শুক্রবার সন্ধ্যায় করমণ্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনায় মোট মৃত্যু হয়েছে ২৮৮ জনের। ছবি: পিটিআই।
প্রথমে সাদা কাপড়ে মুড়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কাছের স্কুলবাড়িতে। সেখান থেকে ঠান্ডা ঘরের খোঁজে নর্থ ওড়িশা চেম্বার অব কমার্স ভবনে। রবিবার সেখান থেকেও জায়গা পরিবর্তন করে নিয়ে যাওয়া হল ভুবনেশ্বর এমস এবং কটকের হাসপাতালে। যাতে পরিজনেরা এসে চিহ্নিত করার আগে তাঁদের শরীরে পচন না ধরে যায়।
গত ৪৮ ঘণ্টায় এ ভাবেই বারবার ঠিকানা বদলাল ওড়িশা ট্রেন দুর্ঘটনায় নাম-ঠিকানাহীন মৃতদেহগুলির। সংখ্যায় এখনও সরকারি হিসাবে মৃতদের অর্ধেকেরও বেশি। রেলের হিসাব অনুযায়ী, শুক্রবার সন্ধ্যায় করমণ্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনায় মোট মৃত্যু হয়েছে ২৮৮ জনের। রবিবার প্রকাশিত ওড়িশার সরকারি তথ্য বলছে, এঁদের মধ্যে ১৮২ জনকে এখনও শনাক্ত করা যায়নি। আপাতত লাশকাটা ঘরেই রাখা হয়েছে দেহগুলি।
অন্য দিকে আহতের চিকিৎসা চলছে যে হাসপাতালগুলিতে, সেখানে এখনও ‘যুদ্ধকালীন’ তৎপরতা। মাঝেমধ্যেই শোনা যাচ্ছে গোঙানির আওয়াজ। কখনও কখনও গুরুতর আহতের আর্তনাদও। এ সবের মধ্যেই রাজনৈতিক ভিআইপিরা আসা যাওয়া করছেন। শনিবারের মতো ‘টপ হেভিওয়েট’ আগমন না হলেও, রবিবার অধীর চৌধুরী, শুভেন্দু অধিকারীরা হাসপাতালে যান। তবে রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব শনিবার থেকে বার বারই গিয়েছেন হাসপাতালে। কখনও একা। কখনও অন্যদের সঙ্গে।
রেলের এখন লক্ষ্য যত দ্রুত সম্ভব ওই লাইনে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক করা। তবে কেন্দ্রের তরফে যা তুলে ধরা হচ্ছে না, তা হল, এখনও কিছু মানুষ খুঁজে বেড়াচ্ছেন তাঁদের সেই আত্মীয়বন্ধুকে, যিনি করমণ্ডলে ছিলেন। দ্বিতীয়ত, এত অশনাক্ত দেহ কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে, তা-ও ভেবে দেখার বিষয়।
শনাক্তকরণ চ্যালেঞ্জ
গত শুক্রবার বালেশ্বরের রেল দুর্ঘটনার পর ২ দিন কেটে গিয়েছে। রেলপথ সারিয়ে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক করার পাশাপাশি দুর্ঘটনায় মৃতদের তাঁদের পরিজনের কাছে পৌঁছে দেওয়াটাও একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে ভারতীয় রেল এবং ওড়িশা সরকারের কাছে। বিশেষ করে যেখানে দেহ বলতে কোনওটা মুণ্ডহীন ধড়, কারও থেঁতলে যাওয়া মাথা তো কারও জ্বলে যাওয়া মুখ। শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের চিহ্ন কিংবা পরনের সাজ পোশাকই আপাতত সেগুলির পরিচয়পত্র। তবে মৃতদেহ শনাক্তকরণের একটি ব্যবস্থা রবিবার সকাল থেকে করেছে ওড়িশা প্রশাসন। মৃতদেহের ছবি তুলে, সেগুলিকে এক একটি নম্বর দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে। জায়ান্ট স্ক্রিনে প্রজেক্টরের মাধ্যমে দেখানো হচ্ছে সেই সব ছবি। হাসপাতাল এবং থানায় এই ব্যবস্থা করা হয়েছে। দেহ দেখে চিহ্নিত করতে পারলে তখনই তা পরিবারের হাতে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করছে ওড়িশা প্রশাসন।
হাসপাতালে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি
এর সঙ্গে দুর্ঘটনায় শ'য়ে শ'য়ে আহতদের চিকিৎসার চাপ তো আছেই। ৯০০-র বেশি আহতের কেউ কেউ অল্প আঘাতে রক্ষা পেলেও অনেকেরই আঘাত গুরুতর। আশঙ্কাজনকও অনেকে। পরিস্থিতি সামাল দিতে বালেশ্বরের পাশাপাশি কটক, সোরো, জাজপুর, ভদ্রকের হাসপাতালেও নিয়ে যাওয়া হয়েছে রোগীদের। রবিবার সকাল পর্যন্ত সেই সব হাসপাতালে অ্যাম্বুল্যান্সের যাওয়া-আসা জারি ছিল। সন্ধ্যায় কিছুটা কমেছে। দুর্ঘটনায় আহত রোগীদের জায়গা দিতে হাসপাতাল থেকে কিছুটা সুস্থ রোগীদের ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়েছে। একরকম যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতেই এখনও চলছে চিকিৎসা। তবে আহতদের দ্রুত চিকিৎসা পরিষেবা দিতে চেষ্টার কোনও খামতি রাখেননি হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স অন্যান্য কর্মীরা। সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে বালেশ্বর জেলা সদর হাসপাতালের অতিরিক্ত জেলা মেডিক্যাল আধিকারিক (এডিএমও) চিকিৎসক মৃত্যুঞ্জয় মিশ্র বলেন, “আমার পেশাগত জীবনে এ রকম যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির মুখোমুখি হইনি। হঠাৎ একসঙ্গে ২৫১ জন আহত যাত্রীকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হল। আমরা কোনও রকম প্রস্তুতই ছিলাম না। দিশাহারা অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল তখন। তবে হাসপাতালের সমস্ত কর্মী কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সারারাত ধরে আহতদের চিকিৎসা পরিষেবা দিয়ে গিয়েছেন।”
বাংলার ৬২
ওড়িশার ট্রেন দুর্ঘটনায় বাংলার ৬২ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রবিবার নবান্নে এক সাংবাদিক বৈঠকে মমতা বলেন, ‘‘দুর্ঘটনায় এখনও পর্যন্ত আমাদের রাজ্য থেকে মারা গিয়েছেন ৬২ জন। আমরা তাঁদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেব। মৃত ব্যক্তিদের পরিবারকে ৫ লাখ টাকা করে দেব। গুরুতর আহতদের দেওয়া হবে ১ লক্ষ টাকা করে। অল্প আহতদের ২৫ হাজার করে দেওয়া হবে। আগামী ৩ মাস তাদের রক্ষণাবেক্ষণের ভারও নেবে সরকার।’’ এই ঘটনায় যাঁরা আহত বা গুরুতর আহত হয়েছেন এবং বেঁচে ফিরেছেন, তাঁরা এখনও আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী জানান, এঁদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে সময় লাগবে, তাই সরকার আগামী ৩ মাস তাঁদের পাশে থেকে সাহায্য করবে। আপাতত তাঁদের ১০ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে। তারপর ৩ মাস তাঁদের ২ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে। মমতা বলেন, ‘‘সরকারের তরফে চাল, ডাল ইত্যাদি জিনিসও তাঁদের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হবে।’’ পাশাপাশি, যাঁরা কাজ চাইবেন, তাঁদের প্রয়োজনে ১০০ দিনের কাজ দেওয়ার আশ্বাসও দিয়েছেন মমতা।
কলকাতা থেকে বিশেষ দল
ওড়িশায় এই দুর্ঘটনায় বাংলার আরও অনেকেই পড়ে থাকতে পারেন অনুমান করে, রাজ্য থেকে বিশেষ দল পাঠানো হচ্ছে ওড়িশায়। কলকাতা পুলিশের ১২ জন সদস্যের দলের সঙ্গে রাজ্য পুলিশেরও একটি দল ওড়িশায় থাকবে। একটি সাহায্য-কেন্দ্র তৈরি করবে এই বিশেষ দল। যাতে দুর্ঘটনায় বিপন্ন সাধারণ মানুষ প্রয়োজনীয় সাহায্য পেতে পারেন। এমনকি, প্রিয়জনকে শনাক্ত করার জন্য ডিএনএ পরীক্ষা করতে হলে তাঁরা সেই ব্যবস্থাও করবেন সেখান থেকেই।
মৃতের সংখ্যা ‘কমল’!
রবিবার সকালে হঠাৎই ওড়িশা সরকার জানাল, বালেশ্বরে ট্রেন দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা ২৭৫। পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করেই এই সংখ্যা চূড়ান্ত করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ওড়িশা সরকার। এর মধ্যে ১৮২টি দেহ এখনও শনাক্ত করা যায়নি। যদিও শনিবার রেল যে বিবৃতি দিয়েছিল, তাতে দেখা গিয়েছিল বালেশ্বর দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ২৮৮ জনের। রবিবারও রেল কোনও বদলের কথা জানায়নি।
বাইডেনের শোক
ওড়িশায় করমণ্ডল এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনায় শোকপ্রকাশ করলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তিনি জানিয়েছেন, তিনি এবং তাঁর স্ত্রী (অর্থাৎ আমেরিকার ফার্স্ট লেডি জিল) এই ঘটনায় মর্মাহত। মৃতদের আত্মার শান্তি কামনা করেছেন তাঁরা। বিবৃতিতে বাইডেন বলেন, ‘‘ভারতে এমন ভয়ঙ্কর ট্রেন দুর্ঘটনার খবরে আমি এবং জিল মর্মাহত। যাঁরা কাছের মানুষকে হারিয়েছেন, যাঁরা এই দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন, আমরা তাঁদের জন্য প্রার্থনা করছি।’’ বাইডেনের আগে আরও অনেক রাষ্ট্রনেতাও ওড়িশা ট্রেন দুর্ঘটনায় শোক জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁদের সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বার্তাও দিয়েছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy