দুর্ঘটনাস্থলের ভয়াবহ চিত্র। —নিজস্ব চিত্র।
করমণ্ডল দুর্ঘটনা-রহস্যে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে নতুন মোড়। শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টার দু'এক মিনিট আগে ওড়িশার বালেশ্বরের কাছে বাহানগা বাজারে দুর্ঘটনা ঘটেছিল। শনিবার রেলের অভ্যন্তরীণ তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্টে বলা হয়, সিগন্যালের ত্রুটিতেই এই বিপর্যয়। রবিবার সকালে রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব স্পষ্ট ইঙ্গিত দিলেন, ‘ত্রুটি’র নেপথ্যে হাত রয়েছে মানুষেরই। এবং রবিবারই সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় তিনি সাংবাদিকদের জানান, সব দিক খতিয়ে দেখে সরকারের কাছে সিবিআই তদন্তের সুপারিশ করছে রেল বোর্ড। এর পরেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, তবে কি করমণ্ডলকাণ্ডে অন্তর্ঘাতের সম্ভাবনা দেখছে ভারতীয় রেল?
রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব রবিবার সকালে সরকারি সংবাদমাধ্যম দূরদর্শনকে বলেন, ‘‘এই কাজ যাঁরা করেছেন, তাঁদের চিহ্নিত করা গিয়েছে।’’ অর্থাৎ, ট্রেন দুর্ঘটনার পিছনে যে মানুষের হাত আছে, তার ইঙ্গিত ছিল মন্ত্রীর ওই কথায়। দুর্ঘটনার মূল কারণ জানা গিয়েছে বলেও জানিয়েছিলেন তিনি। সন্ধ্যায় সিবিআই তদন্তের সুপারিশের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘যা কিছু প্রশাসনিক তথ্য পাওয়া গিয়েছে, সব মাথায় রেখেই এই দুর্ঘটনার তদন্তভার সিবিআইয়ের হাতে দেওয়ার সুপারিশ করেছে রেলওয়ে বোর্ড।’’
এই ঘটনার তদন্ত করছিলেন রেলের নিরাপত্তা সংক্রান্ত কমিশনার (সিআরএস)। তদন্তের সেই রিপোর্ট শীঘ্রই প্রকাশ্যে আসবে বলে রবিবার সকালে জানিয়েছিলেন রেলমন্ত্রী। কিন্তু অশ্বিনীর সিবিআই-ঘোষণার পর প্রশ্ন উঠছে যে, নিছকই কি মানুষের গাফিলতি, নাকি দুর্ঘটনার নেপথ্যে কোনও অন্তর্ঘাতের আশঙ্কা করছে রেল? সেই কারণেই কি তদন্তভার তুলে দেওয়া হল কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার হাতে? চেন্নাইগামী করমণ্ডল এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত হওয়ার নেপথ্যে যান্ত্রিক ত্রুটির সম্ভাবনা রেল উড়িয়ে দিচ্ছে কি না, এই প্রশ্নে সাবধানী উত্তর দিয়ে অশ্বিনী রবিবার সকালে বলেন, “এখনই এ নিয়ে মন্তব্য করা ঠিক হবে না।” তদন্ত-রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলেন তিনি। অশ্বিনী যে তদন্ত-রিপোর্টের কথা উল্লেখ করেন, সেটি সিআরএস-এর দেওয়া রিপোর্ট। সেই রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে দাঁড়িয়েই রেল যে আরও বড় পরিসরে তদন্ত চাইছে, সিবিআই তদন্তের সুপারিশে তা স্পষ্ট।
রবিবার সকালে কী কী বলেন রেলমন্ত্রী
রবিবার সকালে ওড়িশার বাহানগা বাজারের দুর্ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে সরকারি সংবাদমাধ্যম দূরদর্শনকে সাক্ষাৎকার দেন রেলমন্ত্রী। সেখানে তিনি বলেন, “রেলের নিরাপত্তা সংক্রান্ত কমিশনার (সিআরএস) গতকাল দুর্ঘটনাস্থলে ছিলেন... সিআরএস সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা বলেছেন, এবং দ্রুত তদন্ত এগিয়েছেন। দুর্ঘটনার মূল কারণ চিহ্নিত করা গিয়েছে।’’ এর পরই তাঁর মন্তব্য ছিল, ‘‘এই কাজ যাঁরা করেছেন তাঁদেরও চিহ্নিত করে ফেলা হয়েছে। সিআরএস তদন্ত রিপোর্ট, এই দুর্ঘটনার কারণ খুব শীঘ্রই জানা যাবে।’’ অশ্বিনী আরও বলেন, “যাঁরা এই কাজ করেছেন, তাঁরা পয়েন্ট মেশিনে, যেখান থেকে লাইন নিয়ন্ত্রিত হয়, সেখানে পরিবর্তন করেছেন। সে কারণেই এই দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। কিন্তু নিরপেক্ষ সংস্থার দ্বারা রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসার পরেই আমি এই বিষয়ে মন্তব্য করব।”
রবিবার সন্ধ্যায় রেলমন্ত্রী
রেলমন্ত্রী সন্ধ্যায় বলেন, ‘‘যা কিছু তথ্য পাওয়া গিয়েছে, সব মাথায় রেখেই এই দুর্ঘটনার তদন্তভার সিবিআইয়ের হাতে দেওয়ার সুপারিশ করেছে রেলওয়ে বোর্ড।’’
তদন্ত চেয়ে আদালতে
বালেশ্বরের ট্রেন দুর্ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত চেয়ে জনস্বার্থ মামলা দায়ের হয়েছে সুপ্রিম কোর্টে। সংবাদ সংস্থা এএনআই সূত্রের খবর, এক জন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে এই ট্রেন দুর্ঘটনার তদন্ত চেয়ে জনস্বার্থ মামলা দায়ের হয়েছে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে। মামলার আবেদনে ট্রেনের বিশেষ সুরক্ষা প্রযুক্তি ‘কবচ’ ব্যবহারের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশিকাও চাওয়া হয়েছে।
মমতার বক্তব্য
রবিবারও রেলের গাফিলতির দিকে ইঙ্গিত করে কেন্দ্রীয় সরকারের সমালোচনা করেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তথা দেশের প্রাক্তন রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভগবানের ভরসায় রেল চলছে বলেও কটাক্ষ করেন তিনি। তাঁর জমানায় হওয়া কাজের দেখভাল না হওয়াতেই এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে বলেই কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে তোপ দাগেন মুখ্যমন্ত্রী। রবিবার নবান্নের সাংবাদিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘আমি কাউকে কোনও আক্রমণ করেনি। যতটুকু বলার, ততটুকুই বলেছি। সিগন্যালিং সিস্টেম কেউ দেখেই না, ভগবানের দয়ায় চলছে।’’ অ্যান্টি-কলিশন ডিভাইস নিয়ে নিজের পুরনো অবস্থান আবার তুলে ধরেন মমতা। সঙ্গে বলেন, ‘‘আমি গতকাল বালেশ্বর গিয়েও কারও বিরুদ্ধে কিছু বলিনি। রেলমন্ত্রী ও ধর্মেন্দ্রকে পাশে নিয়েই যা বলার বলেছি।
অধীর এবং শুভেন্দু ঘটনাস্থলে
রবিবার সকালে বাহানগা যান লোকসভায় কংগ্রেসের দলনেতা এবং পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী। দুপুরে যান রাজ্যের বিরোধী দলনেতা এবং বিজেপি সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী। শুভেন্দুর নিশানা ছিল মমতার দিকেই। মুখ্যমন্ত্রীকে কটাক্ষ করে তিনি বলেন, ‘‘তদন্তের আগেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কী করে জানলেন অ্যান্টি কলিশন ডিভাইস ছিল না?” তার পরই তাঁর সংযোজন, “এটা আপনার কাজ নয়, তদন্তকারীদের ওপর ছেড়ে দিন। তৃণমূলের সেকেন্ড ইন কমান্ড প্রধানমন্ত্রী-রেলমন্ত্রীকে নিশানা করেছেন। রেলমন্ত্রী নিজেই ষড়যন্ত্রের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।’’ অন্য দিকে রেলমন্ত্রকের গাফিলতি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন অধীর। তিনি বলেন, ‘‘দেশের রেলমন্ত্রী কার্যত নিষ্ক্রিয়। রেল উদ্বোধনে পতাকা নাড়েন কেবল প্রধানমন্ত্রী, আজ তো দায় তাঁকেই নিতে হবে। এই দুর্ঘটনার তদন্তের জন্য যে যৌথ কমিটি আছে, তার সম্পূর্ণ রিপোর্ট সর্বসমক্ষে আনতে হবে, তবেই বোঝা যাবে প্রকৃত দোষ কার।’’ অধীর, শুভেন্দু দু’জনেই হাসপাতালে গিয়ে আহতদের সঙ্গে দেখা করেন।
তদন্তের দাবি সিপিএমের
ওড়িশার ট্রেন দুর্ঘটনার উচ্চপর্যায়ের তদন্ত করার দাবি তুলল সিপিএম। দলের প্রাক্তন রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, ‘‘এই ঘটনায় কেন্দ্রীয় সরকার তাদের দায়িত্ব এড়াতে পারে না। আমরা চাই, উচ্চপর্যায়ের নিরপেক্ষ তদন্ত করে প্রকৃত দোষীদের ধরা হোক। জীবনের কি ক্ষতিপূরণ হয়? একটার পর একটা রেল দুর্ঘটনা হচ্ছে। যা অবস্থা হচ্ছে, তাতে মানুষের নিরাপত্তাও বিপর্যস্ত হবে।’’ সিপিএম যখন এই দাবি তুলছে, তখনও সিবিআই তদন্তের সুপারিশ করেনি রেল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy