রাত ১১ টা। বাড়িতে পড়ার টেব্লে দুলে-দুলে বাংলা পড়ছিল ছ’বছরের একটি ছোট্ট মেয়ে। হঠাৎ তার মা মোবাইল নিয়ে এসে তাকে বললেন, ‘‘কথা বল, ফোনে।’’ ফোন ধরে অত্যন্ত সাবলীলভাবে ‘‘হ্যালো’’ বলল আর্শিয়া মুখোপাধ্যায়। যেন ফোনটা তার কাছে আসার কথা ছিল। প্রতিবেদক তার কাছে অচেনা। কিন্তু অচেনা কণ্ঠস্বরের প্রভাব বিন্দুমাত্র আঁচ ফেলেনি আর্শিয়ার গলায়। ‘হ্যালো’ বিনিময়ের পর মিষ্টি সুরেলা স্বরে সে প্রতিবেদককে জিজ্ঞেস করল, ‘‘কেমন আছ তুমি?’’
গত একমাস হল নিয়মিত স্কুলে যাচ্ছে আর্শিয়া। সিরিয়াল চলাকালীন যা হত না। জি ডি বিড়লা স্কুলে ক্লাস ওয়ানের ছাত্রী সে। এই এপ্রিলে ক্লাস টু হবে। ‘‘এখন মেয়ের পড়াশোনায় বেশ মন। রোজ স্কুল থেকে এসে প্রথমেই আমাকে বলে, মা, আজ এর সঙ্গে ঝগড়া করলাম, কাল ওর সঙ্গে ভাব করলাম, আজ এই খেলাটা খেলেছি। স্কুলের আন্টি আমাকে গুড দিয়েছে। এমন হাজারো কথা...’’ গলায় পরম তৃপ্তি আর্শিয়ার মা ভাস্বতী মুখোপাধ্যায়ের। সিরিয়াল চলার সময় প্রতিদিন স্কুলে যাওয়া না হলেও মেয়ের পড়াশোনায় ফাঁক পড়তে দেননি ভাস্বতী। শ্যুটিংয়ের ফাঁকে আলাদা ঘরে মেয়েকে নিয়ে বসে যেতেন, কখনও ছড়া শেখাতে কখনও ম্যাপ দেখে দেশ চেনাতে। তুমি বড় হয়ে কী হতে চাও? উত্তর দিতে বেশি সময় নিল না সে, ‘‘ডাক্তার।’’ তুমি যে এত ভাল অভিনয় করো, বড় হয়ে অভিনেত্রী হতে চাও না? প্রশ্ন শুনে আর্শিয়ার পরিষ্কার উত্তর, ‘‘না, অভিনেত্রী নয় ডাক্তারই হব।’’ শ্যুটিং না স্কুল, কোনটা বেশি মজার? এই প্রশ্নের উত্তর সে দিল একেবার পাকা অভিনেত্রীর মতো, ‘‘দুটোই।’’ এই ‘দুটো’ থেকে তাকে কিছুতেই সরানো গেল না। সমবয়সি অন্যান্য বাচ্চাদের চেয়ে সে যেন একটু বেশিই পরিণত! এটা কি তার জীবনে নতুন সংযোজন নাকি বরাবরই সে এমন? ‘‘ও বরাবর ম্যাচিওর্ড। কোনও বিজ্ঞাপন বা সিনেমা দেখে তা নকল করার অভ্যেস ওর ছোট থেকেই। ওর বাবার (দীপঙ্কর মুখোপাধ্যায়) চাকরিসূত্রে আমরা যখন রাজস্থানে থাকতাম, তখন ওর তিন বছর বয়স। একদিন হঠাৎ দেখি ও কাঁদছে। আমি শশব্যস্ত হয়ে বললাম, ‘কী হয়েছে?’ বলল, ‘কিছু না অভিনয় করছি।’ টিভিতে দেখেছে নায়িকা কাঁদছে, ও সেটাকে নকল করছিল। একদিন অটো স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ বলছে, ‘ছোড় দো..ছোড় দো...’’ আমি ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হল?’ হেসে বলল, ‘অ্যাকটিং করছি মা।’ বুঝুন!’’ হেসে বললেন ভাস্বতী। যে বিল্ডিংয়ে আর্শিয়া থাকে, সেখানে তাঁর বয়সি ছেলেমেয়ে কম, কাছাকাছি খেলার মাঠও নেই। তাই স্কুল থেকে ফিরে আর্শিয়া কখনও মায়ের তৈরি তার প্রিয় পুডিংয়ের বাটি নিয়ে কখনও আবার তার মনের মতো চিকেন খেতে-খেতে মজে যায় টিভিতে প্রিয় কার্টুন ডোরেমনে।
ভাল লাগার জিনিসের মধ্যে আর্শিয়ার সবচেয়ে প্রিয় বার্বি ডলকে। ‘‘জানো, আমার বার্বির দুটো স্যুটকেস আছে, মাফলার আছে, বাড়ি আছে, অনেকগুলো জামা-জুতো আছে! আমি ওকে রোজ সাজাই। দিদির সঙ্গে বার্বি নিয়ে খেলি,’’ আহ্লাদ ঝরে পড়ল আর্শিয়ার গলায়। সেলেব্রিটি মুকুটটা খুলে রেখে আর পাঁচটা সাধারণ বাচ্চার মতো, বাবা-মা, দিদির সঙ্গে জীবন কাটছে তার। কিন্তু মুকুট না থাকলেও সে এখনও অনেকের নয়নের মণি। মা, ভাস্বতী তাই যেন একটু দুঃখ করেই বললেন, ‘‘আগের মতো ওকে সর্বত্র নিয়ে যাওয়া মুশকিল। এই তো দেখুন না, সেদিন একটা বিয়ে বাড়ি গিয়েছি, নিমন্ত্রিতরা বউকে আগে না দেখে সকলের একটাই আবদার, ‘ভুতু আমার সঙ্গে একটা ছবি তোলো।’ খুব অস্বস্তি লাগছিল। সমবয়সিদের সঙ্গে খেলতে পারছিল না বলে বেচারা প্রায় কেঁদেই ফেলে। তাই এখন খুব পরিচিত জায়গা না হলে ওকে নিয়ে যাই না।’’
আরও পড়ুন: রকবাস্টার তনিশ্ক
মাত্র এক মাস হয়েছে সিরিয়াল থেকে ছুটি পেয়েছে আর্শিয়া কিন্তু এর মধ্যেই অন্য সিরিয়ালের অফার এসেছে ভাস্বতী ও দীপঙ্করবাবুর কাছে। কিন্তু তাঁরা চাইছেন আরও বেশ কিছুদিন তাঁর মেয়ে এই স্বাভাবিক জীবনে থাকুক। তারপর তাঁরা ভেবে দেখবেন মেয়ে অভিনয় করবে কি না। আর্শিয়া অবশ্য নিজে এখন স্কুল নিয়েই মেতে আছে। শুধু একটা জিনিসই সে খুব মিস করে। সেটা পটেটো চিপস। সিরিয়ালের শ্যুটিংয়ের সময় নবীনা সিনেমা হলের মালিক তাকে রোজ এক প্যাকেট করে চিপস উপহার দিত। সেটা আর পাওয়া হচ্ছে না। এইটুকুই যা দুঃখ!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy