মারিয়া ফিসফিস করে বললে, “ওপরে উঠবেন না? চলুন যাই।”
ভ্যাটিকান শহরে বর্তমান রোমের বা পৃথিবীর কোনও শহরেরই আধুনিকতার শোরগোল নেই। ফলে এই সেন্ট পিটার গির্জার চৌহদ্দির মধ্যে একবার ঢুকে পড়লে মনে হবে— জগৎময় পার্থিব গোলমাল, হানাহানি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা তথা শব্দদূষণের আওতায় দমবন্ধ হয়ে আসছিল ‘শান্তি’র ‘নৈঃশব্দ্যে’র। এখানে এই ঈশ্বরের শহরে ‘ওরা’ নিশ্চিন্ত ঠাঁই করে নিয়েছে। তাই অ্যাতো বিশাল জনসমাবেশেও সামান্য গুঞ্জনের আওয়াজ আছে, তবুও আশ্চর্য প্রশান্তি বিরাজ করছে।
তাই এ গির্জায় জোরে কথা বলা যায় না। কোনও বারণ নেই, তবু বলা যায় না। সবাই ঘুরে তাকাবে আপনার দিকে। ভুরু কুঁচকে, চোখ পাকিয়ে। মানুষ-মানুষি বা খেলনা পুতুলের সাবেক কালের পাথরে তৈরি মূর্তিরা, সিংহাসনের শূন্যতা— সবাই আপনার দিকে বকুনি দেবার মতো তাকাবে। বেশি শব্দ করে হেসে ফেললে হয়তো গোটা সেন্ট পিটার গির্জা, তার সমস্ত ইতিহাস, বিশ্বাস এবং সমগ্র সৌন্দর্য নিয়ে ভেঙে পড়বে আপনার ওপর।
মারিয়ার মা বাতাসের শব্দে প্রায় শোনাই-যায়-না এমন মৃদু কণ্ঠে জানালেন, “তোমরা যাও। ঘুরে এসো। আমি আর ওপরে উঠতে চাই না। বরং এইখানে নতজানু হয়ে ততক্ষণ উপাসনা করি।”
সিঁড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে লক্ষ করলুম, মেঝেতে দাগ দিয়ে দিয়ে পৃথিবীর বিখ্যাত নানান গির্জার নাম খোদাই করা আছে। বুঝলুম, সেন্ট পিটারের শেষ প্রান্ত থেকে এই অবধি অমুক গির্জার আয়তন। আর একটু এগিয়ে আবার দাগ কাটা। পাশে লেখা অপর এক গির্জার নাম। এমনি করে পৃথিবীর অন্তত সাত-আটটি প্রাচীন ঐতিহ্যময় গির্জার থেকে সেন্ট পিটার আয়তনে কত বড় তা দেখানো হয়েছে। পাথরের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে লাগলুম। ঘোরানো সিঁড়ি। কুতুবমিনার বা আমাদের সাধের ‘মনুমেন্ট’ অথবা ‘শহিদ মিনার’-এর মতোই। তবে এটি বেশ চওড়া। বড় বড় নিরেট পাথরের সিঁড়ি। দু’ধাপ আগে আগে মারিয়া উঠছে। উত্তেজিত পাখির মতো দেখাচ্ছে ওকে। সার বেঁধে লোক উঠছে আমার আগে-পিছনে। শুধু উঠছে। নামার পথ ভিন্ন।
মাটি থেকে একেবারে মাথার ওপরে ‘ক্রশচিহ্ন’ পর্যন্ত উচ্চতা ১৩২ মিটার। অন্তত শ’খানেক মিটার তো ঠেলে উঠতেই হবে। ৫০০ সিঁড়ি। বেলা বাড়তে বাড়তে মধ্যাহ্ন-শেষের ইঙ্গিত পাই। বুকে হাঁফ ধরে। টান ধরে শিরায় শিরায়। মনে হয় চারপাশের দেওয়ালে উৎসবের বাজনা বাজছে। খ্রিষ্টের জন্মদিন ও ইংরেজি নতুন বছরের যুগল উৎসব চলে এখানে। টানা সাত-দশ দিন ধরে। ক্লান্ত পায়ে আলো-অন্ধকারে সিঁড়ি ভাঙছি। এক দঙ্গল ভিড় এগিয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছে। পেছনের দলের গুঞ্জন শুনতে পাচ্ছি পাথরের দেওয়ালে দেওয়ালে। ওরই মধ্যে খুব কাছ থেকে সুর ভাসছে। যেন ঠিক পেছনের ধাপে কেউ দাঁড়িয়ে পড়েছে কানের কাছে। ফিসফিস করে ‘ক্রিসমাস ক্যারল’ গাইছে— “উই উইশ ইউ এ মেরি ক্রিসমাস অ্যান্ড এ হ্যাপি নিউ ইয়ার”।
বড়দিনের শুভেচ্ছা ও এই ক’দিন আগে যে নতুন বছর শুরু হল, তাকে স্বাগত জানিয়ে, ‘বিশ্ববাসীর ভাল হোক’ প্রার্থনার আনন্দময় সুর।
“সো দিস ইজ ক্রিসমাস
হোয়াট হ্যাভ ইউ ডান?
অ্যানাদার ইয়ার ওভার
এ নিউ ওয়ান জাস্ট বিগান
সো, দিস ইজ ক্রিসমাস
আই হোপ ইউ হ্যাভ ফান...
ফর দি নিয়ার অ্যান্ড দি ডিয়ার ওয়ান
দি ওল্ড অ্যান্ড দি ইয়ং
ভেরি মেরি ক্রিসমাস
অ্যান্ড এ হ্যাপি নিউ ইয়ার...
ফর দ্য উইক অ্যান্ড দ্য স্ট্রং
ফর দ্য রিচ অ্যান্ড দ্য পুওর
দি ওয়ার ইজ সো রং
হোপ ইট’জ এ গুড ওয়ান
...দারুণ সুরে মন ভরে গিয়ে চোখে আপনাআপনি জল এসে যাবার মতো, এমন আন্তরিক গান বাজছে ডানদিকের এবং বাঁদিকের কানের কাছে, চারপাশে। দু’পাশে, পেছনে তাকিয়ে ঘুরে দেখি— কেউ নেই। পেছনে সফরকারী দলের গুঞ্জন উঠে আসছে। কেমন যেন অস্বস্তি লাগল। ক্লান্তি কাটিয়ে ওপরে উঠতে লাগলুম। মারিয়াকে দেখা যাচ্ছে না। ওকে ধরে ফেলবার চেষ্টায় দ্রুত উঠছি। আবার ওই কণ্ঠস্বর পেছনে, দু’পাশে। না কি সারা দেবালয় জুড়ে? অথবা নিজের মনের অন্দরমহলে? ঠিক ঠাহর করা যাচ্ছে না। অনেকটা শেষ রাতে হাল্কা শিশির পড়ার মতো। অথবা এই বিদেশে, বর্তমান সময়ে তুষারপাতের মতো হাল্কা, ফিসফিস করে কথা বলার মতো কণ্ঠস্বর। অথচ গম্ভীর এবং ক্লান্ত, “এখনও তোমাদের, জীবিত প্রাণের মায়ায় জড়িয়ে রয়েছি...চারিদিকের ভার-বোঝা ব’য়ে ব’য়ে দিনযাপন... ।”
পিছনের দলবল উঠে এসেছে প্রায়। স্তম্ভিত, মন্ত্রমুগ্ধের মতো অস্ফুট ইংরিজি কথাগুলি শোনবার চেষ্টা করছি। ভয় সরিয়েও দিতে পারছি না। অথচ একলা এই আধো-অন্ধকার সিঁড়িতে দাঁড়াতেও কেমন গা-ছমছম করছে। ভাগ্যিস, এই বিলিতি সংসার— বাচ্চাকাচ্চা সমেত— কিচিরমিচির আওয়াজ তুলে, খলবলিয়ে উঠছে। পায়ে পায়ে ওদের সঙ্গ নিলুম। ধন্ধ কিন্তু কাটল না।
ঘুরে ঘুরে পাথুরে চওড়া সিঁড়ি। যুগযুগান্তর ধরে শিল্পীদের হাতে হাতে এর ভোল পাল্টেছে। নকশা বদলেছে। অজস্র শিল্পীর স্পর্শ দেওয়ালে দেওয়ালে। অনেক সময়ের। ‘কুপোলা’ তৈরির ব্যাপারে চিত্রশিল্পী র্যাফেলকে ডাকা হয়েছিল। নানা কারণে-অকারণে প্রায় তিরিশটা বছর কাটিয়ে দিয়েছেন। হাত দেননি কাজে। তারপর এসেছেন মাইকেল অ্যাঞ্জেলো। ১৫৪৬ সালে। এখনকার সেন্ট পিটার গির্জার ‘কুপোলা’ বা প্রধান গম্বুজটি তাঁর প্ল্যান অনুযায়ী তৈরি হয়েছে।
মিনারের মাঝামাঝি সিঁড়ি বেয়ে ওঠার পর গম্বুজের ভেতরের ঘেরা বারান্দা। সারা গম্বুজ ঘেরা চক্রাকার রেলিং ধরে নীচে চোখ যেতেই টের পেলুম অনেক উঁচুতে উঠে এসেছি। পাঁচ-ছ’ তলা তো হবেই। সুবিশাল বৃত্তাকার হলঘরের মতনই নীচের গির্জার চত্বর। প্রচুর মানুষ-মানুষির জমায়েত। হঠাৎ খেয়াল করলুম এখানে দাঁড়িয়ে সম্মিলিত গুঞ্জনের ভেতরে আর কোনও অলৌকিক ধ্বনি বা গান অথবা কথা কানে আসছে না। সেই অপ্রাকৃত তুষারপাতের শব্দ আর বাজছে না মনের কল্পনায় বা বাস্তবে। যাকগে, ভুলেই গেলুম চারপাশের মহার্ঘ দৃশ্যাবলিতে চোখ পাততে। ওপরে তাকালুম এ বার। ছোট ছোট চৌকো মার্বেল পাথর বা মোজেইক গায়ে গায়ে একের পর এক লাগিয়ে বিরাট আকারের ছবি সারা দেওয়াল জুড়ে। গম্বুজের চক্রাকার দেওয়ালে মস্ত ‘মিউরাল’। পাশাপাশি ছোট্ট দুটি টুকরোয় রঙের বা আলোছায়ার প্রভেদ এত সামান্য যে চোখেই পড়ে না। হাল্কা গাঢ় রং, উজ্জ্বল আলো এবং গভীর ছায়া সুন্দর ভাবে মিলে গেছে। খুঁটিয়ে এ সব লক্ষ করছি, ধীর পায়ে গোল গম্বুজের গায়ে গায়ে ঘুরছি।
চোখের আড়াল হয়ে গিয়েছিল মারিয়া। হঠাৎ কোত্থেকে উদয় হল। জিগ্যেস করলে, “এ কী! এখানে কতক্ষণ ঘুরবেন? ওপরে যাবেন না?”
“আবার ওপর কীসের?”
“ওমা! আরও ওপরে সিঁড়ি আছে। আপটু টপ। কাম অন...”
আগের মতোই ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলুম। পাথরের পর এ বার লোহার সিঁড়ি। ঘুরছে, ঘুরছে। যখন ছাতে পৌঁছলুম, তখন দমশূন্য বুক নিয়ে কোথাও বসতে পারলে বাঁচি। বাতাস বইছে ঝড়ের মতো। দমকা নয়, একটানা। ধুলোর চিহ্নমাত্র নেই। রোমের বিশুদ্ধ প্রাচীন বাতাসে হা-ক্লান্ত এবং ধুমসো গরম পোশাকের ভিতরে গলদঘর্ম শরীর জুড়িয়ে যাচ্ছে। ছাত, মানে গম্বুজের চূড়ার চারপাশ ঘিরে চক্রাকার বারান্দা। কলকাতার মনুমেন্ট বা শহিদ মিনারের মতো। এখন আমি ওপরে। খুব কাছাকাছি গির্জার ক্রশচিহ্ন। বিশাল স্তম্ভ বা থামের তৈরি গম্বুজের চূড়া এত বড় যে আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি তার ও পিঠে কী আছে দেখা যায় না। আস্তে আস্তে চক্রাকারে হাঁটা। হাত-পা ছেড়ে নয়। কেননা চারপাশের ঘোরানো জায়গা খুবই সংকীর্ণ। রেলিঙে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেলে আর দেখতে হবে না। পাথরে ধাক্কা খেতে খেতে পতন ও ছিন্নভিন্ন শরীর।
ঘুরে অন্য পাশে যেতে গিয়ে দেখি, স্তম্ভের দেওয়ালে হেলান দিয়ে একটি মানুষ দাঁড়িয়ে। শূন্য চোখে সামনে নীচের দিকে চেয়ে আছেন। হাল্কা বৃষ্টি-বরফের ছাটে চোখে সব কিছু আবছা দেখায়। ঘষা কাচের মতো ঝাপসা দেয়ালের ওপাশে চোখ রেখে মনে মনে শিউরে উঠলুম। এ কাকে দেখছি? বাতাসের একটানা হুহু আওয়াজ ছাপিয়ে তুষারপাতের মতো রোমাঞ্চকর কণ্ঠস্বর। যেন দিক্বিদিক্ থেকে ভেসে আসছে। অথবা নিজের ভেতরেই বাজছে কি? —“আমি তোমাদের কাছেই রয়েছি যেমন ছিলাম দু’হাজার বছর আগে।”
তুষার-জলকণায় ভেজা, ঝাপসা চোখের সামনে, কয়েক হাত দূরেই রয়েছেন— তবুও স্পর্শের নাগালের বাইরে। রুক্ষ, অযত্নের গোঁফ-দাড়ি বাতাসে উড়ছে। গায়ে ছেঁড়া কালচে কম্বলের টুকরো। কৌপীনের মতো মলিন কাপড়ের ছিন্ন অংশ। এলোমেলো কয়েকটা দীর্ঘ চুল। মুখ কি অল্প অল্প নড়ছে? কী যেন বলছেন বিড়বিড় করে! ভারতবর্ষের পথেঘাটে হয়তো এমন পাগল বা ভিখিরিকে দেখা যায় অহরহ। কিন্তু এখানে? এই দেবালয়ের চূড়ায়?
“তোমাদের জন্যে ‘উৎসব’ বয়ে এনেছি। নতুন বছরের আশা-আকাঙ্ক্ষা। তোমরা ভাল হও। ভাল থেকো। ওই যে নীচে, দূরে ‘টিগ্রিস’ নদীর পাশে ‘ইউফ্রাতেনে’ বড় ঘিঞ্জি বস্তি রয়েছে। ইহুদিদের ‘ঘেটো’, ‘টেস্টেভিয়ার’, লেফ্ট ব্যাংকের চারধারের দারিদ্রক্লিষ্ট মানুষজন— ওদের একটু ভালবাসা, একটু ভরসা দিও, আলো, রং, আনন্দ দিও।”
ভ্যাটিকান শহরের অবাস্তব হাওয়ায় কেমন যেন দৈববাণীর মতো ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে অপ্রাকৃত ক্লান্ত কণ্ঠস্বর।
যিশুখ্রিষ্টেরই উপস্থিতি দিক্-দিগন্তে। বাতাস হয়তো তাঁর বাণী বয়ে বেড়াচ্ছে এখানে।
রিক্ত চোখে, ক্লান্ত অবসন্ন শরীর এলিয়ে পাথরে বসে পড়লুম।
সিক্ত চোখে অবসন্ন শরীর এলিয়ে পাথরে বসে মনে হলো, আজও, এই মুহূর্তেও কি যিশু তাঁর ক্রুশ দণ্ড বয়ে বেড়াচ্ছেন? দিকে দিকে তাঁর শ্রান্ত কণ্ঠস্বর বাতাসের মতো ভাসছে রোমের এই অংশে, যাকে বিশ্ব ভ্যাটিকান বলে জানে? দেব-দ্বিজে এই অধমের বিশ্বাস মোটেই পোক্ত নয়। তবুও তাঁর অস্তিত্ব কি টের পাচ্ছি? সেই মসিহা, মানুষকে যিনি মুক্ত করতে চেয়েছিলেন, হয়তো বা যেন ফিসফিসিয়ে বলছেন, নতুন বছরের শুভেচ্ছা, সব্বাইকে, সবাই ভালো থেকো। ভালো হও। আমেন!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy