলের অভ্যন্তরে কান পাতলেই শোনা যাবে, প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি ভূপেশ বাগেলের সঙ্গে আর এক প্রভাবশালী নেতা টি এস সিংহদেওর ‘মধুর’ সম্পর্কের কথা। এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ নানা বিরোধ তো আছেই। ফলে, এত চটজলদি মুখ্যমন্ত্রী-মুখের কথা বলে সেই বিরোধ আরও বাড়াতে চাননি দিল্লির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব।

বিজেপির অবশ্য সেই সমস্যা নেই। এই ছত্তীসগঢ়ে বিজেপি বলতে মানুষ মুখ্যমন্ত্রী রমন সিংহকেই বোঝে। রমনের পাশাপাশি বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ভালই জানেন, মানুষের মনে নানা কারণে ক্ষোভ জমছে। দলীয় সূত্রের খবর, সে কারণেই মানুষের মনোভাব সরাসরি বুঝতে ছত্তীসগঢ়ে বেশ কয়েক বার নিজস্ব টিম পাঠিয়েছেন দলীয় সভাপতি অমিত শাহ। দলীয় স্তরে নানা ধরনের সমীক্ষাও করা হয়েছে। রমন নিজেও ‘লোক সুরাজ যাত্রা’ করেছেন। রাজ্যের প্রতিটি বিধানসভা কেন্দ্রে এই যাত্রার সময় গিয়েছেন তিনি। তবে, রমন সিংহ মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন জেলা সফরে যান। লোকজনের সঙ্গে কথাও বলেন।

মানুষের মনোভাব বুঝতে ছত্তীসগঢ়ে বেশ কয়েক বার নিজস্ব টিম পাঠিয়েছেন বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ।

রায়পুরের রাজবান্ধা ময়দানে বিজেপি দফতরে দলের মুখপাত্র সুভাষ রাওয়ের গলায় অবশ্য দৃঢ়তার সুর। ‘‘ও সব প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা খুব বড় ব্যাপার নয়। প্রতিষ্ঠান বিরোধিতায় আমাদেরও যেমন ক্ষতি হয়েছে, কংগ্রেসেরও হয়েছে। গত বার ওদেরও অনেক বড় নেতা হেরেছেন। এটা তো মানবেন, বিজেপি যে পর পর তিন বার এ রাজ্যে ক্ষমতায় এসেছে এটা একটা মিরাক্‌ল। এটা তো আসলে কংগ্রেসের রাজ্য।’’

আরও পড়ুন: আমাদের থেকে উন্নয়ন প্রকল্পের দান নিয়ে মূর্তি বানাচ্ছ? ফুঁসছে ব্রিটেন

এ বারের প্রার্থী তালিকাতেও টক্কর দিতে চেয়েছে প্রধান দু’টি দল। বিজেপি এ বার টিকিট দিয়েছে ১৪ জন মহিলাকে। পাল্টা কংগ্রেস দিয়েছে ১৩ জনকে। তবে, নতুন ও স্বচ্ছ মুখ আনার তাগিদে কংগ্রেস অন্তত ৩৫টি আসনে পুরনো প্রার্থীকে টিকিট দেয়নি। এমনকি, আগের বারের ৩৯ জন বিধায়কের মধ্যে ৯ জনকে টিকিট দেয়নি তারা। এর মধ্যে প্রত্যাশিত ভাবেই অজিত যোগীর স্ত্রী রেণু যোগীও আছেন। কোটা কেন্দ্রের বর্তমান বিধায়ক, চিকিৎসক রেণু যোগী প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে জানিয়েছেন, তিনি তাঁর স্বামী অজিত যোগীর নবগঠিত দল ‘জনতা ছত্তীসগঢ় কংগ্রেস’-এর হয়ে কোটা কেন্দ্র থেকেই লড়বেন। সনিয়া গাঁধীকে আবেগতপ্ত চিঠিও লিখেছেন রেণু।

অজিত যোগী নতুন দল গড়ায় কি বিজেপির সুবিধা হবে?—ফাইল চিত্র।

কিন্তু শুধু আবেগ আর ইচ্ছা দিয়েই কি ভোট হয়? ভোটের অঙ্ক যে অনেকটাই আলাদা। ঠিক যে কারণে রাজ্য কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বও একেবারে নিশ্চিত নন বিজেপির শেষ মুহূর্তের কৌশল নিয়ে। বেশ কয়েক বার বিজেপি ‘লাস্ট মিনিট সাজেশন’-এর উপর ভরসা করে নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়েছে।

কংগ্রেস নেতৃত্ব ‘পরিবর্তন’ চাইছেন ভাল কথা। কিন্তু তাঁদেরও মনে রাখতে হবে, ২০১১-র পশ্চিমবঙ্গে এক জন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন। ছত্তীসগঢ় কংগ্রেসে কোনও মমতা নেই! শুধুমাত্র বিজেপির দুর্নীতি আর প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার উপর ভরসা করে ঘট ওল্টানো যাবে কি না, তা বলার সময় এখনও আসেনি!

(ভোটের খবর, জোটের খবর, নোটের খবর, লুটের খবর- দেশে যা ঘটছে তার সেরা বাছাই পেতে নজর রাখুন আমাদের দেশ বিভাগে।)

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE