রেজলিউশনের নামে মানুষ গাদা গাদা মিথ্যে কথা বলে। অর্ণবও এত দিন তাই করতেন। ধূমপান ছেড়ে দেবেন, সকালে জগিং করবেন ধরনের কথা। শুনে বাহবাও দিতেন অনেকে। সেই অর্ণব কিন্তু এ বার এমন একটা রেজলিউশন নিয়েছেন, যা তিনি মন থেকে করতে চান। চান ব্যাঙ্কের মোটা মাইনের চাকরি ছেড়ে সিনেমার চিত্রনাট্য লিখতে।
স্বাধীন ভাবে কাজের আনন্দ
আবির চট্টোপাধ্যায়
নিন্দুকরা বলতেই পারেন, বেশ তো ছিলেন চাকরি-বাকরি নিয়ে। আরে মশাই, হতেই পারে প্যাশন সম্পর্কে আপনার ভালবাসা কতটা, তা বুঝতে অনেকটা সময় লেগে গেল। কারণ স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি, প্লেসমেন্ট, চাকরিআপনার জীবনে ভিড় করে থাকে। যেমন পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায় এবং সঙ্গীতশিল্পী অনুপম রায়। দু’জনেই বেঙ্গালুরুতে চাকরি করতে করতেই নাটক-গল্প-গান লেখা, সুর করার কাজ চালিয়ে গিয়েছিলেন। অনুপমের কথায়, সারা দিন অফিস করে, রাত ন’টায় বাড়ি ঢুকে, শ্রান্ত শরীরে যখন তিনি গান নিয়ে বসতেন, নিমেষে সব ক্লান্তি দূর হয়ে যেত।
ঝুঁকি নেওয়ার সাহস
অনুপম রায়
নিজের পরিচিত পরিমণ্ডল ছেড়ে হঠাত্ বেরিয়ে আসা, মুখের কথা নয়। ভবিষ্যত্ অজানা। হতেই পারে ফ্লপ করলেন। যা ভেবেছিলেন হল না।
পরিচালক সৃজিত, যখন বেঙ্গালুরুর চাকরি ছেড়ে কলকাতায় আসেন, তখন সম্বল নিজের লেখা কয়েকটা স্ক্রিপ্ট, এবং নিজের প্যাশনকে নিয়ে এগোনোর অদম্য ইচ্ছা। তখন আদৌ ‘অটোগ্রাফ’ হবে কিনা জানা নেই। সৃজিত নিজেই বলছেন, তিনি সাঙ্ঘাতিক ঝুঁকি নিয়েছিলেন। কিন্তু এমন কিছু করতে চেয়েছিলেন, যা তাঁকে মানুষের মনে জায়গা দেবে, তাঁর কাজ দর্শক অনেক কাল মনে রাখবে।
গায়ক বাবুল সুপ্রিয় এখন সাংসদও। কিন্তু পড়াশুনা শেষে ব্যাঙ্কের বড় চাকরি পেলেন যখন বাবা-মা, আত্মীয়, বন্ধু সবাই খুশি। কিন্তু তাঁর স্বপ্ন, গায়ক হবেন। সিদ্ধান্ত নিতে একটুও ভয় করেনি তাঁর। সত্যিই তো, আজকের দিনে একটা চাকরি ছেড়ে নতুন কোম্পানিতে যাচ্ছেন, তাতেও তো ঝুঁকি থাকে। অভিনেতা আবিরও সে কথাই বলছেন, “যে কোনও দিন আপনার কোম্পানিও তো বলতে পারে আসুন দাদা, আপনাকে আর লাগবে না।” ওঁর নিজের জীবনেও চাকরি ছাড়ার আগে দুশ্চিন্তা করেছেন, দোটানায় পড়েছেন। কিন্তু ওই যে, আপনি প্যাশনেট হলে, ঝুঁকি নেব কি নেব না, এই সব যুক্তি আদৌ খাটে না।
নিজের প্রতি বিশ্বাস
আবেগের বশে সিদ্ধান্ত নিয়ে পরে হাত কামড়ানোর কোনও মানেই হয় না। গায়ক-লেখক অনুপম রায় যেমন বলছেন, “এটা একটা বোধের ব্যপার। আমি যা করছি তা আমার কাছে দারুণ। কিন্তু লোকসমক্ষে তা পাতে দেওয়ার যোগ্য কিনা সেটাও বুঝতে হবে।”
অনুপম নিজে, চাকরি ছেড়ে কলকাতায় আসার আগে, যাচাই করে নিতে চেয়েছিলেন, তাঁর গান বা লেখা কী রকম সমাদর পাচ্ছে। বললেন, “অনেক শিল্পীকে আমার গান শোনাই। ভাল প্রতিক্রিয়ায় বুঝি গানের শ্রোতা আছে কলকাতায়।” চাকরি ছাড়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হন তখনই, যখন দেখেন অনেক কাজ তাঁর দরজায় কড়া নাড়ছে।
ভাঙব তবু মচকাবো না
কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়
একজন ডাক্তারবাবু, অন্য জন মাস্টারমশাই। তাঁরাই আজ বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে একের পর এক দুর্দান্ত ফিল্ম উপহার দিয়ে চলেছেন। কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় এবং কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়। দু’জনেরই জীবনের শুরুর দিকে অনেকটা জুড়ে ছিল চিত্রনাট্য লেখা, থিয়েটারের কাজ। কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় যেমন সফল ভাবে টেলিভিশনের কাজ করেছেন বেশ কিছু বছর। কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় আবার নিজে উদ্যোগ নিয়ে দু’হাজার সালে একটি শর্ট ফিল্ম তৈরি করে ফেলেন। কৌশিকের মতে, এ এক অপরিসীম ধৈর্যের যাত্রা।
সেন্ট জেমস-এ পড়াতেন কৌশিক। সঙ্গে লেখালেখির কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। সেন্ট জেভিয়ার্সেও বছর তিনেক পড়ান। শুরু থেকেই ইচ্ছে ছিল বড় পর্দার জন্য কাজ করার। কিন্তু বললেই তো ফিল্ম বানানো যায় না! তাই তাঁর আগে প্রায় ১০ বছর ধরে চলেছে নানা কাজ। অবশেষে শিকে ছিঁড়ল ২০০৪-এ এসে। কথায় কথায় কমলেশ্বর জানালেন, ওই স্ট্রাগল পিরিয়ড, মানসিক দিক থেকে, অর্থনৈতিক দিক থেকে আদৌ ভাল ছিল না। স্ক্রিপ্ট হাতে ঘোরাঘুরি, প্রযোজকদের সঙ্গে দেখা করা। অনেকের গল্প পছন্দ হত না, অনেকের আবার পছন্দ হলেও ভাবত বানাতে পারব কিনা। সেই সব স্ক্রিপ্ট এখনও আছে তাঁর কাছে, বলছেন চাঁদের পাহাড়ের মতো
বিশাল মাপের ছবির পরিচালক কমলেশ্বর। তবে দু’জনেরই এক কথা। যদি আরও সময় লাগত, তাতেও এঁরা দমে যেতেন না কিছুতেই।
পরিবারের পাশে থাকা
সৃজিত মুখোপাধ্যায়
আপনি তো একা নন। আপনার এই সাহসী সিদ্ধান্তের প্রভাব আপনার পরিবারের ওপরও পড়বে। গানের পরিবেশ পরিবারের কাছ থেকে পেলেও, গানের জন্য চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি বাবুলের পরিবার। “আমি মুম্বইতে থাকাকালীন মা পনেরো দিন অন্তর আমাকে বলত, ফিরে আয়,” বলেন বাবুল। অনুপম অবশ্য বাবা-মায়ের পূর্ণ সমর্থন পেয়েছিলেন। মায়ের চূড়ান্ত প্রশ্রয় সৃজিতও পেয়েছিলেন। আবিরের মনে শঙ্কা ছিল এ কথা ভেবে যে, তাঁর স্ত্রী কী ভাবে রিঅ্যাক্ট করবেন? “আমার এই ডিসিশনে আমার স্ত্রী, এমন কী ইন-লজ-রা যে ভাবে সাপোর্ট করলেন, ভাবা যায় না। কারণ তাঁদের কাছে এই জগত্টা ভীষণ অনিশ্চয়তার।” আবিরের ক্ষেত্রে যেমনটা হয়েছে, অনেক সময় সেটা নাও হতে পারে। কেরিয়ার পরিবর্তন অনেক সময় অশান্তির কারণও হয়ে ওঠে।
যদি সাফল্য না আসে
বাবুল সুপ্রিয়
প্যাশনে ঝাঁপ দেওয়ার আগে তাই ভেবে রাখুন, আপনার প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটতে কিছুটা সময় লাগতেই পারে। তখন কী ভাবে নিজের স্পিরিট অটুট রাখবেন। বাবুলের পরামর্শ, “মাথায় রাখুন ওভারনাইট সাকসেস, ফেলিওর কোনওটাই হয় না।” এত কিছুর পরও, যদি সত্যিই ক্লিক না করে, তখন? এ ব্যাপারে সৃজিত বলছেন, “অবশ্যই একটা প্ল্যান-বি ভেবে রাখুন।” তিনি নিজে কি এ রকম কোনও প্ল্যান-বি ভেবেছিলেন? উত্তর, তিনি ভাবেননি ঠিকই। তবে পরিচালনায় ভাল কিছু করতে না পারলে তিনি নিজের পাঁচ বছরের ওয়ার্ক এক্সপিরিয়েন্স কাজে লাগিয়ে আবার কর্পোরেট দুনিয়ায় ফিরে যেতেন। আর এই যদির কথা ভেবেই আবির দীর্ঘ সময় চাকরি আর অভিনয়, একসঙ্গে চালিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু পরে যখন দেখলেন, দু’টো কাজই আরও বেশি সময় দাবি করছে, তখন পেশা হিসেবে বেছে নিলেন অভিনয়কেই। অভিনেতা হিসেবে যদি সাফল্য না আসত, অন্তত কোনও আফসোস থাকত না। অতএব, নিজে দায়িত্ব নিয়ে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাকে নিয়ে এগোনোর সাহস দেখিয়েছেন, তার পর যাই হোক না কেন, হাততালি আপনি পাবেনই।
ওই গানটা মনে আছে তো... ছেড়ে দিলে সোনার গৌড় ...আর তো পাব না... তাই প্যাশনকে হৃদমাঝারে রাখুন। যেতে দেবেন না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy