Advertisement
২৪ নভেম্বর ২০২৪
Zinia Sen

শিবপ্রসাদকে শর্ত দিয়েছি, চুম্বনের দৃশ্যে যেন অভিনয় না করে, এতে আমার ‘মাইন্ড ব্লক’ রয়েছে

‘কণ্ঠ’ ছবিতে পাওলি দামের সঙ্গে ওর একটা গানের শুটিং ছিল। খুব সুন্দর কিছু প্রেমের মুহূর্ত বৃষ্টিভেজা ময়দানে। আমি সে দিনও যাইনি।

বহুরূপীর সাজে শিবপ্রসাদ, পাশে স্ত্রী জিনিয়া।

বহুরূপীর সাজে শিবপ্রসাদ, পাশে স্ত্রী জিনিয়া। —ফাইল চিত্র।

জ়িনিয়া সেন
শেষ আপডেট: ০৯ অক্টোবর ২০২৪ ০৯:১৬
Share: Save:

এই সে দিন একজন পরিচিত মানুষ ফোন করে জানালেন, ‘বহুরূপী’র প্রচার খুব ভাল হচ্ছে। শিবপ্রসাদের ফোনের ব্লুটুথটা গাড়ির সঙ্গে সংযুক্ত ছিল, আর গাড়িতে ছিলাম আমি। মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। এই রে, বলে না ফেলে শিবপ্রসাদ ‘মার্কেটিং জিনিয়াস’। খুব ভয়ে ভয়ে থাকি। এই একটা কথা শুনে শিবপ্রসাদকে বহু বার বিচলিত হতে দেখেছি। ঠান্ডা মাথার মানুষ কিন্তু নিজেকে ‘মার্কেটিং জিনিয়াস’ মানতে নারাজ। কেউ যদি বলে তা হলে ফোন রেখে শিবপ্রসাদের প্রথম প্রতিক্রিয়া, “কেউ আমাকে আমার লেখা নিয়ে, আমার সংলাপ নিয়ে তো কই বলে না!” আর তার পরের সংলাপ হল, “তোমাদের জন্যই আমার এই অবস্থা।” ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে সবাই জানে, উইন্ডোজ়ের একটা ছবি বিক্রি হলে তার টাকায় অন্য ছবি তৈরি হয়, সেই কারণে জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবই রপ্ত করেছে শিবপ্রসাদ। নিজের অভিনেতা সত্তার সঙ্গে কখনও কখনও আপস করতে হয়। তা নিয়ে অভিযোগ করতেও শুনিনি কখনো। বহু অভিনয়ের সুযোগ ওঁকে ফিরিয়ে দিতে দেখেছি; কিছু এসেছে বাংলার নামী পরিচালকদের থেকে আবার কিছু হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি থেকে।

কিন্তু এই বছরটার একটা বিশেষত্ব রয়েছে। শিবপ্রসাদ পা দিল পঞ্চাশে। আর নন্দিতাদির তরফ থেকে ওঁর জন্য উপহার ছিল দুই সিনেমা, যার মূল চরিত্রে শিবপ্রসাদ। পরিচালনার ভার সম্পূর্ণ ভাবে নিজের কাঁধে তুলে নিতে দেখলাম ৭০ ছুঁইছুঁই নন্দিতাদিকে। অবশ্যই সঙ্গে ছিল অরিত্র মুখোপাধ্যায় এবং খুব দক্ষ একটি ডিরেক্টোরিয়াল টিম।

‘বহুরূপী’র জন্য খুব আলাদা করে নিজেকে তৈরি করতে দেখিনি শিবপ্রসাদকে। আসলে ও একজন ভাল অভিনেতা, যাঁর যাত্রা শুরু মঞ্চ থেকে। মঞ্চ ওঁকে নিজেকে ভাঙতে গড়তে শিখিয়েছে বারবার। এই ছবির ক্ষেত্রে ওঁর প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল নিজেকে একজন বহুরূপী শিল্পীর মতো যেন দেখতে লাগে। কোনও পার্টিতে গিয়ে শিবপ্রসাদকে কখনও খেতে দেখিনি আর তাই নিয়ে নন্দিতাদি আর আমার বিড়ম্বনার শেষ নেই। এ বার আর একটু কড়া ডায়েট আর শরীরচর্চা করে শুরুতেই দশ কিলো ওজন ঝরিয়ে ফেলেছিল। নন্দিতাদি, অরিত্র এবং বাকিদের সঙ্গে ঘুরেছে বহুরূপীদের গ্রামে। শিখেছে ওঁদের ভাষা। বাড়িতে প্রায়ই সেই ভাষায় কথা বলেছে।

শিবপ্রসাদ নাচের সিকোয়েন্স কোরিয়োগ্রাফ করতে খুব ভালবাসে বরাবর। যাঁরাই নাচ ভালবাসেন, তাঁদের প্রতি ওর একটা বাড়তি আকর্ষণ। এই ছবিতে কৌশানী মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নাচের তালে পা মিলিয়েছে। সেটা নিয়ে ওর আনন্দের শেষ নেই। আর এ সব কিছুই ও করেছে শুটিং স্পটে গিয়ে। অভিনেতা হিসাবে খুবই সহজাত। নন্দিতাদির থেকে শুনেছি ও রোম্যান্টিক দৃশ্যে খুব আড়ষ্ট ছিল শুরুতে। বকাও খেয়েছে নন্দিতাদির থেকে। পরে ‘ট্রাস্ট আর বিলিফ’-এর মাধ্যমে কৌশানীর সঙ্গে ওর রসায়ন তৈরি করতে পেরেছিল। যেটা ছবিতে খুবই আকর্ষণীয় লাগবে সকলের।

আমি শিবপ্রসাদের অন্তরঙ্গ দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি হতে দেখিনি কখনও। আমি সেই শুটিংয়ে যাই না, যেখানে আমার উপস্থিতি কোনও রকম বাধা সৃষ্টি করতে পারে অথবা যা আমার মনখারাপের কারণ হতে পারে। ‘কণ্ঠ’ ছবিতে পাওলি দামের সঙ্গে ওর একটা গানের শুটিং ছিল। খুব সুন্দর কিছু প্রেমের মুহূর্ত বৃষ্টিভেজা ময়দানে। আমি সে দিনও যাইনি। যদিও শিবপ্রসাদ মাঝেমাঝেই ডেকে পাঠায়। আর অরিত্র আমার আগের জন্মের শত্রুই হবে, কারণ ও এই সব শুটিংয়ের কল্পনা মিশ্রিত বিবরণ দিতে কখনও দেরি করে না। এ সবে কি আমার কখনও কোনও নিরাপত্তাহীনতা কাজ করেনি? এটা বললে মিথ্যে বলা হবে। কিন্তু দৃশ্য যে রকমই হোক একটা শর্ত ওকে আমার তরফ থেকে দেওয়া আছে। চুম্বনের দৃশ্য ও যেন শুট না করে। এতে আমার একটা ‘মাইন্ড ব্লক’ আছে। এখনও পর্যন্ত এমন কোনও ছবিতে অভিনেতা হিসাবে শিবপ্রসাদ কাজ করেনি যেখানে এ রকম দৃশ্যের প্রয়োজন হয়েছে। যদি হয় তখন না হয় ভাবব। ‘ফাটাফাটি’ ছবির শুটিংয়ে যে দিন আবীর চট্টোপাধ্যায় এবং ঋতাভরী চক্রবর্তীর চুম্বন দৃশ্যের শুটিং ছিল, সে দিনও আমি ফ্লোরে উপস্থিত ছিলাম না। গল্পের চিত্রনাট্যকার হিসাবে আপত্তিও তুলেছিলাম এই দৃশ্যের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে। কিন্তু সিনেমা ডিরেক্টরস মিডিয়াম এবং আমি নিজেও সেটা মানি।

শিবপ্রসাদ একাধারে একজন প্রযোজক, পরিচালক, অভিনেতা এবং স্বাভাবিক ভাবেই ওর অনেক রূপ। অভিনেতার সঙ্গে থাকা সহজ নয়। এই ধরুন বাড়ির সামনে আছে। কিন্তু বলছে সল্টলেক থেকে ফিরছি। তার পর মিনিটের মধ্যে ঘরে ঢুকে এসে আমার অবাক মুখের দিকে তাকিয়ে বলছে, “তোমার বোধহয় অন্য কোনও প্ল্যান ছিল?” তা ছাড়া, শুটিং ফ্লোরে থাকাকালীন আমি কখনও ফোন করি না, বাড়িতে বা অফিসে কোনও বিশেষ প্রয়োজন হলেও না। কিন্তু অভিনয় না করলে যেমন মনে মনে স্বস্তি পাই, তেমন আবার কষ্টও পাই।

‘বহুরূপী’র শুটিং হয়েছে সারা বাংলা জুড়ে ৮৪টি লোকেশনে। আমার পক্ষে বাড়ি ছেড়ে, অফিস ছেড়ে কোথাও যাওয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু ভিডিয়ো কলে শিবপ্রসাদের নানা রূপ আগে থেকে দেখেছি। যে দিন ওকে ক্লাইম্যাক্সের একটি বিশেষ লুকে দেখলাম, চেয়ার থেকে প্রায় পড়েই যাচ্ছিলাম। জানি দর্শক হাততালি দেবে কিংবা হলে সিটি পড়বে। আমিও যদি পারতাম নির্ঘাত সিটি দিতাম। ‘বহুরূপী’তে ওকে নানা লুকে সাজিয়েছে মেকআপ আর্টিস্ট পাপিয়া চন্দ। প্রত্যেক লুকেই ওকে দারুণ মানিয়েছে। পাপিয়াদির থেকে শুনেছি টাকিতে একদিন ভোরবেলা শট দেবে বলে ও রাতে মেকআপ নিয়ে ঘুমিয়েছিল। মেকআপ উঠে যেতে পারে বলে মাটিতেই শুয়েছিল।

এখনও মনে পড়ে শুটিংয়ের মধ্যে ওর দুর্ঘটনার কথা। তার আগে থেকেই ও আমাকে বলেছিল অনেক অ্যাকশন আছে। সত্যি বলছি, ভয়ে ছিলাম। তাই যখন ও অ্যাম্বুল্যান্স থেকে ফোন করে বলল, “তুমি বাইপাসের ধারে এক হাসপাতালে চলে এসো।” আমি একটাই কথা বলেছিলাম, “জানতাম।” তার পর এক মাস ও বাড়িতে থেকেছিল। ব্যথার কথা বলত না, কী ভাবে সুস্থ হবে সেই কথা বলত। যখন হাঁটতে পারল তখন থেকেই শুরু করে দিয়েছিল ফিজ়িয়োথেরাপি। ফিরে গিয়ে নাচের দৃশ্য শুট করতে হবে, তার ওপর ক্লাইম্যাক্স, তাই নিজেকে ফিট রাখতে হবে। এই কঠিন অধ্যবসায় আমাকে বার বার অনুপ্রাণিত করেছে। চুপ থেকেও যেন ও বলছে, ‘হাল ছেড়ো না বন্ধু, বরং কণ্ঠ ছাড়ো জোরে’।

চলতি বছরের পুরোটাই কেটেছে শুটিং করে। বাড়ি আর অফিস সামলেছি আমি, আমাদের এগ্‌জ়িকিউটিভ প্রোডিউসার সুপ্রিয়দা আর আমাদের টিমের বাকিরা। নন্দিতাদি এবং শিবপ্রসাদ দু’জনকেই আমরা সবাই খুব মিস্ করেছি, কিন্তু মনে মনে জেনেছি ওরা যেটা করছে সেটা মানুষ মনে রাখবে। তা ছাড়া সব ছবি থেকেই তো কিছু না কিছু পাওয়া যায়। আমি ‘বহুরূপী’ থেকে তুলে নিয়েছি শিবপ্রসাদের লেখা একটা সংলাপ। এই সিনেমায় ঋতাভরী অর্থাৎ পরি তার স্বামী সুমন্ত ঘোষাল, যিনি একজন বাঘা পুলিশ অফিসার, তাকে বারংবার বলেছে, “বাবি এটা আমার টাইম।” এ দিকে সুমন্ত এক দুর্ধর্ষ ব্যাঙ্ক ডাকাত ধরতে ব্যস্ত। এই ব্যাঙ্ক ডাকাতের চরিত্রে অভিনয় করেছে শিবপ্রসাদ। সারা ক্ষণ ফোনে থাকা কাজের মানুষ শিবপ্রসাদ। মানছি অনেক দায়িত্ব এবং ব্যস্ততা, তা-ও এই কথাটা ওকে শুনিয়ে ভারী মজা পেয়েছি গত কয়েক দিনে। যদিও ‘আমাদের টাইম’ মানেই নতুন ভাবনা, নতুন উদ্যোগ আর নতুন কিছু শেখার প্রচেষ্টা। সব সময় যে ছবি নিয়েই, তা নয়। কিছুটা আমাদের একান্ত নিজস্ব গল্প।

অন্য বিষয়গুলি:

Tollywood Celebrity
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy