উন্মুক্ত খেলার মাঠ, গাছে ভরা পার্কের অভাবে, অধিকাংশ শহুরে বাচ্চারা আজ বড্ড যন্ত্রনির্ভর। মোবাইল গেমে আসক্ত। ওদের অনেকেই হয়তো জানে না কী ভাবে চারা থেকে গাছ হয়, কী ভাবে ফুল ফোটে, ফল ধরে। অথচ একটি শিশুর জীবনে প্রকৃতির স্পর্শ জরুরি। বিষয়টি নিয়ে মনোবিদ জলি লাহা বললেন, ‘‘গাছের সঙ্গে শিশুদের একটা সখ্য তৈরি হয়। দেখবেন, শিশুরা গাছের ফুল-পাতা নিয়ে খেলা করে, পুতুলকে সাজায়, রান্না করে। গাছ-ফুল-পাতা ওদের আকর্ষণ করে। একটা কল্পনার জগৎ তৈরি করতে, গঠনমূলক কাজ করতে সাহায্য করে। অভিভাবকেরা যদি বাগান পরিচর্যার কাজ ওদের শেখান, যেমন স্কুল থেকে এসে গাছে জল দেওয়া, শুকনো পাতা কেটে ফেলা ইত্যাদি... দেখবেন ওদের মধ্যে দায়িত্ববোধ বাড়বে। ওদের হাতের স্পর্শে একটা গাছ বাড়লে, ফুল ফুটলে ওরা যেমন আনন্দ পায়, নিজের হাতে কিছু করার আত্মবিশ্বাস বাড়ে। আত্মসম্মান তৈরি হয়, মনঃসংযোগ বাড়ে, ধৈর্য ধরতে শেখে, কারণ গাছপালা বড় হতে সময় নেয়। মাটি খোঁড়া, জল দেওয়া ইত্যাদিতে শারীরচর্চাও হয়। এ ছাড়া প্রকৃতি সম্পর্কেও জ্ঞান বাড়বে, প্রকৃতিকে ভালবাসতে শিখবে।’’
ছোটরা কি পারে বাগানপরিচর্যা করতে?
অনেকেরই মনে হতে পারে, এই পরিশ্রমের কাজ কি ছোটরা পারবে? গাছ নষ্ট করে ফেলবে না তো? এই প্রসঙ্গে হর্টিকালচারিস্ট পলাশ সাঁতরা বললেন, “প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলির জন্য সরকারের একটি প্রকল্প আছে, তার নাম নিউট্রিশনাল গার্ডেনিং ইন স্কুল। এই প্রকল্প অনুয়ায়ী স্কুলের মিড ডে মিলের খাবার স্কুলের বাগান থেকেই আসে। সেখানে ফুলকপি, বাঁধাকপি, পালং শাক, কলমি শাক, মুলোর মতো নানা আনাজ হয়। বাগান পরিচর্যায় বাচ্চাদের শামিল করা হয়। টিফিন খাওয়ার পরে তারা ভাত-তরকারির অবশিষ্টাংশ ফেলে একটা জায়গায়। সে সব জমে জৈব সার হলে তা ব্যবহার করা হবে গাছে। এ ভাবে একটা সার্কল তৈরি হয়, যা বাচ্চারা শেখে। সুতরাং বাচ্চাদের শেখালে তারা সেটা করবে। কিন্তু শহরের অধিকাংশ স্কুলে সে সুযোগ নেই। তাই বাড়িতেই অভিভাবকেরা ছোট ছোট টবে গাছ রোপণ ও তার পরিচর্যা শেখাতে পারেন। সবচেয়ে ভাল হয় ছোলা বা মটর ভিজিয়ে অঙ্কুরোদ্গম হওয়া থেকে গাছ পর্যন্ত দেখানো। তা হলে বীজ থেকে কী ভাবে গাছ হয়, সে সম্পর্কে ধারণা হবে।’’
অভিভাবকদের দায়িত্ব
বাগান করার সময়ে সঙ্গে নিন আপনার সন্তানকে বা বাড়ির ছোট সদস্যদের। তাদের হাতে ধরে শেখান বীজ বা চারা রোপণ, গাছে জল দেওয়া, শুকনো পাতা-ফুল ফেলে দেওয়া, সার দেওয়া, পাতায় জল স্প্রে করা। এমন হতেই পারে অতি উৎসাহে বাচ্চাটি গাছে বেশি জল দিয়ে দিল বা মাটি কুপিয়ে ফেলল। তাকে বকুনি না দিয়ে বোঝাতে হবে। যেমন বাচ্চাটি একসঙ্গে বেশি জল খেতে পারবে না, তেমন গাছও পারবে না অতিরিক্ত জল শোষণ করতে। বাচ্চাটির বড় হওয়ার সঙ্গে গাছের বড় হওয়ার সাদৃশ্য তাকে বোঝাতে হবে। তার মতো গাছও ছোট থেকে বড় হবে।
তবে সব বাচ্চার শেখা এক রকম হবে না। অনেকে বড়দের কথামতো গাছে সার-জল দেবে, শুকনো পাতা কেটে দেবে। আর এক দল তার রোপণ করা গাছ কাউকে ধরতেই দেবে না। গাছ ঠিক যেন তার প্রিয় খেলনা। এতে বাচ্চাদের বকুনি দেবেন না। তা হলে ওরা উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে। বরং সম্ভব হলে তাদের জন্য একটা ছোট্ট কোণ বরাদ্দ করুন। ছাদবাগান বা বারান্দা বাগানে কয়েকটি ছোট টবে গাছ সাজিয়ে তাদের দায়িত্ব দিন দেখভালের। বাড়ির লাগোয়া জমিতে বাগান থাকলে বেড়া দিয়ে একটা অংশ ভাগ করে দিন। সেখানে লোহার ভারী কোদাল, খুরপি ইত্যাদি বাগানের সরঞ্জামের পরিবর্তে দিন ফাইবার বা প্লাস্টিকের রঙিন, হালকা, ধারহীন সরঞ্জাম, জল দেওয়ার জন্য রঙিন ছোট ঝাড়ি। টবগুলো হোক রঙিন বা কারুকাজ করা। তাদের ছোট টবে করতে পারেন তুলসী, স্ট্রবেরি, টম্যাটো। নয়নতারা, গাঁদা বা পাতাবাহারও করতে পারেন। তবে কাঁটাযুক্ত গাছ তাদের আওতার বাইরে রাখুন। বাগান করার সময়ে খেয়াল রাখুন তারা যেন মুখে হাত না দেয়। বাগানে মাটি ঘাঁটার পরে ভাল করে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া শেখাতে হবে। বাচ্চা থাকলে গাছে রাসায়নিক সার বা কীটনাশক ব্যবহার করবেন না। রোদে বাগানে কাজ করার সময়ে টুপি পরতে শেখান।
বাড়িতে গার্ডেনিং-এর পাশাপাশি আশপাশের অঞ্চলের গাছপালা, ফুল চিনতে শেখান। নার্সারিতে নিয়ে গিয়ে পছন্দের গাছ কিনে দিন। অনেক মা-বাবা পড়াশোনা ও খেলাধুলোর ক্ষেত্রে ছোট ছোট পুরস্কার দিয়ে তাঁদের সন্তানদের উৎসাহিত করেন। পুরস্কার হিসেবে চকলেট বা খেলনার বদলে গাছ কিনে দিন। বন্ধুদের মধ্যে গাছ উপহার দেওয়া শেখান। এতে পরিবেশ সচেতনতা তৈরি হবে, অকারণে গাছের পাতা, ফুল ছেঁড়া থেকে বিরত থাকবে ওরা। গাছের পাশাপাশি চিনতে শিখবে পাখি, প্রজাপ্রতি ও কীটপতঙ্গদের। ফলে প্রকৃতির সঙ্গে যোগসূত্র তৈরি হবে ওদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy