বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়া।—ফাইল চিত্র।
হাতে গোনা দু’দলের কয়েকটা হোর্ডিং। জয়পুর সোয়াই মান সিংহ বিমান বন্দর থেকে কেল্লার ভিতর পুরনো শহর বা তার বাইরে শহরের আনাচে কানাচে দিনভর ঘুরেও মালুম হবে না যে, আর সাত দিনের মাথায় ভোট।
কলকাতার মত পাড়ায় পাড়ায় মাইক বাজিয়ে পথসভা নেই। রাস্তার ধারে ধারে পোস্টার নেই। বাংলার মত দেওয়াল লিখন তো দূর অস্ত্।
নাহারগড় কেল্লায় যাওয়ার রাস্তায় ছোট্ট চায়ের দোকান মধ্যবয়সী মণীশের। সরাসরিই তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, এ বার কাকে ভোট দেবেন? প্রশ্ন শুনে মণীশের সাফ জবাব, “পাঁচ বছর ধরে এই সরকার কোনও কাজ করেনি। এদের ভোট দিয়ে লাভ নেই। তবে লোকসভাতে মোদীজিকেই ভোট দেব।”
নির্বাচনী প্রচারে নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়া।—ফাইল চিত্র।
আরও পড়ুন: দাপটের ইতিহাসটুকুই সম্বল, পিঙ্ক সিটির কয়েক লাখ বাঙালির প্রায় ভূমিকাই নেই ভোটে
পাশ থেকে হঠাৎ ভেসে এল, “একদম সহি বাত।” বক্তা ওই দোকানেই চা খাচ্ছিলেন। বছর চল্লিশের ক্ষেমচাঁদেরও সোজা কথা, “আমি কট্টর বিজেপি সমর্থক। তাও এ বার বিজেপিকে ভোট দেব না। কোনও কাজ করেনি এই সরকার। কেন্দ্রে মোদীজি এত ভাল ভাল কাজ করেছেন। আর এই সরকার বিজেপির নাম খারাপ করছে।”
মণীশ বা ক্ষেমচাঁদের কথা শুনে মনে পড়ে গেল জয়পুরের এক সাংবাদিক বন্ধুর কথা। কয়েক মাস আগেই তিনি বলেছিলেন, “রাজ্যের প্রান্তে প্রান্তে এ বার একটা স্লোগান খুব জনপ্রিয়— মোদীসে বৈর নেহি, রানি তেরি খৈর নেহি।” অর্থাৎ মোদীকে নিয়ে আমাদের সমস্যা নেই, তবে রানি (মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়া)-কে চাই না।
সর্দার পটেল মার্গে বিজেপির রাজ্য কার্যালয়ে বসে এই অসন্তোষের কথা অস্বীকার করতে পারলেন না সতীশ সিংহ বা প্রমোদ তিওয়ারির মত ছোট বা মাঝারি মাপের নেতারা। নির্বাচনের কয়েক মাস আগে থেকে সমস্ত সমীক্ষাতেই সেই প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার আঁচ মিলেছে। কোনও সমীক্ষাই রানিকে ২০০ আসনের রাজস্থান বিধানভায় ম্যাজিক অঙ্কের কাছাকাছি পৌঁছে দিতে পারেনি। অথচ এই বসুন্ধরাই ২০১৩ সালের নির্বাচনে রাজ্য থেকে কংগ্রেসকে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে, বিধানসভায় নিয়ে গিয়েছিলেন বিজেপির ১৬৩ জন বিধায়ককে। শুধু তাই নয়, পরের বছর লোকসভায় মোদীর ঝুলিতে তুলে দিয়েছিলেন ২৫ জন সাংসদকে। গোটা রাজস্থানে একটি লোকসভা আসনও জিততে পারেনি অন্য কোনও দল।
আর এখানেই প্রশ্ন— এ হেন দোর্দন্ডপ্রতাপ রানির এ হাল কেন? ক্ষেমচাঁদের মতই কট্টর বিজেপি কর্মী মুকেশ শিশোদিয়া। টঙ্ক রোডের উপর একটি বিজেপি কার্যালয়ে বসে কথা হচ্ছিল। প্রশ্ন শুনেই মুকেশ প্রায় খিঁচিয়ে উঠে উত্তর দিলেন, “ছেলেকে কেন মোদী মন্ত্রী করেননি তাই নিয়ে গোঁসা করে তো রানি প্রথম তিন বছর রাজপাটই দেখেননি।” গোটা রাজস্থানের বিজেপি কর্মীরা জানেন, বসুন্ধরা মনে করেন— মোদী ম্যাজিক নয়, বসুন্ধরা নিজের জোরে ২৫ জন সাংসদকে দিল্লি পাঠিয়েছেন। তাই ছেলে দুষ্মন্ত সিংহর কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় জায়গা না হওয়ায়, শুরু হয়ে যায় মোদী-শাহের সঙ্গে রানির স্নায়ুর লড়াই। ভারতীয় জনতা পার্টির অন্দরে সর্বজনবিদিত, বসুন্ধরাকে মসনদ থেকে সরাতে কম চেষ্টা করেনি মোদী-শাহ জুটি। তার পরেও, একজনও বিধায়ক সেই সময়ে ম্যাডামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার সাহস পাননি। বাংলার দিদির মত এ রাজ্যেও দল থেকে প্রশাসন, ম্যাডাম শেষ কথা। কিন্তু মুকেশের মত সাধারণ বিজেপি কর্মী থেকে শুরু করে ছোট বড় মাঝারি সব মাপের বিজেপি নেতারাই স্বীকার করেন, মোদীর সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে রাজ্যের কাজ থেকে হারিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। আড়ালে দলের লোকজনই তাঁকে বলতেন ‘এইট পিএম– নো সি এম’। অর্থাৎ রাত আটটার পর রানির নাগাল পেতেন না কেউ।
বিজেপি নেতাদের দাবি, যখন ফের তিনি নিজে হাতে রাজ্যপাট বুঝে নিলেন, তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। দুর্নীতি আর কাজ না করার পাহাড় প্রমাণ অভিযোগ। ফসলের দাম না পেয়ে চাষিরা আত্মহত্যা করছেন। উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের দাপটে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছেন দলিত এবং সংখ্যালঘুরা। বেতন না পেয়ে টানা এক মাস ধর্মঘট করছেন রাজ্য সরকারের পরিবহণ কর্মচারীরা। সর্বোপরি, বদলে গিয়েছে রাজস্থান রাজনীতির সবচেয়ে শক্তিশালী অনুঘটক জাত-পাতের সমীকরণ। জয়পুরের লাগোয়া জেলা দৌসা। এখান থেকেই লোকসভায় জিতেছিলেন শচীন পায়লট। সমীক্ষা বলছে— মুখ্যমন্ত্রীত্বের দৌড়ে শুধু রানি নন, নিজের দলের প্রবীন নেতা অশোক গহলৌতকে অনেকটাই পেছনে ফেলে দিয়েছেন নবীন শচিন। সম্পৎ সিংহ দৌসার মাঝারি মাপের কংগ্রেস নেতা। দৌসা চৌরাহায় (চৌমাথায়) বসে তিনি বোঝাচ্ছিলেন, রাজস্থানে একজন কুখ্যাত গ্যাংস্টারের মৃত্যুও এ বার কী ভাবে বদলে দিতে পারে রাজনীতির পাশা।
চুরু জেলার আনন্দপাল সিংহ ছিলেন রাজস্থানের মোস্ট ওয়ান্টেড গ্যাংস্টার। কয়েক ডজন খুনের অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে। একে ৪৭ ব্যবহার করা ওই গ্যাংস্টার ২০১৭ সালে পুলিশের সঙ্গে এনকাউন্টারে মারা যান। আনন্দপাল সিংহ জাতিতে রাজপুত। তাঁর এনকাউন্টারের খবর সামনে আসতেই বিক্ষোভের আগুন জ্বলে ওঠে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে। দাবি ওঠে সিবিআই তদন্তের। আনন্দ পালের পরিবার দাবি করে— পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছিলেন আনন্দপাল। আর তখনই তাঁকে নিরস্ত্র অবস্থায় পেয়ে খুন করে পুলিশ। সম্পৎ সিংহের দাবি, “পরিকল্পনা করেই সরিয়ে দেওয়া হয়েছে আনন্দপালকে। ওঁকে গ্রেফতার করলে অনেক এমন তথ্য সামনে আসত, যা বিপদে ফেলত বসুন্ধরার অনেক তাবড় মন্ত্রীকে।” সম্পতের দাবি, আনন্দপালের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে রাজপুতরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন রানির দিক থেকে। আর তাতে জোর বেড়েছে ‘পঞ্জা’-র।
রাহুল গাঁধী, অশোক গহলৌত এবং শচীন পায়লট।—ফাইল চিত্র।
আরও পড়ুন: রাজনীতি আসলে হাজার সম্ভাবনার মিশেল, বোঝাচ্ছে তেলঙ্গানা
সম্পতের মতই শচীনে মুগ্ধ ভরতপুরের ইলিয়াস খান। তাঁর কথায়, আনন্দপালের এনকাউন্টারের ঘটনায় রাজপুতদের রানির প্রতি যে অনাস্থা তৈরি হয়েছিল, তা কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছে মানবেন্দ্র সিংহ দল ছাড়ার পর। প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জসবন্ত সিংহর পরিবারের প্রভাব রাজপুতদের মধ্যে এখনও অনেকটাই। তাই জসবন্তপুত্র শচীন ব্রিগেডে নাম লিখিয়ে, খোদ রানির খাস তালুক ঝালোয়ার পাটনে সরাসরি বসুন্ধরা রাজেকে চ্যালেঞ্জ জানানোয় রাজপুত স্বাভিমান বেড়েছে। ইলিয়াসের দাবি, “যখন রাজপুত-গুজ্জর (শচীন পায়লট নিজে গুজ্জর) একসঙ্গে, তখন রানির গদি ছিনিয়ে নেওয়া খালি সময়ের অপেক্ষা। যদিও অঙ্কের হিসেবে মোট ভোটের মাত্র দশ শতাংশ রাজপুত-গুজ্জররা। তার বাইরেও মিনা, দলিত এবং জাটেদের একটা বড় ভোট ব্যাঙ্ক রয়েছে। কংগ্রেস নেতাদের দাবি, সেই ভোট ব্যাঙ্কের অনেকটাই আসবে তাঁদের দিকে।
কিন্তু এত কিছুর পরও কোথাও যেন একটা কিন্তু রয়েছে। এই সম্পৎ ইলিয়াসরা যতই আত্মবিশ্বাসী হোন না কেন, দলের প্রবীণ পোড়খাওয়া কর্মীদের মধ্যে রয়েছে একটাই আশঙ্কা। অশোক গহলৌত ঘনিষ্ঠ কংগ্রেসের এক প্রবীণ নেতা বললেন, “আমরা জিতলে জিতব বসু্ন্ধরার জন্যই। হারলেও হারব রানির কাছেই।” ভয়টা রানির সম্মোহনী ক্ষমতাকে। ওই নেতা বলেন, “শেষ মুহূর্তেও হারা বাজি জিতে নেওয়ার ক্ষমতা রাখেন রানি। আর সেটাই ঘরোয়া বৈঠকে বার বার নেতা-কর্মীদের বুঝিয়ে সতর্ক করছেন গহলৌত।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy