রাঢ় বাংলার খোলা প্রান্তর। এগারো জন দুর্দান্ত খেলোয়াড়। খেলার মাঠ ছাপিয়ে জীবনের লড়াই।
ছবির ভাবনাতে লড়াইয়ের যে মেজাজ ছিল প্রয়োগে তা দেখা গেল না।
বাংলা ছবির গোয়েন্দা ভরা মরসুমে জমল না লড়াই।
অথচ ছবিতে লড়াই যে কোথাও ছিল না তেমনটাও নয়। পরিচালক পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় খেলার মাঠের লড়াইকে ছাপিয়ে জীবনের লড়াইয়ের কথা বলেছেন। এই লড়াইয়ের জেরেই কাঞ্চন মল্লিক (দোয়া) গ্রামের মুর্গি-চোর, ছবিতে কোচ রায়ানের দক্ষ প্রশিক্ষণে কুসুমডি ফুটবল টিমের গোলরক্ষক হয়ে যায়। মহুয়ায় মজে থাকা গ্রামবাসীরা ফুটবল আঁকড়ে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। সাঁওতাল খেতমজুর আর গ্রামের জমিদার একই সঙ্গে মাঠে নামে ফুটবলের জন্য। ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তর আবহ সঙ্গীত ছবির দৃশ্যে লড়াইয়ের মেজাজ ছড়িয়ে দেয়।
এক দিকে জীবন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া মদ্যপ, দুর্ধর্ষ ফুটবলারের (পরবর্তী কালে কোচ) কাহিনি আর অন্য দিকে পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত গ্রামে রুখু জীবনের কথা নিয়ে ছবি এগোতে থাকে। তাঁদের ঘরে ঘরে আমলাশোল— তেতেপুড়ে উঠে তারাই লড়াইটাকে নিয়ে যায় চরাচর জুড়ে...শুধু ফুটবল নয়, খিদের লড়াই, জীবনের লড়াইয়ে তৈরি হয় তাঁরা। আর শুধুমাত্র ফুটবলের জন্য বেঁচে থাকা রায়ান কুসুমডি একাদশকে জিতিয়ে দিয়ে যেন নিজেই জিততে চায়। ফিরে পেতে চায় তার অতীতকে। কিন্তু পরিচালক হঠাৎ অ্যাংলো ইন্ডিয়ান কোচের আমদানি করে ইংরেজির বন্যা ছোটালেন কেন? তাও আবার পুরুলিয়ার গ্রামের মানুষের সামনে! একই সংলাপ প্রথমে ইংরিজি তারপরে বাংলায় বলে ছবিটাকেও দীর্ঘ করা হল।
গল্প যেন দানা বাঁধছিল না। খেলার মাঠে বল বাড়ানোর লোকের কিন্তু কোনও অভাব ছিল না। পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের ‘লড়াই’-এর টিম কিন্তু ছবি জুড়ে দাপিয়ে বেড়িয়েছে। পুরুলিয়ার কুসুমডি ফুটবল টিমের ক্যাপ্টেন ইন্দ্রাশিস আর গোলরক্ষক কাঞ্চন মল্লিক ‘মাঝ মাঠ’-এর দখল নিয়েছিলেন। কুসুমডি একাদশের সঙ্গে কলকাতার ম্যাচের দৃশ্যে দু’জনের অভিনয় মনে রাখার মতো। অন্য দিকে মাঠের পিছন থেকে (দু’একটা সংলাপ ছাড়া) প্রায় নির্বাক অভিনয়ে কেবল চোখ দিয়ে কথা বলে লড়াই চালিয়ে গেছেন গার্গী রায় চৌধুরী। তাঁকে সাধুবাদ। খরাজ মুখোপাধ্যায় ধরে রেখেছিলেন খেলার গতিকে।
কিন্তু তাতে কি হবে? বিপক্ষের ডিফেন্স সরিয়ে জালে বল পৌঁছে দেওয়ার মতো দক্ষ স্ট্রাইকারের অভাবে গোলটাই হল না। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় শত চেষ্টা করেও ‘সেবাস্তিয়ান রায়ান’-এর চরিত্রে স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারলেন না। তাঁর ‘ক্ষিদ্দা’ হওয়া হল না। দুর্বল চিত্রনাট্যে জোরালো, উদ্দীপক সংলাপের বড় অভাব ছিল। যে সমস্ত মানুষ ফুটবল চোখে দেখা তো দূর, ফুটবলের নাম পর্যন্ত শোনেনি, তাদের মাত্র পাঁচ মাসেই কেমন করে কলকাতার নামকরা ফুটবল টিমের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিলেন পরিচালক তা বোঝা গেল না। ফুটবলার হয়ে ওঠার জন্য কী ধরনের ট্রেনিং দেওয়া হল তাদের?
গপ্পোটা ঠিক জমল না। উপরন্তু পায়েল আর ইন্দ্রাশিসের ঝটপট প্রেম ছবিটাকে আরও আলগা করল। খেলার ছবিতে খেলাই বাদ পড়ে গেল। তার বদলে ছবির প্রথম অংশে রায়ানের অতীত নিয়ে লম্বা লম্বা শট দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল মূল বিষয় থেকে ছবি সরে যাচ্ছে।
দ্বিতীয় ধাপের ফুটবল খেলা ছবিতে যদিও বেশ খানিকটা উত্তেজনা এনেছিল। গোপী ভগতের ক্যমেরায় ধরা থাকল সেই টান টান উত্তেজনা।
খেলা নিয়ে ছবি মানেই তা ‘চক দে’ বা ‘লগান’-এর মতো হবে ভেবে প্লিজ কেউ ছবিটা দেখতে যাবেন না। পুরুলিয়ার মেঠো মেজাজ, লড়াই টিমের এগারো জন ফুটবলারের (এদের প্রত্যেকের অভিনয় চরিত্রকে বাস্তব করেছে) হার-জিত আর হুল্লোড় আর একটা ফুটবল ম্যাচের উত্তেজনার আঁচ পেতে গেলে শীত থাকতে থাকতে ‘লড়াই’ দেখে আসুন।
‘ভাল খেলিয়াও পরাজিত’, কথাটা কিন্তু মিথ্যে নয়।
আনাচে কানাচে
দুই কাকাবাবু: চিরঞ্জিৎ ও প্রসেনজিৎ। ছবি: কৌশিক সরকার।
ছবি: কৌশিক সরকার।
মুখে দিলে গলে যায়: এবিপি আনন্দ খাইবার পাস ফেস্টিভ্যালে-এ রচনা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy