সনভ দক্ষিণ কলকাতায় থাকে। বিয়ে-থা আর করেনি। আসলে করেনি বলা ভুল, প্রেম করেছিল। ঋষভা এখন অর্কপ্রভের স্ত্রী। যখন প্রেম এসেছিল, তখন বছর বাইশের যুবক সে, ঋষভা কুড়ি। ছাড়াছাড়ি হল পাঁচ বছর পরে। সাতাশের সনভ আর পঁচিশের ঋষভা। সব দিক থেকেই ঋষভা সনভকে টেক্কা দিয়েছিল। প্রতিপত্তি,সামাজিক খ্যাতি— সবই ঋষভা পৈতৃক সূত্রে দুর্দমনীয় গতিতে পেয়েছিল। ভেবেছিল, সনভকে বদলাবে। বাবার মত নামী অধ্যাপক বানাবে। সনভ পড়াশুনায় মেধাবী হলেও তার ইচ্ছে ছিল জন্তু-জানোয়ারের ছবি তুলে তাক লাগাবে। ভবিষ্যৎহীন ছেলের প্রেমে পড়া যায়, তবে পথ চলাটা বিলাসিতা মনে করেই বিচ্ছেদ চায় ঋষভা। সনভ চাইলেও পারেনি।অবশ্য অধ্যাপক জোটেনি, জুটেছে পেশায় বিচারক অর্কপ্রভ সেন । এখন ঋষভা তারই ঘরনি।
সে দিন সকালে নিয়ম করেই খবরের কাগজে চোখ বোলাচ্ছিল ঋষভা। পেশায় সে আবার সাংবাদিক। দেশ-বিদেশের সব খবরেই চোখ রাখতে হয়। হঠাৎ এক ইংরেজি সংবাদপত্রে একটা রঙিন ছবিতে চোখ গেল। ছবিটা সনভের তোলা।ছবির বিষয় হল একটা গেটখোলা ত্রিনাথ মন্দিরে একটি সাদা-খয়েরি কুকুর ঢুকে ত্রিনাথদেবকে শুঁকছে আর চাটছে। ছবিটার নীচে সনভই লিখেছে, ‘‘দেবতার বাহনও ঈশ্বরের দেখা পেয়ে তার নিকটস্থ হয়ে তাকে চিনতে চেষ্টা করছে এমন সময় একজন লোক হ্যাইহুই করে তাকে তাড়িয়ে দেয়। অদ্ভুত ঘটনাটি হল, আশপাশে অনেকগুলো মন্দির থাকলেও সে তার প্রভুকেই চিনে গিয়েছিল।সস্তা মানুষ তাকে না চিনেই তাড়িয়ে দেয়!’’
যে দিন শেষ দেখা হয় সে দিন বিকেলে পড়ন্ত সূর্যের আলো গা চুঁইয়ে পড়লে ঋষভাই প্রথমে বলে, “সনভ, আমি দমবন্ধ বোধ করছি।মুক্তি চাই।’’ হাত ধরে সনভ কিছু বলতে চাইলেও পারেনি। ঋষভা বলে, “পারোনি বদল করতে নিজেকে।গত পাঁচটা বছর এমনি করেই কাটালে। ছবি তুলে কে নামডাক করবে এই মন্দার বাজারে, বলো তো? আসলে তোমার স্বপ্ন আছে, তাকে ছুঁতে তুমি জানো না। এই যে এই-ওই খবরের কাগজে তোমার তোলা ছবি বেরোয়, কী পাও তাতে? কেউ চিনছে তোমায়?” সনভ সে দিন আর একটাও কথা বলেনি। চুপ করে সে দিন সন্ধ্যা নামলে আকাশের গাঢ় নীল ছুঁয়ে বেরিয়ে আসে। তারও আগে বেরিয়ে গিয়েছে ঋষভা। পড়েছিল বিগত কয়েক বছরের কিছু ভাঙা ম্যাড়মেড়ে স্বপ্ন। পর দিন কেউ এসে দেখেনি, ভাঙা স্বপ্নকেও শিশির আর তার পরে আলো এসে ছোঁয়। সেই রাতেও নিয়নের আলো ছুঁয়েছিল।
ঋষভা খবরের কাগজ বন্ধ করে। তার আজ একটা প্রেজ়েন্টেশন আছে। বিষয়বস্তু, বন্যপ্রাণ বিলুপ্তি। সে আঁটসাঁট হয়েই এসেছে। সময় উপস্থিত হলে সে প্রেজ়েন্টেশন দিতে গেলে কাগজের সম্পাদক সবাইকে থামিয়ে বলেন, ‘‘সবাই একটু মন দিয়ে শোনো। আজ বিখ্যাত বন্যপ্রাণ চিত্রগ্রাহক সনভ দে আমাদের মধ্যে উপস্থিত আছেন। অনেকেই হয়তো জানো, ওঁর তোলা বন্যপ্রাণের ছবি দেশ-বিদেশে সুনাম কুড়িয়েছে।আর পাঁচজনের মত চাকরি না খুঁজে শখকে পেশা বানিয়েছেন। বহু দিন ধরে তাঁকে নিয়ে কিছু কাজ করার পরিকল্পনা ছিল বলেই এই বন্যপ্রাণ বিলুপ্তি বিষয়ে প্রেজ়েন্টেশন দিতে আমাদের সেরা সাংবাদিক ঋষভা দত্তকে ভার দিই। কেউই কিছু জানত না,ব্যক্তিগত ভাবে আমিও সাড়াশব্দ করিনি। আজ তাঁর তোলা একটা বিশেষ ছবি আর তাঁরই লেখা ছোট্ট কিছু কথা একটি নামী ইংরেজি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। আমি খুশি, উনি আমার ডাকে সাড়া দিয়ে আমাদের মাঝে এসে উপস্থিত হয়েছেন। আজকে এই বিষয়ের মূল্যায়ন ওঁর পক্ষেই ভাল ভাবে করা সম্ভব বলে আমি মনে করি।’’ সবটা বলার পরে সমস্ত কর্মী তাকে অভিবাদন জানাল। ঋষভা স্বপ্ন দেখছে। দীর্ঘ পাঁচ বছর পরে দেখা, অথচ অচেনা এই মানুষ। সনভ একই ভাবে সদাহাস্যময়।যেন কিছুই হয়নি কখনও!
প্রে়জ়েন্টেশন শেষ হল।অচেনা সনভ চেনা ঋষভাকে বাহবা দিল। সবাই করতালিতে ভরিয়ে তুলল। তাকে নিয়ে মেতে উঠল বাকি অনুরাগীরা। ছবি তোলার পর্ব শেষে সম্পাদক অরুণ বসুকে সে বলল, “কিছু যদি মনে না করেন, ঋষভাকে কিছু ব্যক্তিগত ভাবে বলতে চাই যাতে ওর ভবিষ্যতে কাজে লাগে। আমি সেই সুযোগ পেতে পারি?” অরুণবাবু অতি বিনয়ের সাথেই সম্মতি দিলেন, আর ঋষভাকে সনভের কথা শোনার জন্য অনুরোধ করলেন। ঋষভা না করল না। অফিসের পিছন দিক। একটা বাগান মতো আছে। সেখানে চেয়ার-টেবিল পাতা। ওরা বসল। সনভ বলল, “কেমন আছ?” ঋষভার রাগ মেশানো ভদ্র কন্ঠে ভেসে উঠল, “যেমন দেখছ ।” সনভ বুঝল, তাই দেরি না করেই বলে ফেলল, “যে ছবিটা আজ ছাপা হয়েছে তা সে দিনের, যে দিন আমরা ভেঙে নতুন কিছু গড়ার কথা বলে ছাড়াছাড়ি করলাম। তুমি তো চলে এসেছিলে আগেই। ফিরতে গিয়ে আমার হঠাৎই চোখ যায় ঐ দৃশ্যের দিকে। মোবাইলে ছবিটা তুলি আর তখনই এক জন এসে কুকুরটিকে তাড়িয়ে দেয়।অবাক লাগল, পাশে আরও দুটো কালী ও কৃষ্ণ মন্দির খোলা থাকলেও ত্রিনাথের কাছেই তাঁর বাহন ধরা দেয়। ঐ যে ছোট লেখাটা তখনই লিখেছিলাম আর নিজেকে প্রশ্ন করেছিলাম যে জগতে সবই তো সম্ভব। হয় না বলা মানেই তো নিজের দোষকে সামনে আনা। এত তো মন্দির ছিল, তবে কুকুরটা যদি তার প্রভুকে ঠিক চিনতে পারে, তা হলে আমি নয় কেন? এত দিন বন্ধ গেটের ও পারে কুকুরটা নিশ্চয়ই সেই কথা ভেবেই এক দিন ঠিক সুযোগ পায়। আমিও বন্ধ ভাগ্যের ও পারে বসে এই সুযোগই খুঁজেছিলাম, শুধু সাহসটাকে শখ করতে ভুলছিলাম। ছবিটা তখনই সোশ্যাল মাধ্যমের বন্যপ্রাণ ছবির পেজে দিই,লেখাটাও। তত ক্ষণে আমি তোমার কাছে ব্লক লিস্টেড হয়ে গিয়েছিলাম, তাই এ সব কিছুই জানো না। এর পর ঐ ছবির দৌলতে আজ আমি তোমার মুখোমুখি আর সবাই চেনে। হয়তো সে দিন ঐ মুহূর্তটাই সব বদলে দিয়ে গিয়েছিল।আসলে ছবিও যে কিছু শেখায়, সেটাই আমরা ভাবি না। বন্যপ্রাণ গভীর অরণ্যকে চেনায়,জানায়। অরণ্য তো আবার ছেলেদের নাম, আর বৃষ্টি তার প্রাণশক্তি জোগান দেয়। পৃথিবীর দূষণমুক্তি ঘটায় । অতএব প্রকৃতিও পুরুষ-নারীর মেলবন্ধন। আজ তুমি নেই ঠিকই, মনেও করি না তা-ও ঠিক, তবে আরও ভাল হওয়ার জেদটা সেই বিকেলের মুহূর্তগুলো চিনিয়ে যায়। প্রচ্ছন্ন ভাবে একটা পুরুষকে মানুষ করে গিয়েছ।” ঋষভা কিছু বলল না। আজও সেই বিকেলবেলা। গা চুঁইয়ে পড়ছে পড়ন্ত বেলার আলো। এ বারেও সেই ভেঙে যাওয়া স্বপ্নের কথা। শিশির পড়বে, কেউ দেখবে না।হয়তো বা ছোঁবে না নিয়নের আলোও।পুরুষরাও রাতের আলোকে পাশে রেখে বেড়ে ওঠে, বেড়ে ওঠে নিজের কাছেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy