ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার
বাঙালি চ্যালেঞ্জ নেয় কি নেয় না, চ্যালেঞ্জ নেওয়ার হিম্মত আদপে ধরে কি ধরে না, এই সব কূট তর্কে কোনও লাভ নেই। আসল কথা, বাঙালি ব্যারিয়ার ভাঙতে পারছে কি না, তার সামনের হার্ডলটা টপকাতে সমর্থ হচ্ছে কি হচ্ছে না! এই ব্যারিয়ার ভাঙতে পারলেই সিনেমা, সাহিত্য, বিজ্ঞান সব ব্যাপারে বাঙালি চ্যালেঞ্জ জিতে সোল্লাসে বেরিয়ে যায়। অমর্ত্য সেন যাবতীয় ব্যারিয়ার ভেঙে উন্নয়ন, স্বক্ষমতা, সামর্থের নতুন সংজ্ঞা দিয়েছেন বলেই পৃথিবী ওঁকে কুর্নিশ করে।
ব্যারিয়ার ভাঙা অর্থে আমি বাংলা ছেড়ে অন্য জায়গায় যাওয়ার কথা বলছি না। নিজের ভেতরের বাধাবন্ধ ভেঙে দৌড়তে হবে। ব্যারিয়ার ভাঙার চ্যালেঞ্জটাই আসল! খুব কম বাঙালিই সেই চ্যালেঞ্জটা নেয়। যখন নেয়, বেশির ভাগ সময়েই সফল। আমাদের মুখ্যমন্ত্রী আটপৌরে ঢঙে শাড়ি পরেন, হাওয়াই চপ্পল পায়ে হাঁটেন। কিন্তু তারই মধ্যে যাবতীয় ব্যারিয়ার ভেঙে বেরিয়ে যান বলেই আজ দেশের অন্যতম জনপ্রিয় নেত্রী।
কিন্তু এই রকম বাঙালি আর ক’ জন? ১০০-র মধ্যে ১৫ বা ২০ জন। বাকি ৮০% বাঙালিই চ্যালেঞ্জহীন স্থিতাবস্থা পছন্দ করেন। তাঁরা গতানুগতিক পথ অনুসরণ করতে ভালবাসেন। আগে শুনতাম, প্রচুর ইয়াং ছেলে বাড়ি থেকে পালিয়ে মুম্বই মেলের টিকিট কাটে। কেন না, মিঠুন পথ দেখিয়েছে। বাড়ি থেকে পালিয়ে মুম্বই গেলেই হিরো! আমি সেই রকম ছেলেদের ভুল ধারণা বারংবার কাটানোর চেষ্টা করেছি। গৌরাঙ্গ চক্রবর্তী মোটেই বাড়ি থেকে পালায়নি, ভাই। সে সেল্স রিপ্রেজেন্টেটিভের চাকরি করতে মুম্বই গিয়েছিল। তার পর দাঁতে দাঁত চেপে চ্যালেঞ্জ নিয়ে একটা স্বপ্নের পিছনে দৌড়েছিল।
অনেকেই আজকাল আমাকে জিজ্ঞেস করেন, কোন চ্যালেঞ্জটা শক্ত? জোড়াবাগানের গৌরাঙ্গ থেকে মিঠুন চক্রবর্তী হওয়া? তারকা মিঠুন থেকে বিজনেসম্যান মিঠুনে রূপান্তর? নাকি, এখন রাজ্যসভার আসনে গিয়ে আদর্শ সাংসদ মিঠুন হওয়ার চেষ্টা? প্রতিটি চ্যালেঞ্জই ভিন্ন, ভাই। একটার সঙ্গে অন্যটার সম্পর্ক নেই। তবে হিসেব কষলে হয়তো দেখব, প্রথম চ্যালেঞ্জটাই সবচেয়ে বেশি শক্ত ছিল। সেটা ছিল নাওয়া-খাওয়া ত্যাগ করে স্বপ্নের পিছনে ধাওয়া। পরেরগুলি দিক বদলের চেষ্টা। দিক বদলও একটা চ্যালেঞ্জ। চেক লেখক ফ্রান্ৎস কাফকার একটা গল্প আছে। একটা ইঁদুর ছুটোছুটি করছিল। বেড়াল এসে তাকে ধরে খেয়ে ফেলল। ইঁদুর জিজ্ঞেস করল, আমাকে খাচ্ছ কেন ভাই? বেড়াল বলল, তুমি দিক পরিবর্তন করোনি, তাই। সিনেমা-কেরিয়ারেও আমি যখনই দিক বদলের চ্যালেঞ্জ দেখেছি, লুফে নিয়েছি। মৃগয়ার পর তাই ‘হাম পাঁচ’, ‘তরানা’ বা ‘ডিস্কো ড্যান্সার’ করতে করতে ‘তাহাদের কথা’ বা ‘কালপুরুষ’ ছবির অফার পেয়ে লুফে নিয়েছি। ‘অগ্নিপথ’ করেই ছুটেছি শ্রীরামকৃষ্ণ সাজতে। চ্যালেঞ্জ নেওয়াটাই আপনার জেতার খিদে বাড়িয়ে দেয়।
এই খিদে কী জিনিস, আমি জানি। মুম্বইতে এক সময় পেট ভরানোর জন্য কলের জল খেয়ে পার্কে শুয়ে থেকেছি। আমি, বনি, অনিল কপূর সবাই একটা ঘরে ভাগাভাগি করে থেকেছি। কিন্তু হাল ছেড়ে দিইনি। মার্টিন লুথার কিং এক বার বলেছিলেন, স্বাচ্ছন্দ্য এবং আরামের মাঝে মানুষকে বোঝা যায় না। তাকে চিনতে হয় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, বিতর্কের সামনাসামনি কিংবা ঝড়ের মোকাবিলা করার সময়।
চ্যালেঞ্জ শব্দটার মধ্যে দুটি অংশ আছে। প্রথম, বিশাল একটা হার্ডল! ছোটখাটো হার্ডল কোনও দিনই চ্যালেঞ্জের সম্মান পায় না। নববর্ষের দিন আপনাকে দুটোর জায়গায় তিনটে রাজভোগ খেতে বললে সেটা চ্যালেঞ্জ নয়। ম্যানেজ করা যাবে। কিন্তু দুটোর জায়গায় কেউ ২০০টা রাজভোগ খেতে বললে? সেটাই চ্যালেঞ্জের শুরুয়াত। এ বার হার্ডলটা যদি টপকাতে পারেন, সেটি চ্যালেঞ্জের সম্মান পাবে। নচেৎ নয়।
বেশির ভাগ বাঙালির ক্ষেত্রে দেখেছি দুটো সমস্যা। এক, তারা হার্ডলটাকেই এভারেস্ট ভেবে হাল ছেড়ে দেয়। বছর কয়েক আগে আমি আনন্দবাজারেই ‘সিনেমায় নামতে হলে’ নামে একটা কলম লিখতাম। সেখানে অনেকেই চিঠি দিতেন, তাঁরা গ্রামে থাকেন বা নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। পাড়ায় নাটক করে অভিনয়ের প্রশংসা পেয়েছেন। কিন্তু কলকাতা বা মুম্বইয়ের স্টুডিয়োতে কল্কে পাওয়ার রাস্তা জানা নেই। আমি সবাইকে একটাই কথা বলতাম। যুদ্ধ চালিয়ে যাও। প্রতিভা থাকলে রাস্তা খুলবেই। অনুশীলন আর অনুশীলন। গৌরাঙ্গ কী ভাবে চ্যালেঞ্জ জিতে মিঠুন হল জানতে চাইছেন? ৩০% ভাগ্য, ২০% প্রতিভা। বাকি ৫০%-ই অনুশীলন।
এই অনুশীলন করার সময়েই দ্বিতীয় সমস্যা। বেশির ভাগ বাঙালি নিজের মাপ জানেন না। তাঁরা মনে করেন, ক্রিকেট খেললে সৌরভ হতেন। অভিনয় করলে উত্তম বা সৌমিত্র। ছবি আঁকলে গণেশ পাইন। এখানে চ্যালেঞ্জ নেওয়ার প্রথম শর্ত একটাই। বারংবার নিজেকে জিজ্ঞেস করতে হবে, আমি কতটা পারি! আমার পায়ে খুঁত আছে, তিন পা ছুটলেই দম বন্ধ লাগে অথচ মিলখা সিংহ হওয়ার স্বপ্ন দেখি। এটাকে কিন্তু চ্যালেঞ্জ নয়, দিবাস্বপ্ন বলে।
আরও একটা সমস্যা আছে। অহেতুক অন্যের কথা পাত্তা দেওয়া। আমি যখন মুম্বইয়ে থাকার সময়েও শখ করে দু একটা বাংলা ছবি করতে কলকাতায় আসতাম, সমালোচকেরা লিখতেন, হিন্দিতে বাজার খারাপ বলে বাংলায় আসছে। কেউ আবার ‘ফ্লপ স্টার’ কিংবা ‘পুয়োর ম্যানস অমিতাভ বচ্চন’ আখ্যা দিতেন। এঁদের সব কথায় কান দিলে, আমার নিজের কাজটা হয়ে উঠত না। প্রায় সাড়ে তিনশো ছবিতে অভিনয়, তিনটে জাতীয় পুরস্কার, সব অধরাই থেকে যেত। আপনি সিঁড়ি ভেঙে যত ওপরে উঠবেন, ততই অন্যের সমালোচনার কাঁটায় ক্ষতবিক্ষত এবং রক্তাক্ত হবেন। সেটাকে সহ্য করে নেওয়াই চ্যালেঞ্জ!
লিখতে লিখতে মনে পড়ল, স্কটিশ চার্চে পড়ার সময় আমি পাড়া ফুটবলে খেপ খেলেছি। গ্রেকো-রোমান কুস্তিতে চ্যাম্পিয়ন ছিলাম। বিসর্জনের তাসা পার্টিতে নেচেছি। সেই নাচের মুভমেন্টই একটু অদলবদল করে এলভিস প্রেসলি, ফ্রেড অ্যাস্টেরদের ভঙ্গির সঙ্গে মিশিয়েছিলাম। দেখলাম, লোকে ‘পেলভিক মিঠুন’ বলছে। সমালোচনায় মুষড়ে পড়তে পারতাম। কিন্তু ভেবে দেখলাম, লোকের মনে নিশ্চয় ব্যাপারটা কোথাও দাগ কাটছে। আরও নাচের প্র্যাকটিস। তার পরই ডিস্কো ড্যান্সার, কসম পয়দা করনেওয়ালি কি।
আর একটা জিনিস। চ্যালেঞ্জ আপনি যত উতরোবার চেষ্টা করবেন, আশপাশের লোকেরা আপনাকে তত সম্মান করবে। একটা ঘটনা বলি। কেরিয়ারের শুরুর দিক। ‘তারানা’ ছবি। শুটিং কাশ্মীরে। তত দিনে ‘সুরক্ষা’ হিট, তবু আমি সি গ্রেড স্টার। রয়েছি ছোট একটা হোটেলে। সেখান থেকে রোজ অন্যদের সঙ্গে গাদাগাদি করে প্রোডাকশনের ভ্যানে চেপে ইয়ুসমার্গের শুটিং স্পটে। হিরো ভ্যানে যাচ্ছে, এ সব কথা আজ অনেকের কাছে কল্পকাহিনী মনে হতে পারে।
সে দিন দেখলাম, একটা মার্সিডিজ হঠাৎ ব্রেক চেপে ভ্যানের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল। গাড়ির চালক আমার সামনে এসে বলছে, ‘স্যর ডাকছেন।’ গিয়ে বুঝলাম, স্যর মানে অমিতাভ বচ্চন। মিস্টার নটবরলালের শুটিং-এ এসেছেন তিনি। অমিতাভ কোনও দিনই বেশি কথা বলেন না। সে দিনও যে খুল্লমখুল্লা অনেক কথা হয়েছিল, এমন নয়। কিন্তু তাঁর হাবভাব দেখে মনে হয়েছিল, আমার চ্যালেঞ্জ জেতার সংগ্রামটাকে মনে মনে মর্যাদা দিচ্ছেন। হিরো গাদাগাদি করে যাবে কেন? হয়তো নিজে এক সময় অনেক অপমান সয়েছেন বলেই প্রোডাকশনের ভ্যানে আমার যাওয়াটা ওঁকে ধাক্কা দিয়েছিল। চ্যালেঞ্জ জেতাটাই আপনাকে সহিষ্ণু হতে শেখায়, বিনয়ী হতে সাহায্য করে।
সামনে রাজ্যসভা? চ্যালেঞ্জ জীবনে শেষ হয় না ভাই। বাঘের মতো সে অনবরত আপনাকে ধাওয়া করে যাবে। আপনাকে তার সঙ্গে লড়তে হবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন বিরোধী নেত্রী ছিলেন, তাঁর সামনে ছিল প্রতিবাদী চ্যালেঞ্জ। এখন চ্যালেঞ্জ অন্য। উন্নয়ন! ভেবে দেখলাম, ‘মিকো’ (মিঠুন সিটিজেনস ওয়েলফেয়ার অর্গানাইজেশন), ‘প্রণাম’ ইত্যাদির মাধ্যমে সমাজসেবার অভিজ্ঞতা অনেক দিনের। এ বার ক্ষেত্রটা বড় হল। রাজনীতি খারাপ নয়। গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে রাজনৈতিক দল, আইনসভা, বিচারব্যবস্থা সবই সমান গুরুত্বপূর্ণ। নেগেটিভ চিন্তা আমি করি না। সেটা আপনাকে পিছিয়ে দেয়, চ্যালেঞ্জের সামনে মুষড়ে পড়তে বাধ্য করে। আমি জানি, নিজেকে এ বার নতুন ভাবে পেশ করার সময় এসেছে। নিজেকে দেখতে চাই দায়িত্বশীল সাংসদ হিসাবে। নিছক স্বপ্ন পূরণের নায়ক নয়, বাস্তবের মাটিতে দাঁড়ানো সহমর্মী হিসাবে। নেগেটিভ চিন্তার জায়গা নেই। আসল কথা একটাই। সময় এসেছে। ৯০% বাঙালিকেই এখন ব্যারিয়ার ভেঙে এগিয়ে যাওয়ার চ্যালেঞ্জ নিতে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy