অসমের নাগরিক পঞ্জি থেকে বাদ পড়েছে এই দম্পতির নাম। কলকাতায় এসেছিলেন সরকারি নথির সন্ধানে। —নিজস্ব চিত্র।
কিছু দিন আগেও তিনি ভারতীয় রেলের কর্মচারী ছিলেন। অবসরের পর সরকারি ফ্ল্যাট ছেড়ে অসমে জমি কিনে দুই ছেলে, নাতি-নাতনি নিয়ে ভরা সংসার। ২০১৪ সালে অবসরের পর পেনশনের টাকাও পাচ্ছেন। কিন্তু, এত কিছুর পরেও তিনি ‘ভারতীয়’ নন।
অবসর জীবনে কোনও সমস্যাই ছিল না। নাগরিক পঞ্জির খসড়া তালিকায় নাম বাদ পড়ার পর যেন মাথায় বাজ ভেঙে পড়ল নবকুমার রায়ের! যে সরকার তাঁকে জমি কেনার অনুমতি দিয়েছে, যে সরকার তাঁকে রেলের চাকরি দিয়েছে, সেই সরকারই এখন তাঁর কাছে ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রমাণ চাইছে।
দুর্ভাগ্যবশত তাঁর কাছে ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের আগে কোনও সরকারি নথি নেই। যে কাগজ দেখিয়ে প্রমাণ করতে পারবেন তিনি ‘ভারতীয়’। নবকুমারের দাবি, কলকাতায় এক দরিদ্র পরিবারে তাঁর জন্ম। জন্মের কোনও নথিপত্র কখনও ছিল কি না তাও মনে নেই। এই শহরে ভাড়া বাড়িতে থাকতেন তাঁরা। পরে জামশেদপুরে কিছু দিন কাটিয়ে চলে গিয়েছিলেন অসমে। চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা। কলকাতার ভোটার তালিকায় নাম ছিল না। ছিল না জামশেদপুরেও। অসমে থাকতেই রেলে চাকরি পেয়েছেন। সেটা ১৯৭২ সাল। ফলে ১৯৭১ সালের আগে কোনও সরকারি নথি তিনি দেখাতে পারছেন না। সেখানেই যত বিপত্তি!
আরও পড়ুন
এ বার পুলিশের মোবাইলেও মোমো, পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুড়তেই খুনের হুমকি
নাইট স্কুলের নথি এবং অবসরের পর রেলের পেনশনের নথি থাকা সত্ত্বেও নাম বাদ। —নিজস্ব চিত্র।
সম্প্রতি অসমে নাগরিক পঞ্জির খসড়া তালিকা থেকে ৪০ লাখ মানুষের নাম বাদ গিয়েছে। সেই তালিকাতে নাম ছিল না নবকুমার রায়ের। শুধু তিনি নন, তাঁর দুই ছেলে-সহ পরিবারের বাকি সদস্যরাও এখন পরিচয়হীন। নবকুমারবাবুর বক্তব্য, “শুধুমাত্র একটি সরকারি কাগজই আমাকে ফের ভারতীয় হিসেবে প্রমাণ করতে পারে। মায়ের কাছে শুনেছিলাম, কিন্তু মনে নেই কোন সরকারি হাসপাতালে জন্মেছিলাম। একের পর এক হাসপাতাল, খিদিরপুরের যে পাড়ায় থাকতাম, সার্ভে বিল্ডিং— সর্বত্র ঘুরে বেড়িয়েছি। এখনও ১৯৭১ সালের আগে কোনও নথি পাইনি।”
বছর পঁয়ষট্টির নবকুমারবাবু এখন তাঁর স্ত্রী-পরিবার নিয়ে অথৈ জলে পড়েছেন। তাঁর বক্তব্য, “এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম নাগরিক পঞ্জি নিয়ে প্রতিবাদ জনিয়েছিলেন। তিনি নিশ্চয়ই আমাদের পাশে দাঁড়াবেন। সেই লক্ষ্যেই কলকাতায় এসেছি।”
আরও পড়ুন
নয়া রাজনৈতিক ‘ক্ষীর’ তৈরির জল্পনা ওড়ালেন উপেন্দ্র কুশওয়াহা
অসমে বসবাস এবং কর্মজীবন হলেও ১৯৫৪ সালে নবকুমারবাবুর জন্ম কলকাতার কোনও এক সরকারি হাসপাতালে। তাঁর দাবি, খিদিরপুরের তাঁরা রামকমল স্ট্রিটের একটি বাড়়িতে ভাড়া থাকতেন। নবকুমারবাবুর বয়স যখন মাত্র ছ’মাস, তখন তাঁর বাবা প্রেমানন্দ রায় মারা যান। তার পর থেকেই মামাদের কাছে মানুষ। অভাবের সংসার। তাই চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্তই পড়াশোনা করেছিলেন। ১৯৬৪ সালে মাত্র ১০ বছর বয়সেই কলকাতা ছে়ড়ে চলে যান জামশেদপুরে। সেখান থেকে অসমের বঙ্গাইগাঁও। সেখানে গিয়ে একটি নাইট স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। যদিও সেখানে পড়াশোনা শেষ হয়নি। সেই নথিও রয়েছে। কিন্তু সেই বেসরকারি নথির কোনও ‘মূল্য’ নেই সরকারের কাছে।
আরও পড়ুন
এ বার কি রাহুল-ইয়েচুরিকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে আরএসএস?
১৯৭২ সালে রেলের চাকরিতে যোগ দেন। তার পর বঙ্গাইগাঁও রেল হাসপাতালের কোয়ার্টারেই (নম্বর ৩০৪বি রুমে) পাকাপাকি ভাবে বসবাস শুরু করেন তিনি। সরকারি নথি বলতে রেলের সেই নিয়োগপত্র। তা-ও যদি সেটা ১৯৭১-এর হত, তা হলে হয়তো এত ঝক্কি পোহাতে হত না। তবে তা অসমে নাগরিকপঞ্জি তৈরির সময় গ্রাহ্য হয়নি।
দু’দশক আগে মা মারা গিয়েছেন। কলকাতায় অনেক আশা নিয়ে এসেছিলেন নবকুমার। তবে কয়েক দিন প্রশাসনিক দফতরে ঘুরে ঘুরে কাজ না হওয়ায় অনিশ্চিত ভবিষ্যত নিয়েই বঙ্গাইগাঁও ফিরে যাচ্ছেন ওই দম্পতি।
(দেশজোড়া ঘটনার বাছাই করা সেরা বাংলা খবর পেতে পড়ুন আমাদের দেশ বিভাগ।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy