বাংলা ভাষায়, কলকাতার প্রেক্ষাপটে, থ্রিলার দেখতে ইচ্ছুক দর্শকদের ‘মুখোশ’ দেখে খুশি হওয়ারই কথা।
সিরিয়াল কিলারের জন্ম হয় সামাজিক বঞ্চনা থেকে। এটাই মুখোশের গল্প। এ গল্প বহু আগে থেকে প্রচলিত। ভিক্টোরিয় আর এডোয়ার্ডিয় যুগের সন্ধিক্ষণে পৃথিবী সব থেকে ভয়ঙ্কর এবং এখনও পর্যন্ত অমীমাংসিত রহস্য ‘জ্যাক দ্য রিপার’-কে দেখে, যাকে ঘিরে তৈরি হয় শার্লক হোমসের ‘দ্য লাইং ডিটেক্টিভ’। চাঁদ-সূর্য বা গঙ্গা-যমুনা পুরনো। তাতে ক্ষতি কিছু নেই ; অন্তত সিনেমায় যদি গল্প বলে দর্শককে বসিয়ে রাখা উদ্দেশ্য হয়।
‘মুখোশ’ সেই বাবদে একশ ভাগ সফল। হলিউড বা হিন্দি ছবির ডাব নয়। বাংলা ভাষায়, কলকাতার প্রেক্ষাপটে, বাংলায় থ্রিলার দেখতে ইচ্ছুক দর্শকদের ‘মুখোশ’ দেখে সত্যিই খুশি হওয়ার কথা। সম্পর্ক, পরিবার, সমাজের গণ্ডির বাইরে গিয়ে বাংলা ছবি করার এই চেষ্টাটাই যথেষ্ট প্রশংসনীয়।
থ্রিলারে গতি সব থেকে জরুরি। এই গল্প অনেক দূর পর্যন্ত সেটা অনায়াসে ধরে রাখে।
এ ছবিতে পুলিশ এবং খুনি ছাড়াও একজন অপরাধ মনোবিজ্ঞানী রয়েছে যে এ ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র, কিংশুক ( অনির্বাণ ভট্টাচার্য)। গল্পের সঙ্গে এই মনোবিজ্ঞানীকে অত্যন্ত যথাযথভাবে বাঁধা আছে। ছবির শুরুতে আগ্রহী ছাত্র হিসেবে সে আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ডেভিড পলের বক্তৃতা শুনতে আসে, দেখা করে এবং অভিভূত হয়। যে কোনও অধ্যাপকের মত তিনিও আগ্রহী এবং বুদ্ধিমান ছাত্র কিংশুককে অপরাধ মনোবিজ্ঞানের ওপর তাঁর নিজের মনোভাব প্রকাশ করেন।এই ধরণের মানুষের মনের তিনটি গতি নির্দেশ করেন। কিংশুক কাজের জগতে একজন ক্রিমিনোলজিস্ট হয়ে ঢুকে, পুলিশ অফিসার অদ্রিশ বর্মনের সাহায্যে এক জন সিরিয়াল কিলার যার পরের দিন ফাঁসি হবে, তার সঙ্গে কথা বলে।
ইতিমধ্যে একজন পুলিশ অফিসার খুন হয়, যার হৃদয় কেটে বার করে নেওয়া হয়েছে এবং সেই জায়গায় একটি ক্রশ ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। পোস্ট মর্টেমের রিপোর্ট জানায় হৃদয় বার করে নেওয়ার সময় সে জীবিত ছিল। ভয়াবহ নৃশংসতা! স্পেশাল ব্রাঞ্চের অফিসার কাবেরি ( চান্দ্রেয়ী ঘোষ) এই তদন্তের দায়িত্ব নিয়ে আসে। সঙ্গে থাকে অদ্রিশ বর্মন, ইন্দ্রনীল এবং ক্রিমিনোলজিস্ট হিসেবে কিংশুক। পুলিশ প্রতিপদে দূরে সরতে থাকে খুনির কাছে। কখনও পুলিশ খুন করে, কখনও কারুর বাড়িতে ভয়াবহ কিছু পৌঁছে দিয়ে, কখনও পুলিশের সার্ভিলিয়েন্স হ্যাক করে খুনি বুঝিয়ে দেয় সে কতখানি মারাত্মক! হাড় হিম হয়ে যায়। ইন্সপেক্টর কাবেরীকে অপ্রত্যাশিত ভাবে কিংশুক খুনির সন্ধানে দিক নির্দেশ করতে পারে, এমন একজন অন্ধ শিল্পীর সন্ধান দেয়। দ্রুত তদন্তের জন্য ওপরতলার প্রোটোকল না মেনেই কাবেরী কিংশুক আর অদ্রীশকে সেখানে পাঠায়।
কিংশুক হিসেবে অনির্বাণের অভিনয় নিঃসন্দেহে ভাল।
থ্রিলারে গতি সব থেকে জরুরি। এই গল্প অনেক দূর পর্যন্ত সেটা অনায়াসে ধরে রাখে। প্রত্যেক খুনের কাছে পড়ে থাকা ক্রশ আর বাইবেলের লাইন বলে দেয় খুনি ক্রিশ্চান। তাই কিংশুক শিল্পীর দিক নির্দেশ মত পাহাড়ে একজন অধ্যাপকের সঙ্গে যখন কথা বলতে আসে তখন থেকেই গল্পটা প্রত্যাশিত পথ নেয়। তাতেও ছবি গতি হারায় না। চিত্রনাট্যের বাঁধুনি না থাকলে এমনটা সম্ভব হত না। গল্পের শুরুও যথেষ্ট মন কাড়ে। মুখোশে সম্পাদনা শুধুমাত্র নির্দেশনা বা চিত্রগ্রহণের সঙ্গে সঙ্গত করে গেছে বললে কম বলা হবে। সম্পাদনার কাজ আলাদা করে প্রশংসার দাবি রাখে। হলিউড বা মুম্বাইতে সফলভাবে অনেক বেশি থ্রিলার গল্প হয়েছে। তুলনায় বাংলায় উপকরণ সীমিত। অনেক ক্ষেত্রে আবার সমস্ত গল্প বাংলায় করতে গেলে কিছুটা শক্ত হয়ে পড়ে । নিঃসন্দেহে মুখোশ সেই চ্যালেঞ্জ নিয়েছে এবং উতরে দিয়েছে। তবে মানুষের মনের অন্ধকার দিক তুলে ধরেছে বলে চিত্রগ্রহণ অতটা অন্ধকার না হলেও চলত। সরাসরি রক্তাক্ত হার্ট অপারেশন দেখিয়ে খুনির নৃশংসতা প্রমাণ করার খুব প্রয়োজন ছিল না। কিংশুক এবং রাইয়ের সম্পর্ক চিত্রনাট্য এবং চিত্রগ্রহণ দু’দিক থেকেই একটু উজ্জ্বল। তাঁদের রসায়ন একটু স্পষ্ট হলে ভাল হত।
পাহাড়ে গল্পের খানিকটা অংশ রয়েছে। তাই পাহাড়ের মনোরম বেশ কিছু বহির্দৃশ্য দেখালে ছবি সমৃদ্ধ হবার সম্ভাবনা ছিল। অভিনয়ে ছোট ছোট ভূমিকায় তরঙ্গ রক্ষিত, নন্দিনী, কমবয়সী সুজিকে মনে থাকে। অল্প সময়ে কৌশিক সেন ( শিল্পী) হতাশ করেন নি। অদ্রীশ বর্মনের চরিত্রে অনির্বাণ চক্রবর্তী অসম্ভব বিশ্বাসযোগ্য। কিংশুক হিসেবে অনির্বাণের অভিনয় নতুন করে বলার কিছু নেই। অনির্বাণ নিঃসন্দেহে ভাল অভিনেতা।
এই ধরণের ছবির খুঁটি হল প্রোডাকশন ভ্যালু। বার বার দেখা গল্প যে জন্য দেখতে ইচ্ছে করে। নির্দেশক, চিত্রনাট্যকার, চিত্রগ্রাহক, সম্পাদক এ কাজে সফলভাবে এগিয়ে এসেছেন। কিন্তু ছবির সেট, রূপটান আর পোশাক ছবিটা আর একটু এগিয়ে যাবার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।
কিংশুক (অনির্বাণ) যেখানে ছাত্র হিসেবে অধ্যাপক পলের (টোটা রায়চৌধুরী) মুখোমুখি হয় দুজনকে প্রায় সমবয়সী দেখায়। ভাল ছাত্র এবং ক্রিমিনোলজিস্টের লুকটা একেবারে পাওয়া যায় না।পাওয়া গেলে তা অনির্বাণের দক্ষ অভিনয়কে ঢের বেশি সাহায্য করতে পারত। যেটা চান্দ্রেয়ী, টোটা আর মাত্র একটা দৃশ্যে সোহিনীর ক্ষেত্রে হয়েছে। কাবেরী এবং পলের চরিত্রে চান্দ্রেয়ী আর টোটার অনবদ্য অভিনয় মনে রাখার মত। শব্দের একটা বড় ভূমিকা থাকে রহস্যরোমাঞ্চ ছবিতে। মুখোশ সে দিকটা খুব খুঁড়ে দেখেনি। কৌশিক সেনের চোখের রূপটান, চারদিকে না সবুজ , না নীল দেওয়াল, অযৌক্তিক আসবাবপত্র, পোশাকে বৈচিত্র্যহীন রঙের ব্যবহার ছবিকে বড় দীনহীন করে দেয় । গল্প এবং চরিত্র মাথায় রেখে এ দিকগুলোতে মন দিলে ঝকঝকে তৈরি ছবি আরও উজ্জ্বল হত। নান্দনিক দিক অবহেলা করে শিল্প হয় না, বাণিজ্যিক ছবি হয়, এ ধারণা থেকে বেরিয়ে আসার সময় এসেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy