স্যান্টোসের ট্যাক্সি ড্রাইভার আর্মান্দোর মুখটা আমার মনে পড়ে গেল। আর্মান্দো ইংল্যান্ডে কয়েক বছর থেকেছে। ইংরেজিতে স্বচ্ছন্দ। আর আমাদের অবস্থা এখন খড়ের গাদায় সূচ খোঁজার মতো। আশেপাশে ইংরেজি-জানা কাউকে পেলে মনে হচ্ছে হারানো বন্ধু খুঁজে পেলাম। কত গল্প যে জমে আছে। আর্মান্দোর ট্যাক্সিতে বসে ওর সঙ্গে এই নিয়েই কথা হচ্ছিল। “জানেন আমাদের কোম্পানিকে কত বার বললাম ওয়ার্ল্ড কাপ আসছে। প্রতিটা ট্যাক্সি ড্রাইভারকে অন্তত কাজ চালানোর মতো ইংরেজি শিখতে বলুন। দরকার হলে আমি শেখাব। করছি করব বলে বিশ্বকাপই এসে গেল। কিছু হল না,” বেশ ক্ষোভের সুরে বলছিলেন স্যান্টোসের এই ট্যাক্সি ড্রাইভার।
অবশ্য ভুক্তভোগী আমরাই বোধহয় সব চেয়ে বেশি। বাকি ফুটবল বিশ্বটা আমার মনে হয় পর্তুগিজ আর স্প্যানিশের দখলে। লাতিন আমেরিকা তো বটেই। এমনকী ইউরোপেরও দুটো ফুটবল পাওয়ার হাউজ এই দুটো ভাষাতেই কথা বলে। সমস্যা শুধু আমাদেরই। আর সমস্যা বলে সমস্যা! হোটেলে চেক আউট করে বাসের অন্য একটা জায়গায় যাওয়ার কথা ছিল। হোটেল কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছিলাম প্রচুর লাগেজ নিয়ে একদিনের জন্য এত দূর ট্রাভেল করা কঠিন। লাগেজটা যদি ওঁদের লকার রুমে রাখা যায়। রাজিও হয়ে গেলেন ওঁরা। রাতের রিসেপশনিস্ট অন্য লোক। নাম বেটো। প্রচণ্ড হেল্পফুল। ওকে বললাম লকার রুম থেকে আমার ব্যাগটা একবার দেবে? হ্যান্ড লাগেজে একটা বই তুলতে ভুলে গিয়েছি। ও লাগেজটা দিল। আমি বইটা নিয়ে দু’য়েকটা কাজ সেরে ট্যাক্সিতে উঠলাম। পৌঁছে ভাড়া মেটাচ্ছি। দেখি ট্যাক্সি ড্রাইভার আমার সমস্ত লাগেজ নামাচ্ছেন। এগুলো এখানে কী করে এল! কে তুলল? ট্যাক্সি ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করাতে তিনি হাবেভাবে বুঝিয়ে দিলেন রিসেপশনিস্ট। কিন্তু এত মাল নিয়ে কী ভাবে ট্রাভেল করব? যেখানে এক দিনের জন্য যাচ্ছি এবং হোটেলেও চেক ইনের কোনও কারণ নেই। খাওয়ার পরিকল্পনা বাতিল করে হোটেলে ফিরলাম। পর দিন আবার রাতে এই বাস। এতটা সময় কী করব? সাতসকালে অন্য পরিকল্পনা ভাবতে হল। আবার বাসে চেপে পড়লাম। এ বার গন্তব্য মোজি দ্য ক্রুজ।
বাবার সঙ্গে ছোট্ট নেইমার।
ব্রাজিলে ভাষা নিয়ে এত সমস্যার মধ্যে যে কথাটা বলতেই হবে, তা হল এই দেশের মানুষের আন্তরিকতা। ভাষা নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। তবু শেষ অবধি ওঁরা চেষ্টা করে যাবেন। আপনি যদি কোনও সাহায্য চান, সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করবেন। ইংরেজি জানা মানুষজন সমস্যায় পড়েছে দেখলে নিজে এগিয়ে এসে সাহায্য করবেন। দোভাষীর ভূমিকা পালন করবেন। কোথায় যাবেন, কী করবেন সবটা বুঝিয়ে দেবেন। ব্রাজিলের রাস্তায় বেরোলেই নাকি সমস্ত কিছু লুট হয়ে যায় এটা যেমন বিজ্ঞাপিত হচ্ছে, ব্রাজিলিয়ানদের এই পরোপকারী দিকটাও সবার সামনে আসা উচিত। তবে পরোপকারে সবাইকে বোধ হয় ছাপিয়ে গেল অ্যান্টোনিও। মোজিতে যে হোটেলটায় উঠলাম, তারই মালিক অ্যান্টোনিও। চেক ইনের পর রিসেপশনিস্ট ছেলেটি সব প্রশ্নের উত্তরেই হাসে। আর হাবেভাবে জানায় মালিককে ডেকেছে। এবং মালিক ইংলিশ জানেন ভাল রকম। অ্যান্টোনিওর সঙ্গে সেখানেই আলাপ। আমার মোজি দ্য ক্রুজে আসার কারণ শুনে আরও চমৎকৃত। আমি যে নেইমারের ছোটবেলা খুঁজতে এসেছি শুনে তিনিই আশ্বস্ত করলেন। “চলো কাল আমি থাকব তোমার সঙ্গে,” বললেন অ্যান্টোনিও।
সাওপাওলোর ছোট্ট শৈল শহর মোজি দ্য ক্রুজ। বলা হয় ব্রাজিলের অন্যতম পুরনো শহর। এখনও পর্তুগিজ কলোনির ছোঁয়া রয়েছে শহরের আনাচে কানাচে। আর মোজিকে ঘিরে সোহা দোয়েতাপাচি পর্বতমালা। পাহাড়ের মাথায় জমে রয়েছে মেঘ। ঠিক এই পাহাড়ের নীচেই থাকতেন নেইমার। খুব ছোট্ট একটা অতি সাধারণ হাউজিং কমপ্লেক্স। ওই জায়গাটার নাম হোডেও। ফুটবল খেলে টাকাপয়সা জমিয়ে এখানেই একটা ফ্ল্যাট আর গাড়ি কিনেছিলেন নেইমার সিনিয়র। স্থানীয় ইউনিনিও (ইউনিয়ন) ক্লাবে খেলতেন নেইমারের বাবা। এলাকায় বেশ নামী সেন্টার ফরোয়ার্ড ছিলেন। মোজিতে যাঁর সঙ্গেই কথা বললাম, সবাই একবাক্যে মেনে নিলেন যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিল নেইমার সিনিয়রেরও। মোজির স্থানীয় লিগে রীতিমতো স্টার ফুটবলার ছিলেন তিনি। নেইমার জুনিয়র তখন খুব ছোট। বাবার হাত ধরে যেতেন খেলার মাঠে। গ্রুপ ছবিতে বসে যেতেন। বাবার বন্ধুদের সঙ্গে বল পেটাতেন। কিন্তু মানুষ ভাবে এক। হয় আর এক। নতুন কেনা গাড়িতে মোজি থেকে স্যান্টোস যাচ্ছিলেন নেইমার সিনিয়র। সঙ্গী স্ত্রী ও পুত্র। রাস্তায় বিরাট একটা দুর্ঘটনা। প্রাণে বেঁচে যান সবাই। কিন্তু নেইমার সিনিয়রের গোড়ালি ভাঙে। ব্যস্, ফুটবল জীবনের শেষ ওখানেই। সব স্বপ্নেরও ইতি।
কিন্তু ওপরওয়ালা যে অনেক বড় স্বপ্ন সাজিয়ে রেখেছেন তাঁর জন্য। আদৌ কি তা ভাবতে পেরেছিলেন নেইমার সিনিয়র? মোজির মিউনিসিপ্যাল স্পোর্টস ডিপার্টমেন্টে বাস্কেটবল বিভাগে কাজ করেন সিনিয়র নেইমারের এক বন্ধু। তাঁর স্মৃতিচারণ, “সে সময় বেশ ভেঙে পড়েছিল নেইমার। ছেলে তখনও বেশ ছোট। ফুটবলই একমাত্র উপার্জন। তখনই ওরা সিদ্ধান্ত নেয়, মোজি ছেড়ে স্যান্টোস চলে যাবে।” আর স্যান্টোসেই ফুটবল জীবনের পরিপূর্ণতা লাভ নেইমার জুনিয়রের। খুব ছোটবেলায় চোখে পড়ে যান স্যান্টোস স্কাউটিং ডিপার্টমেন্টের। বিদেশের ক্লাবগুলো মনে করে একটা ক্লাবের সাফল্য-ব্যর্থতা সবটা নির্ভর করে ফুটবলারদের উপর। ক্লাবের ব্র্যান্ড ভ্যালু বাড়াতে পারে ফুটবলারদের সাফল্য। এবং সফল ফুটবলারদের উপস্থিতি বদলে দিতে পারে একটা ক্লাবের সব ব্যবসায়িক সমীকরণ। নেইমারের জন্যই যেমন। নিজের অ্যাকাডেমিতে নেইমার জুনিয়রকে তৈরি করেছিল স্যান্টোস। ১১ বছর বয়সে রিয়াল মাদ্রিদ তাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। স্যান্টোস ছাড়েনি। তার ঠিক দশ বছর পর বার্সেলোনাকে বিক্রি করল ৫০ মিলিয়ন ইউরোয়। মাঝে ট্যাক্স নিয়ে পুরনো ক্লাবের সঙ্গে অনেক মনোমালিন্য। তবু ক্লাবের এই মুহূর্তের সব কৃতী সন্তানকে ভোলেনি স্যান্টোস। ওদের মিউজিয়ামে গিয়ে দেখলাম পেলের মতো নেইমারের জন্যও আলাদা একটা শো-কেস করা আছে এখানে। দেখানো হচ্ছে নেইমারের গোল। তাঁর অটোগ্রাফ করা জার্সি, বুট, ব্যালন ডি’অরে পুসকাস পুরস্কারের ফলক সবটাই এখনও সাজিয়ে রেখেছেন স্যান্টোস কর্তৃপক্ষ। কারণ এক বারও বিশ্বকাপ না জিতে নেইমার এই মুহূর্তে যে রকম জনপ্রিয়তা, স্টারডম ভোগ করছেন, তা এ দেশে একমাত্র পেয়েছিলেন পেলে!
নেইমারের বার্থ সার্টিফিকেট
সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন...
মোজির ও গ্লোবো অফিসে বসে কথা হচ্ছিল। ওদের স্পোর্টস এডিটর পেরোর সঙ্গে। ওঁর যুক্তি, পেলের সঙ্গে তুলনার একটা ভিত্তি আছে নেইমারের ক্ষেত্রে। প্রথমত পেলের মতো কম বয়সেই দেশকে প্রতিনিধিত্ব করা। কোপা আমেরিকা থেকে কনফেডারেশন কাপে ব্রাজিলকে চ্যাম্পিয়ন করা। সব চেয়ে বড় কথা হল স্টাইল। ব্রাজিলিয়ান জীবনদর্শনের সঙ্গে মিলে যায় ওঁর খেলা। যে ভাবে অ্যাটাকিং স্টাইলটা আমাদের পছন্দ, নেইমারের খেলায় অনেক দিন পরে সেটাই যেন খুঁজে পেয়েছে ব্রাজিল। ওকে মাঠে লক্ষ করবেন। দেখবেন কী প্রচণ্ড উপভোগ করছে ফুটবলটা। এটাই ব্রাজিলিয়ান জীবনদর্শন। উপভোগ করো সবটা।
মোজি কিংবা স্যান্টোসের রাস্তায় কিছুটা হাঁটলেই এই জীবনদর্শনটা টের পাবেন সহজে। মোজিতে দেখলাম মিউনিসিপ্যালটির পাশেই বিরাট স্পোর্টস কমপ্লেক্স। এখানে স্থানীয় লিগ চালায় মিউনিসিপ্যালটিই। প্রায় ছ’হাজার ফুটবলার খেলে মোজিতেই। কে জানে, গোটা ব্রাজিলে কত!
মিউনিসিপ্যালিটি স্পোর্টস কমপ্লেক্সে দেখলাম দুপুরেও জমজমাট খেলা চলেছে। বিরাট একটা ইনডোর হলকে ওঁরা প্রয়োজন মতো ফুটবল, ভলিবল কিংবা বাস্কেটবল কোর্ট বানিয়ে নেন। রয়েছে বিরাট একটা স্কেটিং রিঙ্ক। প্রচুর ছেলে স্কেটিং করছে। স্পোর্টস ডিপার্টমেন্টের ভাইস চেয়ারম্যান ফ্রেড অ্যারিড। তাঁর মুখেও সিনিয়র নেইমারের কথা। “এখানে ইউনিনিও ক্লাবে ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৬ টানা সাত বছর খেলেছিল নেইমার সিনিয়র।” জুনিয়র নেইমার তখন খুব ছোট। বাবার হাত ধরে খেলার দিন মাঠে আসত। এটুকু মনে আসতেই ফ্রেড বের করে দিলেন দুষ্প্রাপ্য একটা ছবি। সামনে বসে নেইমার সিনিয়র। আর বাবার পাশেই বসে ছোট্ট নেইমার। “আমি তখন ইউনিনিওর ফিজিওথেরাপিস্ট। সিনিয়র নেইমারের সঙ্গে বেশ ভাল বন্ধুত্ব। হঠাৎই একদিন ওর ফোন আসে। স্ত্রীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। তিনি সন্তানসম্ভবা। সেই সময় সিনিয়র নেইমারের বন্ধুদের মধ্যে একমাত্র আমারই গাড়ি আছে। সে দিন গাড়ি চালিয়ে ওর স্ত্রীকে হাসপাতালে পৌঁছে দিই আমিই। পরে হাসপাতাল থেকে বাড়িও আসে আমার গাড়িতেই। কী করে জানব এই সদ্যোজাত ছেলেই পরবর্তী কালে এত বড় ফুটবলার হবে!” বলছিলেন ফ্রেড।
সান্তা কাসা মিউনিসিপ্যাল হসপিটালে আরও একটা অসাধারণ নথি হাতে এল। নেইমারের বার্থ সার্টিফিকেট। তাতে লেখা, নাম- নেইমার ডা সিলভা স্যান্টোস জুনিয়র। জন্ম- ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯২। রাত ২টো ১৫ মিনিট। বাবা নেইমার ডা সিলভা স্যান্টোস। মা নাদিন স্যান্টোস।
বার্থ সার্টিফিকেটের ফটো কপি করে নিয়ে এসেছি এক পিস। কার কী আর্কাইভাল মূল্য হয়, কেউ বলতে পারে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy