Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

ক্লান্ত রাবিয়া এ বার ঘুমোতে চায়

মুম্বই মনতাজ-এ মিলন মুখোপাধ্যায়।চোখের কোলে কাজল। এক মুখ নকল দাড়ি, মাথায় গোল সাদা টুপি, ইত্যাদি নিয়ে সেজেগুজে তৈরি হয়ে বসে রয়েছি। দুটো শটের পর আমার ডাক পড়বে। জ্যোতিপ্রকাশ রায়ের বাংলা ছায়াছবি ‘এরই নাম জীবন’। মুম্বইতে বাংলা ছবির পুরোপুরি শ্যুটিং হচ্ছে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়, মৌসুমি— এঁরাও রয়েছেন। এক সিনের বিয়ের আসরে আমাকেও সংলাপ বলতে হবে ক্যামেরার সামনে।

শেষ আপডেট: ৩০ জানুয়ারি ২০১৫ ২০:৩৫
Share: Save:

চোখের কোলে কাজল। এক মুখ নকল দাড়ি, মাথায় গোল সাদা টুপি, ইত্যাদি নিয়ে সেজেগুজে তৈরি হয়ে বসে রয়েছি। দুটো শটের পর আমার ডাক পড়বে। জ্যোতিপ্রকাশ রায়ের বাংলা ছায়াছবি ‘এরই নাম জীবন’। মুম্বইতে বাংলা ছবির পুরোপুরি শ্যুটিং হচ্ছে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়, মৌসুমি— এঁরাও রয়েছেন। এক সিনের বিয়ের আসরে আমাকেও সংলাপ বলতে হবে ক্যামেরার সামনে।

লুঙ্গি পরে, চেয়ারে পা তুলে বসে চা খাচ্ছি। একটি লোক এসে সামনে দাঁড়াল। ঝুঁকে খুব সমীহ করে জানতে চাইল,—মাচিস হ্যায় স্যর, মাচিস?

পাঞ্জাবির পকেট থেকে দেশলাই এগিয়ে দিলুম। হাতে নিয়ে মাটিতেই উবু হয়ে বসে পড়ল। কানে গোঁজা বিড়িটা হাতে নিল। আঙুলে টিপে, ফুঁ দিয়ে ঝেড়ে নিল আলগা ধুলো। বিড়ি ধরিয়ে দেশলাই ফেরত দিল। জানতে চাইলুম, এখানে, এই কমলিস্তান স্টুডিওতে কোন সুবাদে? কিছু সাপ্লাই দিতে, না অন্য কোনও সূত্রে।

“রাবিয়া...রাবিয়াকে লিয়ে...” বলে পান-খাওয়া দাঁতে একটু হাসি দিয়ে আবার বললে, “মেরে লিয়েভি।”

ঘোড়ার নাম রাবিয়া। ঘোড়া তো নয়, ওর ভাষায় ‘ঘোড়ি’। নিজের নাম বলল আলম। আলম আলি। কাঁচা-পাকা অবিন্যস্ত চুল। ক’দিনের না-কামানো দাড়ি। চেকচেক লুঙ্গি পরনে। লখনউ থেকে কাকার হাত ধরে এসেছিল সেই ৪০-৪৫ বছর আগে, ১২-১৪ বছর বয়সে। উঠেছিল শহরের দক্ষিণে, শেষ মাথায়। কাফ প্যারেডের বস্তিতে। কাছেই ছিল প্রায় ডজন দুয়েক ঘোড়ার আস্তাবল। মুম্বইয়ের আপিস এলাকার মূল কেন্দ্র বিকেলের পর একটু ফাঁকা। কলকাতার ডালহৌসির মতন। যখন মোটর গাড়ি কম ছিল, তখন ছিল ঘোড়ায় টানা গাড়ি। ব্রিটিশ আমলে ছিল ঘোড়ায় টানা ট্রাম।

“অব্ সব্ তোড়ফোড়কে বড়া বড়া বিল্ডিং বন রহা হ্যায়।”

আরও বললে, “তাজমহল হোটেল, কোলাবা, ব্যালাড এস্টেট, এমনকী মেরিন ড্রাইভেও আমাদের যাতায়াত ছিল সওয়ারি নিয়ে। ভাড়া খাটতুম। ঘোড়াগাড়ির ছিল কাঠের কাঠামো। যারা ভিন্ জায়গা থেকে আসত তারা ছাতে, পেছনে বাক্সো-বেডিং-লটবহর রাখত। মেন স্টেশন ভিটি বা বোরিবন্দরে রেলগাড়ি থেকে নেমে সোজা ঘোড়াগাড়ি ভাড়া করে আস্তানার উদ্দেশ্যে রওনা দিত— জুনা বা পুরোনো বোম্বাই এলাকার বাইকালা, চিঁচপোকলি, রানিবাগ, মহম্মদ আলি রোডে। সে সব উঠে গেছে দু’তিন দশক আগে। হিন্দিতে জানাল আলম।

“খোলা ছাতের গাড়িও ছিল অনেকের। সাইকেল রিকশার মতো ‘বারিষ’ এলে, ছাত লাগিয়ে নাও। বিকেলে হাওয়া খেতে হলে ছাত ফেলে দাও পেছনে।”

“তা, তুমি সেই দক্ষিণেই আছ? কাফ প্যারেড, কোলাবায়? অত দূর থেকে শহরতলির এই আন্ধেরি-পুবে এসেছ স্রেফ শুটিং করতে?”

আমি দেখেছি, বিকেলের পর থেকে খোলা গাড়িতে সেজেগুজে বিদেশি এবং ভিন্ রাজ্যের অধিবাসীরা সমুদ্রের মুক্ত হাওয়া খেতে চলে আসে। সেই চৌপাটি থেকে প্রায় মাইল-দেড় মাইল ‘কুইনস নেকলেস’ পথটি পরিক্রমা করে। এক দিকে মস্ত মস্ত বাড়ির সারি, অন্য দিকে স্রেফ আরব সাগরের নীল বিস্তার ও ছোট ছোট ঢেউ। প্রথম প্রথম আমারও ইচ্ছে হত এমনই সাজানো চকচকে রঙিন ফিটন গাড়িতে সিংহাসনের মতো আসনে বসে ভ্রমণ করতে। চেনাশোনা লোক দেখলে হাসাহাসি করবে ভেবেই নিরস্ত হয়েছি।

“নেহি সাহাব। অত দূরে আর থাকি না এখন। ও এলাকা ছেড়ে দিতে হয়েছে।”

“কেন, কোনও অসুবিধে?”

“না মালিক। সেই তিরিশ-চল্লিশ বছর আগে চাচাদের আমলে রাস্তাঘাটে ভিড় তেমন ছিল না। এই ‘মডান’ আমলের সরকারি ‘লাইসেনে’র ঝামেলাও ছিল না।”

শ্যুটিং ইউনিটের চা-ওয়ালা আমাদের চা দিয়ে গেল রুটিনমাফিক। চায়ে দু’বার ফুঁ দিয়ে চুমুক দিল আলম। আরামের মস্ত ‘আহহ্’ করে আরও বললে, “ঘাড়ে-পায়ে ঘা নিয়ে, খুব কষ্ট পেয়ে সিরাজুর ইন্তেকাল হল চোখের সামনে।’’

একটু থেমে, আমার জিজ্ঞাসু মুখের দিকে চেয়ে, সঙ্গে সঙ্গে বিশদ করলে, “সিরাজু মানে আমাদের আগের ঘোড়া। ওর পরে পরেই চাচা ‘আল্লাকে পেয়ারে’ হয়ে গেল। তখন দুই চাচেরা ভাই-বহিন অউর চাচিকে সামলাতে হল। এই সব ঝামেলায় আর ‘লাইসেন’ করা হল না।”

বুঝলুম। ‘পশুপক্ষী সংরক্ষণ সমিতি’র লোকেরা পুলিশ ও মিউনিসিলিটি কর্পোরেশনের লোক নিয়ে এসে ওদের উচ্ছেদ করেছে দক্ষিণ মুম্বইয়ের জনবহুল রাস্তা থেকে।

“ইসি লিয়ে হাম দশ-বারো ঘোড়েওয়ালা ইধার চলে আয়ে।”

এ ধারে মানে শহরতলির উত্তরে আন্ধেরি, জুহু, ভারসোবা, লোখণ্ডওয়ালায় ছড়িয়ে রয়েছে। আলম আর জনা চারেক সাথি থাকে চারবাংলার বস্তিতে। গায়েই ঘোড়াদের জন্য সাময়িক আস্তাবল। সকাল-বিকেল জুহুর সৈকতে যায়। মাইলখানেকের বেশি লম্বা টানা বালিতে মোড়া ‘জুহু সি বিচ’। নানান মুখরোচক চুরন-চাটনির স্টলে দোবেলা ভিড় লেগেই থাকে। ফুচকা, মুড়ি, কুলফি, আইসক্রিম, ইডলি-দোসা, শিঙাড়া-কচুরি। সবই রাস্তার ধারে, সৈকতের শুরুতে। ঢালু বালির বেশ প্রশস্ত জমি সমুদ্র ছুঁয়ে। সামনে জল, শুধু জল। দু’পাশে বিস্তীর্ণ বালির আস্তরণ।

এই জায়গায় জল ছুঁয়ে যে বিশাল বালুকাবেলা, সেই জমিতে সাবধানে যায় ভ্রমণবিলাসীরা। শিশু-বালক-ফিরিওয়ালারা। কারণ, ঘোড়া, ঘোড়ায় টানা রথ, দু’তিনটি উট দৌড়য় সওয়ারিদের নিয়ে। বেশির ভাগই শিশু-বালক। ঘোড়ার পিঠে, উটের পিঠে চড়ার রোমাঞ্চের জন্যই। সহিসরা ঘোড়ার লাগাম ধরে সঙ্গে সঙ্গে দৌড়য়। সওয়ারিদের নিরাপত্তার দায়িত্ব আছে না!

আলমও সেখানে শিশু-বালকদের ‘ঘোড়সওয়ার’ হবার রোমাঞ্চ-উত্তেজনার সোয়াদ দেয়। ছুটির দিনে, অলস দুপুরে আলম অলিগলিতে ঘুরে ঘুরে ‘ঘোড়েওয়ালা’ হাঁক দেয়। সঙ্গে রাবিয়ার গলার ঘুন্টি নাড়ে। অনেকটা কলকাতার সেই ‘শিল কাটাও’ বা ‘চাবিওয়ালা’র মতো ঝমঝম। স্রেফ শান্ত শহরতলির অলিগলিতে। আলমকে নয়, অন্য কোনও ঘোড়াওয়ালাকে আমাদের গলিতেও দেখেছি।

স্টুডিওর ভেতরেই সদর রাস্তায় শ্যুটিং চলছে। ডাক পড়ল আলমের। উঠে দৌড়তে দৌড়তে ওদিকে গেল ঘোড়াওয়ালা। আমিও গেলুম পেছনে পেছনে। আলমের ঘোড়া, মানে ঘোড়িকে দেখলুম। রুগ্ণ, জীর্ণ চেহারার একটি চতুষ্পদ। ওদের চোখ দেখে তো বোঝা যায় না। তবে বেশ ক্লান্ত মনে হল। তারই গায়ে বেশ রংবেরঙের ঝলমলে ও রঙিন সাজপোশাক চড়ানো হয়েছে। বিয়ের বরকে পিঠে করে বিবাহবাসর অবধি নিয়ে আসবে। সারা উৎসবের দৃশ্যে আলম বা ওর রাবিয়াকে কেমন বেমানান মনে হল।

ডিরেক্টর জ্যোতি’র ‘টেকিং-অ্যাকশন’-এর সঙ্গে সঙ্গে ঝলমলে পোশাকের ব্যান্ডপার্টির প্যাঁ-পোঁ-ধুম-দুম বাদ্যিবাজনা শুরু হয়ে গেল। ঘোড়ির পিঠে বর বসে। সঙ্গে বরযাত্রীর নাচানাচি। রাবিয়া প্রথমে বোধহয় চমকে উঠেছিল। তারপর স্বাভাবিক। যেন এ সবে অভ্যেস আছে। দৃশ্যের মধ্যে লোকজন তুমুল নাচছে। ফুর্তির জৌলুস দেখাচ্ছে। শুধু টোপর-পরা, গলায় মোটাসোটা ফুলের মালা নিয়েও বরকে এবং তার বাহন রাবিয়াকে একান্তই নির্লিপ্ত নির্বিকার বলে মনে হল।

পরের বছর মানে গেল বছর গ্রীষ্মে গেছি বেড়াতে। মহারাষ্ট্রের হিল স্টেশন মহাবালেশ্বরে। মুম্বই থেকে আরামদায়ক লাক্সারি বাসে এক রাতের জার্নি। দার্জিলিঙের মতো না হলেও বেশ ঠান্ডা আছে। বিকেলের পর তাপমাত্রা ৮-১০ ডিগ্রির নীচে নেমে যায়। বিকেলে বেরিয়েছি ছোট পাহাড়, উপত্যকা দেখতে টাউনের একেবারে প্রান্তসীমায়। সানসেট পয়েন্ট। এখান থেকে সূর্যাস্ত দেখা নাকি দারুণ। চারপাশে পাহাড়-ঘেরা এই টাউন। সামনে অনেক নীচে উপত্যকার ঢল।

এখানেও দেখি, অনেক বালক-বালিকা-শিশু ঘোড়ার পিঠে চড়ে ঘুরছে। আলমের কথাই ভাবছিলুম। ওমা! সত্যি সত্যি দেখি, একটা ঝুপড়ি গাছের ছায়ায় রাবিয়ার কাছে আলমই দাঁড়িয়ে আছে। একটু এগিয়ে যেতেই চিনতে পারল আলম আলি।—সালাম সাহাব!

ঝুঁকে পড়েছে একটু। দু’বছরেই বেশ বয়েস বেড়ে গেছে ওর। রাবিয়াকে দেখলুম খুব ক্লান্ত। আরও রুগ্ণ, জীর্ণ। পাঁজরার হাড় বেরিয়ে পড়েছে। এমন ক্লান্তিকর জীবনের বিরুদ্ধে ‘জেহাদ’ জানাতে। ওর হতোদ্যম শরীরের ওপরে কোনও ‘খদ্দের’ নেই। অন্তত এখন নেই। কাছে গিয়ে গায়ে হাত বোলালুম। নাক দিয়ে একটা ঘড়ঘড় আওয়াজ করল। জুহুর স্টল, জন্তুজানোয়ার পুলিশ সব খেদিয়ে দিয়েছে। বলেছে, ‘বেআইনি’।

আলম বললে, ‘‘এক ভি সওয়ারি নেহি মিলা। যত সূর্য ঢলে পড়ছে ততই হতাশ হচ্ছি সাহাব। দানাপানি কোত্থেকে জুটবে?” রাবিয়ার চোখের কোলে সাদা পিঁচুটি। জলও দেখলুম যেন। আর দেখলুম, হা-ক্লান্তিতে বুঝি এখন হাল ছাড়ার ইচ্ছে। কে জানে আলম একদিকে চাইছে সূর্য আরও সময় টিকে থাকুক। হয়তো ভাড়া জুটবে। অন্য দিকে হয়তো অবলা রাবিয়া চাইছে সূর্য ডুবুক। আমি একটু শোব। বড় ক্লান্ত। ঘুমাব।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE