ত্রুটি থাকলেও সবার ‘হায়দার’ দেখা উচিত
আজকাল দু’ধরনের ছবি হয়। এক: যেখানে রাজনীতি নেই। দুই: যেখানে রাজনীতিকে মশলা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সেগুলোর থেকে একদম বাইরে গিয়ে তৈরি হয়েছে ‘হায়দার’। ইদানীংকালে আমার দেখা সব চেয়ে জরুরি ছবি এটা। ছবিটি দেখে খুব উত্তেজিত হয়েছি আমি। ভারতবর্ষের এমন একটা রক্তগর্ভ অঞ্চলকে পটভূমি হিসেবে নেওয়াটা বিশাল ভরদ্বাজের মাস্টারস্ট্রোক। কাশ্মীরের মানুষ, তাঁদের সমস্যা, রাষ্ট্রের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক, জেহাদ—এই রকম জটিল রাজনৈতিক আবর্তে গল্পটা সাজানো। সেটা করা খুব কঠিন। তার সঙ্গে ছবিতে রয়েছে অসম্ভব ভাল অভিনয়। ইরফান, তব্বু অনবদ্য। বরং শাহিদ কপূর যে সুযোগটা পেয়েছিল সেটা আরও বেশি ব্যবহার করলে খুশি হতাম।
ছবির গোড়াতে ওফেলিয়ার চরিত্রটা যে ভাবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিল সেটা খুব সুন্দর। তার পর চরিত্রটা দুর্বল হতে থাকে। মূল শেক্সপিয়রে ওফেলিয়া একটু নরম। এখানে তা নয়। কিন্তু চরিত্রটা যে প্রত্যাশা তৈরি করেছিল তা শেষে মেটাতে পারেনি। গোটা ছবির বুনোটের মধ্যে ওই দুই সলমন খানের চরিত্র আমার বেমানান লেগেছে।
ছবির শেষের দিকে বিশাল একটু সাবধানী হয়ে পড়ে। অনেক রাষ্ট্রবিরোধী কথা বলার পর হঠাৎ বোধ হয় ওর মনে পড়ে এ বার ব্যালান্স করা দরকার। ‘হ্যামলেট’য়ের মূল গল্পটা তো তিন লাইনেরই বলা যায়। বাবাকে মেরেছে হ্যামলেটের কাকা। মায়ের সঙ্গে কাকার প্রেম। হ্যামলেটের প্রতিশোধ। এই প্রতিশোধ নেওয়ার ব্যাপারে একটা দোদুল্যমানতা ছিল হ্যামলেটের মধ্যে। এই জার্নিটা আরও বেশি করে এক্সপ্লোর করলে ভাল লাগত। শেষের বিষাদের সেই মুহূর্তটা মূল গল্প থেকে অনেকটা সরে আসে। তাতে ছবির বুনোটটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে এই সবের পরেও আমি বলব সবার ‘হায়দার’ দেখা উচিত।
মঞ্চে আমি পিটার ব্রুকসের ‘হ্যামলেট’ দেখেছি। ‘হায়দার’ দেখে মনে হল যে কোনও আন্তর্জাতিক কাজের মতোই এটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান চলচ্চিত্রের নিরিখে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছবি। আমি নিজে হিন্দিতে ‘হ্যামলেট’ করতে চাই। সেটা ‘হায়দার’য়ের থেকে অনেকটাই আলাদা হবে।
‘হায়দার’ দেখে ব্রাত্যর ‘হেমলাট’ মনে পড়ল
শেক্সপিয়ার নিয়ে বিশাল ভরদ্বাজ আগেও কাজ করেছেন। তবে ‘মকবুল’ আমার যতটা ভাল লেগেছিল, ‘ওমকারা’ অতটা লাগেনি। ‘হায়দার’ কতটা ‘হ্যামলেট’ হয়েছে তা আমি জানি না। কিন্তু ছবিটা আমাকে বিহ্বল করেছে। অনেকেই বলে থাকেন ক্লাসিকের এত উপাদান আছে যে ওটাতে জোর করে ইন্টারপ্রেট করা উচিত নয়। কিন্তু আমার বরাবরই ক্লাসিকের ইন্টারপ্রিটেশন ভাল লাগে। সেই কারণেই ব্রাত্য বসুর ‘হেমলাট: দ্য প্রিন্স অব গরানহাটা’
আমাকে খুব স্পর্শ করেছিল। সাম্প্রতিক কালে যে ক’টা নাটক ও লিখেছে, তার মধ্যে সব থেকে ইম্যাজিনেটিভ কাজ ওটাই। ‘হায়দার’ দেখে ‘হেমলাট’য়ের কথা মনে পড়ল। মনে হল সাম্প্রতিক কালে কাশ্মীর নিয়ে এ রকম একটা কাজ আমি দেখিনি। দেশপ্রেম নিয়ে একটা ‘মকারি’ করেছেন বিশাল। গণতন্ত্র বলুন, দেশপ্রেম বলুন— আজকাল সবটাই তো শক্তি দিয়েই আনা হয়। বিষয়টা খুব সুন্দর দেখিয়েছেন বিশাল। মনে পড়ছে সেই মার্কেট প্লেস-য়ের দৃশ্যটা। যেখানে শাহিদ হঠাৎ করে একটা দেশপ্রেমের গান গাইতে শুরু করে দেয়। ছবিতে ইডিপাস কমপ্লেক্সটা কী চমৎকার ভাবে ফুটিয়ে তুলেছে বিশাল। যেখানে মায়ের ঘাড়ে আতর লাগিয়ে দিচ্ছেন শাহিদ। কলকাতার স্টেজে ‘হ্যামলেট’ নিয়ে অনেক কাজ হয়েছে। আমি মনে করি বিভাসবাবুর ‘হ্যামলেট’ যথেষ্ট ভাল কাজ ছিল। প্রোডাকশনের থেকেও সুরজিতের অভিনয়টা নাটকটাকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল। অনেকগুলো ‘হ্যামলেট’ খুঁজে পেয়েছিলাম নাটকের মধ্যে। সেটা শাহিদ কপূরের অভিনয়ের মধ্যেও পেয়েছি। ‘হায়দার’য়ের গার্ট্রুড চরিত্রটা কী দারুণ! শেষের দিকে তো মনে হল যে তব্বু অভিনীত ওই চরিত্রটা শাহিদকেও ছাপিয়ে গিয়েছে।
‘হ্যামলেট’য়ের ‘টু বি অর নট টু বি’ সংলাপটা অন্য মাত্রা পেয়েছে এই ছবিতে। ব্যক্তি হ্যামলেটের দ্বন্দ্বটা ফুটে উঠেছে শাহিদের সঙ্গে শ্রদ্ধা কপূরের দৃশ্যে। অন্তঃজিজ্ঞাসাটা আরও বেশি দেখা গিয়েছে শেষ শটটায়। কোথায় যাচ্ছে শাহিদ? ও কি ভায়োলেন্সের দিকেই ফিরে যাচ্ছে? না কি জিন্দেগির দিকে যাচ্ছে? শট টেকিংয়ের মধ্যে এই প্রশ্নটা যে ভাবে বিশাল তুলে ধরেছেন, তা দেখে আমি মুগ্ধ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy