ভুলে যাওয়ার লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার আগে ছোট ছোট অনেক উপসর্গ দেখা দিতে থাকে। ছবি: সংগৃহীত।
ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিনাশ মানে কি শুধুই ভুলে যাওয়া? শুরুটা কিন্তু সকলের এক রকম হয় না। মনোবিদেরা বলেন, ডিমেনশিয়া হল বিশাল একটা ছাতার মতো। এর নীচে আশ্রয় নেয় মনের আরও অনেক অসুখ। কোনওটা ভুলে যাওয়ার রোগ, কোনও ক্ষেত্রে ব্যবহারে হঠাৎ বদল, কারও আবার প্রচণ্ড আগ্রাসী মনোভাব। স্মৃতিনাশের মতো ভয়ঙ্কর মানসিক ব্যধি একা আসে না, আরও নানা অসুখকে সঙ্গী করে আসে। তাই ডিমেনশিয়া তলে তলে বাসা বাঁধছে কি না, তার লক্ষণ শুধু ভুলে যাওয়া থেকে নয়, আরও বিভিন্ন রকম উপসর্গ থেকেও জানা যেতে পারে।
মায়ের যে স্মৃতিনাশ হতে শুরু করেছে তা বুঝতে পারেননি উচ্চপদস্থ সরকারি চাকুরে বিশ্বজিৎ দাস। তিনি জানাচ্ছেন, শুরুতে তাঁর মায়ের খবরের কাগজ পড়তে সমস্যা হত। প্রতিটা বাক্য পর পর পড়তে পারতেন না। একটা সময় গুছিয়ে লিখতে পারতেন, পরে সেটাও আর সম্ভব হত না। একদিন শোয়ার ঘর আর রান্নাঘর গুলিয়ে ফেললেন। পরে দেখা গেল, একই ভুল রোজ করছেন। রাস্তায় বেরোলে অলিগলি গুলিয়ে ফেলতেন। নিজের বাড়ির পথও মনে করতে পারলেন না একদিন। ঠায় এক দিকে তাকিয়ে থাকতেন, কথাবার্তাও অসংলগ্ন হতে শুরু করেছিল। তার পর ভুলতে শুরু করেন একে একে সব কিছু। শেষে নিজের ছেলেকে চিনতেও পারতেন না। বাড়িতে অতিথি এলে রেগে গিয়ে চিৎকার শুরু করতেন।
ডিমেনশিয়ায় ভুলে যাওয়ার লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার আগে আরও ছোট ছোট উপসর্গ দেখা দিতে থাকে, এমনটাই জানালেন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট অনিন্দিতা মুখোপাধ্যায়। যেমন, কোনও লেখা পড়ে বুঝতে এবং লিখতে সমস্যা শুরু হয়। হয়তো দেখা যাবে, রোগী অক্ষর, শব্দ, বাক্য তৈরি করতে পারছেন না। নম্বর বুঝতে সমস্যা হচ্ছে। পর পর বাক্য লিখতে গেলেই সব তালগোল পাকিয়ে ফেলছেন। যা লিখছেন, তার মানে দাঁড়াচ্ছে না। কোনও কিছু ভাষায় প্রকাশ করতে গেলেও সমস্যা হচ্ছে। গুছিয়ে কথা বলতে পারছেন না।
ডিমেনশিয়ার রোগীর আচার-ব্যবহারে অনেক বদল আসে। অনিন্দিতা জানাচ্ছেন, হয়তো দেখা যাবে, লোকজনের সামনে আসতে চাইছেন না। অথবা এলেও সঠিক ব্যবহার করছেন না। প্রচণ্ড রাগ, জেদ, মেজাজ দেখাচ্ছেন। লোকজনকে খারাপ কথা বলছেন, হঠাৎ করে গায়ে হাত তুলতেও দেখা গিয়েছে অনেক ডিমেনশিয়ার রোগীকে।
অকারণ সন্দেহ, আপনজনেদের শত্রু মনে করা, আগ্রাসী মনোভাবও ডিমেনশিয়ার পূর্বলক্ষণ হতে পারে। এমনটাই জানাচ্ছেন মনোরোগ চিকিৎসক শর্মিলা সরকার। শর্মিলার কথায়, ডিমেনশিয়ার অনেক রোগীর মধ্যেই প্রচণ্ড যৌন উত্তেজনা লক্ষ করা গিয়েছে। হয়তো তাঁরা আগে এমন ছিলেন না। ব্যবহার ও আচরণে এমন বদল হঠাৎ করেই এসেছে। এমন অনেক ডিমেনশিয়ার রোগীকে পরিচিত মানুষজনের সামনেই অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করতে দেখা গিয়েছে। খারাপ স্পর্শ, খারাপ ইঙ্গিত করতেও দেখা গিয়েছে। এমনও দেখা গিয়েছে, পোশাক ঠিকমতো না পরেই তাঁরা লোকজনের সামনে চলে এসেছেন। কথাবার্তাও অসংলগ্ন। যখন-তখন মেজাজ হারিয়ে ফেলছেন। ব্যবহারের এমন বদলকে ডিমেনশিয়ার লক্ষণ বলে ধরতেই পারেননি তাঁদের পরিবারের লোকজন। ফলে রোগ যখন ধরা পড়েছে, তখন হয়তো স্মৃতির ভাঁড়ার অনেকটাই খালি হয়ে গিয়েছে।
স্মৃতিনাশের দু’টি প্রধান পর্যায় রয়েছে। তার মধ্যে একটি অ্যালঝাইমার্স। যেখানে রোগী সব কিছু ভুলতে শুরু করেন। আর দ্বিতীয়টি হল ‘ভাসকুলার ডিমেনশিয়া’। এই পর্বে রোগীর আচার-আচরণ বদলে যেতে শুরু করে। হয়তো দেখবেন, কোনও একটা কাজে মন বসাতে পারছেন না। এমন লক্ষণ দিনের পর দিন দেখা যাচ্ছে। নিজে থেকে কিছু ভাবতে বা সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। কথা বুঝতে সমস্যা হচ্ছে। অনেকগুলো কাজ দিলে কোনওটাই করে উঠতে পারছেন না। সেই সঙ্গেই ব্যবহারে বদল আসবে। অতিরিক্ত উদ্বেগ, উৎকণ্ঠায় ভুগতে শুরু করবেন রোগী। সকলের থেকে আলাদা হয়ে একা থাকার চেষ্টা করবেন। দৃষ্টিবিভ্রমও দেখা দিতে পারে। রোগী কাল্পনিক কিছু দেখতে বা শুনতে শুরু করবেন। রোগীর মনে হবে, অচেনা কোনও শব্দ বা কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে। এক বা একাধিক মানুষ তাঁকে নিয়ে সারা ক্ষণ কথা বলছেন বা সমালোচনা করে চলেছেন। অথবা কেউ এমন আছেন যিনি সারা ক্ষণ তাঁর সঙ্গে কথা বলছেন। এ সবও ডিমেনশিয়ার পূর্বলক্ষণ।
আসলে মস্তিষ্কের বিশ্রাম নেই মানুষের। এর একটি কারণ হিসাবে অনেকেই সাম্প্রতিক পৃথিবীতে ‘ইনফরমেশন ওভারলোড’-এর সমস্যাকে দায়ী করেন। তাঁদের মতে, এখন এত কিছু মনে রাখতে হয় যে, অনেক সময়ই মানুষ খেই হারিয়ে ফেলে। তার উপর আছে প্রচণ্ড মানসিক চাপ। মনোরোগ চিকিৎসকেরা বলছেন, মানুষ একই সময়ে একাধিক কাজ করার চেষ্টা করছে। একে বলে ‘মাল্টিটাস্কিং’, যা মস্তিষ্কের ক্ষতি করছে। মস্তিষ্ক একটা সময় একটাই কাজ করতে পারে। স্নায়ুর মধ্যে দিয়ে বার্তা পৌঁছয় মস্তিষ্কে। এখন সেকেন্ডের তফাতে যদি কাজের ধরন বদলে যায়, চোখ আর কানকে ভিন্ন ভিন্ন কাজে ব্যস্ত রাখা হয়, তা হলে কোন বার্তা আগে মস্তিষ্কে পৌঁছবে, সেটা ঠিক করতে পারে না স্নায়ুতন্ত্র। যার ফলে মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কাজ করার ক্ষমতা লোপ পেতে থাকে। অপ্রয়োজনীয় তথ্যের মধ্যে থেকে মস্তিষ্ক সঠিক তথ্য বাছাই করে ছেঁকে নিতে পারে না। তখনই চিন্তাভাবনা গুলিয়ে যায়, মানুষ ভুলতে শুরু করে। সদ্য ঘটা ঘটনাও স্মৃতি থেকে হারিয়ে যেতে শুরু করে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy