সাংবাদিকদের মুখোমুখি বিনোদ জুৎসি। —নিজস্ব চিত্র।
লোকসভা নির্বাচনের প্রচারপর্বে যে সব অভিযোগ উঠছে, তার নিষ্পত্তির জন্য প্রশাসন অনেক ক্ষেত্রেই যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে উষ্মা প্রকাশ করলেন উপ-নির্বাচন কমিশনার বিনোদ জুৎসি। কংগ্রেস সহ-সভাপতি রাহুল গাঁধীকে পার্ক সার্কাস ময়দানে কর্মিসভা করতে না-দেওয়া, বীরভূমের তৃণমূল নেতা অনুব্রত মণ্ডল বা সিপিএমের আনিসুর রহমানের কটূক্তি সম্পর্কে যথাযথ ব্যবস্থা না-নেওয়া, অথবা আসানসোলের বিজেপি প্রার্থী বাবুল সুপ্রিয়কে ঘর ভাড়া দিতে চাওয়ায় হোটেল মালিককে পুলিশের হুমকির প্রসঙ্গ তুলে বিভিন্ন জেলার পুলিশ ও প্রশাসনিক কর্তাদের কৈফিয়ৎ তলব করেন তিনি। এ সবের যাতে পুনরাবৃত্তি না হয়, সে ব্যাপারে জেলাশাসক এবং এসপি-দের সতর্কও করে দেন জুৎসি।
পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনের প্রস্তুতিপর্ব খতিয়ে দেখতে এক দিনের সফরে মঙ্গলবার কলকাতায় এসেছিলেন উপ-নির্বাচন কমিশনার। প্রথমে রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি এবং পরে জেলা প্রশাসনের কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। সূত্রের খবর, একের পর এক অভিযোগ নিয়ে প্রশ্ন তুলে প্রশাসনিক কর্তাদের অস্বস্তিতে ফেলে দেন জুৎসি।
জুৎসির সঙ্গে বৈঠকে বিরোধীরা রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকের (সিইও) দফতরের ভূমিকা নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বাম, কংগ্রেস এবং বিজেপি নেতারা একযোগে অভিযোগ করেন, সিইও-র দফতরে বারবার অভিযোগ জানিয়েও কোনও কিনারা হচ্ছে না। বামেরা যেমন বলেন, সিইও-র দফতরে খোদ মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ২৭টি অভিযোগ দায়ের করে একটিরও সুরাহা মেলেনি। সিপিএম নেতা রবীন দেব পরে বলেন, “সিইও-র দফতর থেকে আমাদের বলা হয়, অভিযোগ দিল্লিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে! কিন্তু সিইও-র দফতরেরও যে কিছু ব্যবস্থা নেওয়ার এক্তিয়ার আছে, তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন জুৎসি।”
বিজেপি-র আবার অভিযোগ, আসানসোল কেন্দ্রে তাঁদের প্রার্থী বাবুল সুপ্রিয়র থাকার জন্য যে হোটেল বুক করা হয়েছিল, তার মালিককে আসানসোল উত্তর থানার ওসি হুমকি দেন। বুকিং শেষ পর্যন্ত বাতিল হয়নি ঠিকই। কিন্তু এই ঘটনা সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশের পরিপন্থী। দলের রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের কথায়, “আমরা সিইও-কে ঘটনাটা জানিয়েছিলাম। সিইও আমাদের চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলেন, মহকুমাশাসকের কাছে ঘটনার খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এখন জানলাম, কিছুই হয়নি!”
কংগ্রেসের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, কলকাতার পার্ক সার্কাস ময়দানে রাহুল গাঁধীর কর্মিসভা করতে অনুমতি পাওয়া যায়নি। পরে প্রশাসনিক বৈঠকে এই সব বিষয়ে পুলিশ-প্রশাসনের কর্তাদের কাছে জানতে চান জুৎসি। রাহুলের সভা প্রসঙ্গে কলকাতা পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার জানান, ওই মাঠটি কলকাতা পুরসভার। তারা অনুমতি না দেওয়ায় পুলিশও অনুমতি দেয়নি। জুৎসি তাঁকে বলেন, কর্মিসভা বা জনসভার জন্য মাঠ দেওয়া নিয়ে যেন কোনও পক্ষপাতিত্ব না হয়। এক দল পেল, আর এক দল পেল না তা যেন না হয়।
বিজেপি-র অভিযোগ প্রসঙ্গে আসানসোলের পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েলের কাছে জবাবদিহি চান জুৎসি। এমন ঘটনা যেন আর না ঘটে তা-ও দেখতে বলেন।
বীরভূমের জেলাশাসক জগদীশপ্রসাদ মিনা এবং পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়ার কাছে জুৎসি জানতে চান, আনিসুর রহমান ও অনুব্রত মণ্ডল বিরোধীদের উদ্দেশে যে ধরনের বক্তব্য রেখেছেন সে ব্যাপারে কেন কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি? দুই কর্তাই তাঁকে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন।
জুৎসির সমালোচনা থেকে রেহাই পাননি নদিয়ার পুলিশ সুপার সব্যসাচীরমন মিশ্রও। সূত্রের খবর, তাঁকে রীতিমতো ধমক দিয়ে উপ-নির্বাচন কমিশনার বলেন, ওই জেলায় থানাস্তরে কোনও অভিযোগ নেওয়া হচ্ছে না বলে খবর আসছে।
থানাগুলিকেই নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে তাঁর পুলিশ সুপার পদে থেকে লাভ কী, সেই প্রশ্নও তোলেন জুৎসি।
উত্তর ২৪ পরগনা এবং কোচবিহারের জেলাশাসক ও পুলিশ সুপারকেও সতর্ক করেন উপ-নির্বাচন কমিশনার। এই দু’টি জেলা থেকে নির্বাচনী বিধিভঙ্গের বেশ কিছু অভিযোগ জমা পড়েছে। কিন্তু তা নিয়ে পুলিশ-প্রশাসন বিশেষ হেলদোল দেখায়নি বলে কমিশনের কাছে খবর।
মুশির্দাবাদের ডিএম ও এসপি-র কাছ থেকে জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির খবর নিতে গিয়ে জুৎসি জানান, ভোটের আগে তিনি ওই জেলায় গিয়ে এক রাত কাটাবেন। সল্টলেকের পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমার বৈঠকে না-থাকায় উষ্মা প্রকাশ করে উপ-নির্বাচন কমিশনার। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের জুৎসি বলেন, “কোথায় কী হচ্ছে, তার উপর কড়া নজর রেখেছে কমিশন। আচরণবিধি লঙ্ঘন করা বা তা জানার পরেও মদত দেওয়ার অভিযোগ উঠলে কমিশন কঠোর ব্যবস্থা নেবে।” এ বার থেকে কোনও অভিযোগ এলে তা ফেলে রাখা যাবে না বলে জেলা প্রশাসনকে জানিয়ে দিয়েছেন জুৎসি। তাঁর কথায়, “জেলা নির্বাচন আধিকারিক হিসাবে ডিএম-দের সবার আগে ব্যবস্থা নিয়ে তার পর কমিশনকে জানানোর কথা। নেহাৎই ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে তাঁরা কমিশনের মতামত চাইতে পারেন।”
এ দিন জুৎসির সঙ্গে দেখা করে পর্যাপ্ত আধা-সামরিক বাহিনী মোতায়েন করার দাবি জানিয়েছে সব ক’টি রাজনৈতিক দল। এই সূত্রেই সিইও-র মনোভাব নিয়ে জুৎসির কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে কংগ্রেস। দলের বিধায়ক মানস ভুঁইয়া বলেন, “সিইও বলছেন, প্রয়োজনীয় কেন্দ্রীয় বাহিনী না-ও পাওয়া যেতে পারে। এতে তো রাজনৈতিক দল এবং সাধারণ মানুষের ভরসা হারিয়ে যাচ্ছে!”
জুৎসি অবশ্য আশ্বাস দিয়েছেন, “সন্ত্রাসে বা ভয় পেয়ে কেউ ভোট দিতে পারলেন না, এমন পরিস্থিতি এ বার লোকসভা ভোটে থাকবে না। ভোটের ১০ দিন আগে থেকেই কেন্দ্রীয় বাহিনী সংশ্লিষ্ট এলাকায় টহল দেবে।” কলকাতার দু’টি আসনের জন্য ৫০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী দেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
সাত সিদ্ধান্ত
• ২২%-২৫% বুথ অতি স্পর্শকাতর কিংবা স্পর্শকাতর
• ২০০৯-এর তুলনায় অনেক বেশি কেন্দ্রীয় বাহিনী লাগবে
• ভোটের সাত দিন আগে কেন্দ্রীয় বাহিনীর টহল
• নির্বাচনী বিধিভঙ্গে দ্রুত তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবেন ডিএম
• ভিডিও বা সংবাদমাধ্যমের খবর দেখেও তদন্ত
• ভোটের দিন সাত-আট কেন্দ্রে ঘুরবেন দুই সেক্টর অফিসার
• বুথের ভিতরের ছবি দেওয়া হবে ইন্টারনেটে
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy