রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহজ পাঠ। সংগৃহীত ছবি।
'ছোটো খোকা বলে অ আ
শেখে নি সে কথা কওয়া।'
বালি রঙের মলাটের উপর লাল রঙের গাছ। মাথার উপর ছাড়া হরফে লেখা 'স হ জ পা ঠ'। মলাটের শব্দ-বর্ণের খেলা থেকেই শুরু হয়ে যায় শিক্ষার্থীর বর্ণ চেনার পাঠ। প্রচ্ছদ পাতার মাঝখানের গাছে যেন অচিন গাঁয়ের ছায়া। তার এক দিকে লেখা প্রথম ভাগ। অন্য দিকে গ্রন্থকারের নাম-- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
বাঙালির বর্ণ পরিচয়ের পালা সাঙ্গ হলে হাতে আসে এই বই। মলাট উল্টে ভিতরে চোখ রাখলেই উঁকি দেয় ছোট্ট এক খোকা। সাদা পাতায় কালো লিনোকাটের সেই খোকা মন কেড়ে নেয় পড়ুয়ার। শুধু কি আর খুদে পাঠকের? আসলে তো সব বয়সিরই! কালো ছবির জৌলুস আর সহজ পদের ছন্দ অজানা দুনিয়ার খোঁজ দেয়। বহু দূরের কোনও গাঁ, ফুল কুড়ানোর জীবন। ডাক দিয়ে যায় ছোট্ট এক নদী, তিল ক্ষেত, তিসি ক্ষেত, তালবন। তার টানেই হুড়মুড়িয়ে শেষ হয়ে যায় অ থেকে ঔ-এর পড়াশোনা। ছন্দ মিলের আনন্দে অতি দুষ্টু পড়ুয়ার মগজেও রয়ে যায় সহজপাঠের সহজ পড়া।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রথম পাঠের বই হিসাবে 'বর্ণপরিচয়' প্রকাশ করেন ১৮৫৫ সালে। তার ঠিক ৭৫ বছর পরে, ১৯৩০ সালে প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'সহজপাঠ'। ১৩৩৭ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে শান্তিনিকেতন প্রেস থেকে জগদানন্দ রায় কর্তৃক প্রকাশিত হয় এই গ্রন্থ। রবীন্দ্রনাথ সহজ ভাষায় ছন্দের আনন্দে নতুন করে বর্ণ পরিচয় করাতে চেয়েছিলেন শিশুদের। গুরুমশাইয়ের ছড়ি নয়, ছড়ার টানে শিশুর কাছে সহজ হবে অক্ষর চেনার পাঠ- এই ভাবনাই কাজ করেছিল এ বইয়ের নেপথ্যে।
আর পাঁচটা বাঙালি ছেলেমেয়ের মতোই শৈশবে বিদ্যাসাগরের 'বর্ণপরিচয়' দিয়েই জোড়াসাঁকোয় শুরু হয়েছিল শিশু রবীন্দ্রনাথের অক্ষর পরিচয়ের ক্লাস। বর্ণ চেনার সঙ্গে পেয়েছিলেন অন্তমিলের পাঠও। মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল 'জল পড়ে পাতা নড়ে'-র ছন্দ। তার দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবেই জন্ম নেয় 'সহজ পাঠ'।
বইয়ের প্রথম পাতায় লেখা ‘নন্দলাল বসু-কর্তৃক চিত্রভূষিত এই বই বর্ণপরিচয়ের পর পঠনীয়’। ১৮X১২ সেমি আকারের সহজ পাঠের প্রতিটি পাঠ কলাভবনের তৎকালীন অধ্যক্ষ নন্দলাল বসুর অলঙ্করণে সেজে উঠেছিল। ব্যবহার করা হয়েছিল লিনোকাট আর্ট। রবীন্দ্রনাথের সহজ লেখা ও শেখার ভাবনার সঙ্গে মিল রেখেই ছবি এঁকেছিলেন শান্তিনিকেতনের শিল্পাচার্য। হালকা হলুদ, ফিকে হলুদ রঙের উপরে গাঢ় সবুজ কিংবা নীলের প্রচ্ছদেও পাওয়া যায় এই বই। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ - এই চার ভাগে 'সহজ পাঠ'। তবে রবি-রচিত প্রথম দুই ভাগই সর্বাধিক জনপ্রিয়।
'সহজপাঠ'-এর প্রথম ভাগে শিক্ষার্থীরা ছড়া দিয়ে স্বরবর্ণ এবং ব্যঞ্জন বর্ণ চিনতে শুরু করে। ১১টি বাংলা স্বরবর্ণ এবং ৩৪টি ব্যঞ্জন বর্ণ রয়েছে। য়, ৎ, ড়, ঢ়, ং, ঃ, চন্দ্রবিন্দু বাদ পড়েছে 'সহজপাঠ' থেকে। আবার 'বর্ণপরিচয়'-এ বাদ পড়া ক্ষ-কে এ বইয়ে ফিরিয়ে এনেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
প্রথম ভাগে রয়েছে মোট ১০টি পাঠ। দ্বিতীয় ভাগে ১৩টি। পাতার সংখ্যা যথাক্রমে ৫৩ এবং ৫৬। নতুন পড়ুয়ারা বর্ণ পরিচয়, শব্দ গঠন, যুক্তবর্ণ, ভাবপ্রকাশের শিক্ষা পায়, সহজ পাঠ'-এর দুই ভাগে। শিশুকে মানবিক হয়ে উঠতে শেখায় এই বই, যার ছত্রে ছত্রে রবীন্দ্রনাথ খুদে পড়ুয়াদের দিতে চেয়েছিলেন জীবনের পাঠ। বাল্যশিক্ষার উষালগ্নেই প্রকৃতি এবং মানুষ সম্পর্কে শিশুর যাতে সহজ ভালবাসার বোধ গড়ে ওঠে, সেই চেষ্টাই তিনি করেছিলেন।
'সহজ পাঠ'-এর দ্বিতীয় ভাগ প্রকাশিত হয় একই বছরে। উচ্চারণের সুবিধার জন্য রবীন্দ্রনাথ এই বইয়ে বেশ কিছু যতি চিহ্নের ব্যবহার করেছেন। চির সংশয়ের কিছু বাংলা বানানের পাঠ তিনি বাঙালি শিশুদের একেবারে ছোটবেলায় প্রায় খেলার ছলেই শিখিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, যেমন- ‘কী’ আর ‘কি’-এর তফাৎ। সেই জায়গাতেও 'সহজপাঠ' শুধু আর ছোটবেলার পড়ায় আবদ্ধ নেই, হয়ে উঠেছে আট থেকে আশির।
এ বইয়ের পাতায় আটকে বাঙালির এক খণ্ড ছোটবেলা। জাতির শত বিবর্তনের ধারাতেও অম্লান যার গৌরব। বাংলা ভাষার বিপন্নতার দিনেও মায়ের মুখের ছড়ায়, ছোটবেলার স্মৃতির টানে অক্ষয় আয়ুতে বেঁচে থাকে সহজ পাঠের দিন। সোনার আখরে লেখা শিশুপাঠের এই বই বাঙালির জন্মদাগ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy