Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
West Bengal Lockdown

লকডাউনে ধুঁকছে টলিউড, ক্ষতির শঙ্কা ২০০ থেকে ৩০০ কোটির

রাজ চক্রবর্তীর ‘ধর্মযুদ্ধ’, সৌকর্য ঘোষালের ‘রক্তরহস্য’,  অনিকেত চট্টোপাধ্যায়ের ‘হবু চন্দ্র রাজা গবু চন্দ্র মন্ত্রী’— পিছিয়ে গিয়েছে অনেক আগেই। কবে মুক্তি পাবে কেউ জানে না।

শুটিং বন্ধ সবক’টি প্রযোজনা সংস্থার।

শুটিং বন্ধ সবক’টি প্রযোজনা সংস্থার।

স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০২০ ২৩:৪৮
Share: Save:

সিনেমা হলে তালা। স্ট‌ুডিয়োপাড়ায় বহু দিন শোনা যায়নি, ‘লাইট, ক্যামেরা, অ্যাকশন’। থমকে গিয়েছে টলিউড। লকডাউনের দ্বিতীয় পর্যায়ে কেমন করে দিন গুজরান করবেন ইন্ডাস্ট্রির মানুষ?

মে মাস আসতে আর বেশি দিন বাকি নেই। একগুচ্ছ ছবি মুক্তির কথা ছিল মে-র শুরুতে। রাজ চক্রবর্তীর ‘ধর্মযুদ্ধ’, সৌকর্য ঘোষালের ‘রক্তরহস্য’, অনিকেত চট্টোপাধ্যায়ের ‘হবু চন্দ্র রাজা গবু চন্দ্র মন্ত্রী’— পিছিয়ে গিয়েছে অনেক আগেই। কবে মুক্তি পাবে কেউ জানে না। ল্যাপটপ বা স্মার্টফোনেই এখন ছবি দেখা, নিজেকে অভ্যস্ত করে ফেলেছে মানুষ। প্রযোজক, পরিচালক, টেকনিশিয়ান— কার্যত ‘বেকার’ এখন। লকডাউনে নতুন চিত্রনাট্য লিখে ফেলেছেন অনেকেই। কিন্তু পরিচালনা করবেন কোন সাহসে? তৈরি হওয়া ছবির মুক্তির দিনই জানে না টলিউড!

কী ভাবে ঘুরে দাঁড়াবে টলিউড? আদৌ পারবে? শুটিং ফ্লোরে রাত দিন কাটত যাঁদের তাঁরা আজ কী করছেন? কী-ই বা ভাবছেন? আনন্দবাজার ডিজিটাল খোঁজ নিল টলি থেকে টেলিপাড়ার অন্দরে।

আরও পড়ুন: ‘সাম্প্রদায়িক পোস্ট’, টুইটার থেকে সাসপেন্ড কঙ্গনার দিদি রঙ্গোলি

পরিচালক এবং একই সঙ্গে উইন্ডোজ-এর প্রযোজক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের গলায় আতঙ্কের সুর। বললেন, “সব চেয়ে ভয় করছে সিঙ্গল স্ক্রিনের মালিকদের নিয়ে, যাঁদের কোনও গিল্ড নেই। সিনেমা হলে আলো দেখাত যে ছেলেটি, এই সময় তাঁর কী ভাবে চলছে, আমরা কেউ খোঁজ নিয়েছি কি? সিঙ্গল স্ক্রিনগুলো তো এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এই লকডাউনের পরে মনে হয় তালা পড়বে আরও বেশ কয়েকটায়। সিনেমা দেখার পরিসর আরও বেশ খানিকটা কমে যাবে এ বার।”

মে মাসে যে ছবিগুলি মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল, তা যে পিছিয়ে যাবে সে বিষয়ে খানিক নিশ্চিত তিনি। ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পুজো পার হয়ে যেতে পারে — এমনটাই মনে করছেন শিবপ্রসাদ।

ঠিক কতটা ক্ষতি হল?

প্রোডিউসারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শৈবাল বন্দ্যোপাধ্যায় বলছিলেন, “১৮ মার্চ থেকে কাজ বন্ধ। দেখতে দেখতে ১৭ এপ্রিল হয়ে গেল। প্রায় এক মাস সবাই বসে। ১৮ মার্চ অবধি যাঁরা কাজ করেছেন তাঁরা সবাই পারিশ্রমিক পেয়ে গিয়েছেন, বা এ বার পেয়ে যাবেন। কম পারিশ্রমিক পান এমন টেকনিশিয়ানরাও টাকা পেয়েছেন। ঠিক হয়েছে জুনিয়র টেকনিশিয়ান যাঁরা রয়েছেন তাঁদের টাকাটা চ্যানেল দেবে। কিন্তু যাঁরা সিনিয়র টেকনিশিয়ান, তাঁদের রোজগার কিন্তু অনিশ্চিত হয়ে পড়ল।”

সিঁদুরে মেঘ দেখছেন শৈবাল। জুনিয়র টেকনিশিয়ানরা তো টাকা পেলেন, কিন্তু সিনিয়ার টেকনিশিয়ান, আর্টিস্ট, মেকআপ ম্যান, হেয়ারড্রেসার— এঁদের ভবিষ্যৎ কী? “মে আর জুন মাস সিনিয়র আর্টিস্ট, প্রযোজক, টেকনিশিয়ানদের পারিশ্রমিক ছাড়াই কাটাতে হবে। মোটের উপর আগামী ছ’মাস আমাদের কৃচ্ছসাধন করতে হবে।” সতর্কবাণী শৈবালের।

ইতিমধ্যেই বিভিন্ন প্রযোজক সংস্থা থেকে ফেডারেশন তহবিলে দান করা হয়েছে। সুরিন্দর ফিল্মস দিয়েছে ৫ লক্ষ টাকা, এসভিএফ ফিল্মস এবং ম্যাজিক মোমেন্টসও সেই তহবিলে ইতিমধ্যে ৫ লক্ষ টাকা করে দিয়েছে। প্রযোজনা সংস্থা অ্যাক্রোপলিসও হাত গুটিয়ে বসে থাকেনি, তারা দিয়েছে ৩ লক্ষ টাকা। ফেডারেশনের ত্রাণ তহবিলে মোট চল্লিশ লক্ষ টাকা জোগাড় করা হয়েছে। সেখান থেকে কম পারিশ্রমিক বা দিন আনি দিন খাই টেকনিশিয়ানদের অর্থ সাহায্য করা হয়েছে। আর্টিস্ট ফোরামের পক্ষ থেকে অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায় জানিয়েছেন ফেডারেসশনকে তাঁরা তিন লক্ষ টাকা দিয়েছে।

পরিস্থতি খুবই খারাপ, চ্যানেলগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে। এই আকালের দিনে চ্যানেল একটাও বিজ্ঞাপন পাচ্ছে না। চ্যানেলের আর্থিক ক্ষতি মেটাতে এক বছর লেগে যাবে বলে আশঙ্কা শৈবালের। ফলে লকডাউনের পর ধারাবাহিকের সংখ্যাও কমে যেতে পারে বলে মনে করছেন শৈবাল। চলতে পারে বাংলায় ডাব করা হিন্দি ধারাবাহিক। এই জায়গা থেকেই লেখক প্রযোজক লীনা গঙ্গোপাধ্যায় বলছেন, “ টেলিভিশনই পারবে দুর্দিনে ইন্ডাস্ট্রির গতি ফেরাতে। প্রযোজক, শিল্পী, টেকনিশিয়ান, সবাইকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে হবে। দরকার পড়লে সিনিয়র আর্টিস্টদের পারিশ্রমিক কমে যাবে। সেটা মেনে নিতে হবে। প্রযোজক মানেই তাঁর অনেক টাকা এই ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে একে অন্যকে সাহায্য করতে হবে। মনে রাখতে হবে বিনোদন ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারবে না।”

আরও পড়ুন: লকডাউনে ‘হিং’ ফোড়ন, বাড়ি বসেই শর্টফিল্ম অপরাজিতা-মানালির

শুধু কি ধারাবাহিক? গৃহবন্দি মানুষ তো ছবি থেকে ওয়েবসিরিজ সব কিছুই এখন অনলাইনে দেখছেন। সেই দিকে আলোকপাত করে পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায় বললেন, “পরিস্থিতি মানুষকে বাধ্য করেছে বাড়িতে বসে ওয়েব সিরিজ দেখার। তাই সেই অভ্যাসে ওয়েব সিরিজের সংখ্যা বাড়বে। অনেক মানুষ ওয়েব সিরিজে কাজ করবেন। তবে সিনেমা হলে লকডাউন উঠলেও মানুষ হলে গিয়ে এখন সিনেমা দেখতে চাইবে না। আর বলিউডের বেশ কয়েকটা ছবিও আটকে আছে। লকডাউন উঠলে সেই ভিড়ে বাংলা সিনেমা খুব বেশি জায়গা করে নিতে পারবে না। বহু প্রতীক্ষিত বড় মাপের বাংলা ছবিই হয়তো হলে মুক্তি পাবে।”

সৃজিতের মতামত থেকে সরে গিয়ে শিবপ্রসাদ যদিও মনে করছেন “ওয়েব সিরিজ যারা দেখছে তাদের অধিকাংশ হিন্দি বা ইংরেজি ওয়েব সিরিজ দেখে। বাংলায় উল্লেখযোগ্য পরিচালকেরা এগিয়ে না এলে বাংলা ওয়েব সিরিজ ইন্ডাস্ট্রিতে বাংলা জায়গা করতে পারবে না।” যদিও সৃজিতের মতোই শিবপ্রসাদও মনে করেন বাংলা ছবি রিলিজের দিন ঠিক করা লকডাউনের পর মুশকিল হয়ে যাবে। আগে দেখতে হবে সলমন বা অক্ষয়কুমারের বিগ বাজেটের ছবি কবে আসছে? হলিউডের ছবি মাল্টিপ্লেক্সে কোথায় কখন জায়গা নিচ্ছে। সেই মতো বাংলা ছবিকে ঢুকতে হবে।

মার্চের মাঝামাঝি থেকেই ঘরবন্দি রয়েছেন পরিচালক রাজ চক্রবর্তী। ১০ এপ্রিল মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল তাঁর ছবি ‘ধর্মযুদ্ধ’। লকডাউনের জেরে পিছিয়েছে তা। রাজ বলছিলেন, “এমন একটা পরিস্থতির মধ্যে রয়েছে, যা আগে কখনও দেখিনি। লকডাউন উঠলে ইন্ডাস্ট্রির কী হাল হবে, সত্যিই তা জানি না। লকডাউন যে আদৌ কবে শেষ হবে তা বুঝতে পারছি না। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি একটা বিরাট বড় জগৎ, অনেক মানুষ সেখানে একসঙ্গে কাজ করেন। লকডাউন খোলার পর সবার মানসিক অবস্থা কেমন থাকবে, সেটাও কেউ জানি না।” রাজের কথায় “অনেক কিছু ভেবেছিলাম। প্রতি মুহূর্তে ফিলিংসটা চেঞ্জ হচ্ছে। এখন পুরো ব্ল্যাঙ্ক হয়ে গিয়েছি। টেলি ইন্ডাস্ট্রি হয়তো ঘুরে দাঁড়াতে পারবে, কিন্তু ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির কী হবে, জানি না। আমার দু’টো ছবি 'ধর্মযুদ্ধ' এবং 'হাবজি-গাবজি'-র টাকা আটকে রয়েছে, প্রচুর টাকা ইনভেস্ট করেছি সেখানে। জানি না কী হবে!”

আরও পড়ুন: সানি লিওনি কী দিয়ে মাস্ক বানিয়েছেন জানেন?

এই অনিশ্চয়তা চরম আর্থিক সঙ্কটের মুখে ফেলে দেবে ইন্ডাস্ট্রিকে, মনে করেন পরিচালক অরিন্দম শীল। “বাংলা চলচ্চিত্রে অন্তত ২০০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার ক্ষতি। ন্যাশনাল মাল্টিপ্লেক্সের মালিকদের সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি দীপাবলির আগে কিছু স্বাভাবিক হবে বলে তাঁরা মনে করছে না।” অরিন্দমের পাল্টা প্রশ্ন,“শুটিং শুরু করব কী করে আমরা? কমপক্ষে ৮০ থেকে ১০০ জনের ইউনিট। সেটাও তো জমায়েত! প্রাণের ভয়ের চেয়ে বড় ভয় কী আছে আর? এত দিন সিনেমা রিলিজ না হলে আমরা টানব কী করে? বাংলা ইন্ডাস্ট্রি এত দিন সার্ভাইভ করতে পারবে না!” হিসেব কষে বুঝিয়ে দিলেন অরিন্দম।

বেশ কিছু বছর হল অভিনয়ের পাশাপাশি প্রযোজনাতেও হাত পাকিয়েছেন দেব। এই অচেনা পরিস্থিতিতে আগেভাগে কিছু ভাবতে নারাজ তিনি। কী হতে চলেছে, কী হবে, ইন্ডাস্ট্রি কোন দিকে এগোবে, তা নিয়ে দেবও সন্দিহান। “সিনেমা দেখাটা মানুষের কাছে লাক্সারি। মানুষের কাছে যখন একটু বাড়তি টাকা থাকে, তখন সে বন্ধুবান্ধব, পরিবারের সঙ্গে সিনেমা দেখে। লকডাউন উঠলে সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক অবস্থা ঠিক কী হতে চলেছে তার উপরেই নির্ভর করবে মানুষ আদৌ সিনেমা দেখবে কি না। সিনেমা হল চালু হলেও বেশি ভিড়ে না যাওয়ার ব্যাপারটা মানুষের মনের মধ্যে অবিরাম চলতে থাকবে। আমি তো পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি, আগামী দু’বছর প্রতিটা মানুষ মাস্ক পরে ঘুরছে। এর মধ্যেও পজিটিভ থাকার চেষ্টা করছি”, বললেন দেব।

ভাবব না বললেও সামনে যে কঠিন সময় এ বিষয়ে নিশ্চিত টলিউড। সকলের মনে একটাই প্রশ্ন, ২০২০ কি ইন্ডাস্ট্রি থেকে মুছে যাবে চিরতরে? সামনে অনেক ঝড়! তবে কেউ হাল ছাড়ার পাত্র নয়।

এত অন্ধকারের মধ্যেও ভরা হল, হাততালি আর উচ্ছ্বাসের অপেক্ষায় প্রহর গুণছে টলিউড।

(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy