Advertisement
৩০ অক্টোবর ২০২৪
Sanjay Mukherjee

বাংলা চলচ্চিত্রের শতবর্ষ! কে বলল?

অবশেষে ক্যানসার রোগে এক নিঃসঙ্গ মৃত্যু— তার মাত্র দু’দিন আগে হাতিবাগানে বিধ্বংসী আগুনে পুড়ে গিয়েছে তাঁর যাবতীয় নির্মাণ। আজ সকলেই বুঝতে পারেন, যা পুড়েছিল, তা বাংলা সিনেমার কপাল। তা শুধু হীরালাল সেনের ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়।

গ্রাফিক- শৌভিক দেবনাথ।

গ্রাফিক- শৌভিক দেবনাথ।

সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০১৮ ১৭:৩৫
Share: Save:

বাঙালির ইতিহাস নেই— এ জাতীয় আক্ষেপ ছিল বঙ্কিমচন্দ্রের। মনে হয় কথাটা পুরোপুরি সত্যি নয়। আমাদের ইতিহাস আছে। তবে তা অনাথ বালকের মতো। মাঝে মাঝে নতুন জামাকাপড় দিয়ে সাজানো হয় তাকে। কারওর ইচ্ছে হল তো স্টেশনের নাম পাল্টে গেল। কারওর ইচ্ছে হল তো বাংলা চলচ্চিত্রের শতবর্ষ পালন করা গেল ২০১৮-তে। সকলি তোমারই ইচ্ছা!

আসলে যে হীরালাল সেন এই উপমহাদেশে চলচ্চিত্রের জনয়িতা বলে আমরা দীর্ঘ দিন চায়ের পেয়ালায়, মতান্তরে সুরাপাত্রে তুফান তুলেছি, আমাদের চলচ্চিত্র রসিকরা অনেকেই তাঁকে দাদাসাহেব ফালকের পূর্ববর্তী বলে দাবি করে গেলেন, এমনকি, এই চলচ্চিত্র উৎসবের মঞ্চ থেকেই বছর দুয়েক আগে শ্রীযুক্ত অমিতাভ বচ্চন স্বয়ং তাঁকে প্রবর্তকের মর্যাদা দিয়েছিলেন। সেই ইতিহাস চেতনা হঠাৎ হীরালালের শতবর্ষের পরের বছরেই মুছে দিতে হল কেন? হীরালাল তো বিজেপি অথবা সিপিএম ছিলেন না!

সত্যি বলতে কি, ভারতীয় উপমহাদেশে চলচ্চিত্রের জন্মক্ষণ নিয়ে সংশয়ের অবসান হয়নি। মহারাষ্ট্রেও এ বিষয়ে দ্বিধা আছে। রাজা হরিশচন্দ্র মুক্তি পাওয়ার অন্তত এক বছর আগে, ১৯১২ সালের ১৮ মে মুক্তি পেয়েছিল শ্রীরামচন্দ্র গোপাল তোরণের তত্ত্বাবধানে তৈরি ২২ মিনিটের ছবি শ্রী পুন্ডলিক। অনেকে বলেন, সেটি ভারতের প্রথম কাহিনিচিত্র। যেমন কলকাতার প্রায় সকলেই দাবি করেন, হীরালাল সেনের ‘আলিবাবা’ মুক্তি পায় ১৯০৩ সালে— যদিও এর খণ্ডাংশ দফায় দফায় শুরু হয়েছিল ১৯০০ সাল থেকেই। অর্থাৎ, শ্রুতকীর্তি অধ্যাপক দীনেশচন্দ্র সেনের এই মামাতো ভাই যে আমাদের মন্থর গ্রামীণ সমাজের শিল্পের দিক থেকে আধুনিকতার বকলমে এক ধরনের সক্রিয় কারিগরি হস্তক্ষেপ, তা স্পষ্ট স্বরে বলতে আমাদের সামর্থের অভাব আরও স্পষ্ট। বরং, তাঁর যে সুবিখ্যাত গতি চিত্রগুলি রয়েছে, যেমন ১৯০৩ সালের করোনেশন দরবার চিত্র বা ১৯০৫ সালের টাউন হলে ঐতিহাসিক বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের চিত্র অথবা নানা সামাজিক দৃশ্যাবলী, যেমন চিৎপুর রোডের চলমান চিত্র, রাজেন মল্লিকের বাড়ির বিয়ের সমারোহ— এ সব উপেক্ষিতই থেকে গিয়েছে।

রাজা হরিশচন্দ্র ছবির পরিচালনার মুহূর্তে দাদাসাহেব ফালকে। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।

এমনকি এই উপমহাদেশে বিজ্ঞাপন চিত্রের তিনিই পথিকৃৎ। দমদম ও আগরপাড়ার বাগানবাড়িতে সি কে সেনের ‘জবাকুসুম তৈল’ ও ‘এডওয়ার্ডস অ্যান্টি ম্যালেরিয়াল স্পেসিফিক’ প্রচারচিত্র তুলেছেন তিনি। তবু আমরা আলোকচিত্রী, দলিল ও বিজ্ঞাপন চিত্রনির্মাতা হীরালাল সেন বিষয়ে উৎসাহ দেখাইনি। আমাদের যাবতীয় মনোযোগ তিনি বঙ্কিমবাবুর ‘ভ্রমর’ অথবা ক্ষিরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের ‘আলিবাবা’ গতি চিত্রায়িত করেছিলেন কি না, তা মানার জন্য। সেখানেও ১৯০১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অমৃতবাজার পত্রিকা জানাচ্ছে যে, ‘Series of Superfine Pictures From Our World Renowned Plays- Alibaba, Buddha, Sitaram etc. will be produced to the Extreme Astonishment of Our Patrons.’ ওই একই বছরের দোসরা ফেব্রুয়ারি ‘দি বেঙ্গলি’ নামের সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপন আমাদের জানায়, অমরেন্দ্রনাথ দত্তের পূর্বোক্ত ক্লাসিক থিয়েটারে তাঁর নাট্য প্রদর্শনীর মধ্যে ‘ভ্রমর’, ‘আলিবাবা’, ‘দোললীলা’, ‘সরলা’ ইত্যাদি চমকপ্রদ চিত্র প্রদর্শিত হবে। চিত্রনির্মাতা, বলা বাহুল্য, ছিলেন হীরালাল সেন।

দুঃখের বিষয়, হীরালাল সেনের কৃত-কুশলতা থাকলেও ব্যবসা বুদ্ধি ছিল না। তাঁর বঙ্গভঙ্গ বিরোধী ছবিটি মুহূর্তের অমনোযোগে ম্যাডানদের এলফিনস্টোন বায়োস্কোপের হাতে। এক দিন বাধ্য হয়ে নিজের স্বপ্নের ক্যামেরা বিক্রি করেছিলেন বিখ্যাত সুদখোর আংটি মল্লিকের কাছে। ক্রেতার দু’হাতে ১০টি আংটি বলেই এমন সুনাম অর্জন করেছিলেন। অবশেষে ক্যানসার রোগে এক নিঃসঙ্গ মৃত্যু— তার মাত্র দু’দিন আগে হাতিবাগানে বিধ্বংসী আগুনে পুড়ে গিয়েছে তাঁর যাবতীয় নির্মাণ। আজ সকলেই বুঝতে পারেন, যা পুড়েছিল, তা বাংলা সিনেমার কপাল। তা শুধু হীরালাল সেনের ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়।

আরও পড়ুন: কেউ কেউ বলছেন এ বার আমাকে ভাতে মারা হবে, মারবে, রুটি খাব

অনস্বীকার্য যে এই এলফিন স্টোন বায়োস্কোপ কোম্পানি অর্থাত্ ম্যাডান থিয়েটারস ১৯১৭ সালে ‘সত্যবাদী রাজা হরিশচন্দ্র’ ও দু’বছর বাদে ১৯১৯ সালে ‘বিল্বমঙ্গল’ নামের দুটি কাহিনিচিত্র বানায়। শেষোক্তটি সম্প্রতি পুনরুদ্ধার করা গেছে। কিন্তু তার মানে তো এই নয় যে বাংলা চলচ্চিত্রের জন্মক্ষণে ম্যাডান কোম্পানি ছিল ধাত্রীদেবতা! আন্তর্জাতিক ভাবে ইউনেস্কো যখন সিনেমার শতবর্ষ পালন করেছিল তখন কোনও দৃষ্টান্ত দেখানো হয়েছিল? না, ফরাসি দেশে লুমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয় ১৮৯৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর প্রথম চলমান চিত্রমালার প্রদর্শনী করে। সেই তথ্যটিই আবিশ্বে সম্মানিত হয়, আমাদের দেশেও ১৯৯৫ সালে সাড়ম্বরে চলচ্চিত্রের শতবর্ষ উদযাপন হয়েছিল। লুমিয়ের ভাইয়েরাও কাহিনিচিত্র দেখাননি। ‘গেয়ার দু নরদ স্টেশনে ট্রেন ঢুকছে’ বা ‘ ছুটির পর কারখানার মজুরেরা বেরিয়ে এলো’— এ সব হীরালালের মতোই বাস্তব জীবনের নির্বাক, অসম্পাদিত ও টুকরো চলমান দৃশ্য। তা হলে বাংলা চলচ্চিত্রের শতবর্ষ তো হীরালাল সেনের কার্যক্রমের সূত্রেই ২০০১ সালে হয়ে গেছে। অলৌকিক সমাপতন এই যে হীরালালের মৃত্যুর একশো বছর কেটে গেল গত বছর। জীবনানন্দ থাকলে বলতেন — ‘জীবনের, মরণের, হেমন্তের এরকম আশ্চর্য নিয়ম/ ছায়া হয়ে গেছ বলে এমন অসম্ভ্রম!’

আরও পড়ুন: সুজিতের পরিচালনায় এ বার শিখ সেনার চরিত্রে অমিতাভ

কোন প্রেরণায় যে হীরালাল লা়ঞ্ছনা সুসম্পন্ন হল তা বোঝা দুরূহ, তবে ইতিহাসের দায় যদি কতিপয় বিদূষক ও স্তাবকের হাতে পড়ে তা হলে এমন মস্করা অস্বাভাবিক নয়। এমনকি কলকাতার এই উত্সবেও তথ্যচিত্র ও ছোটছবি দেখানো হচ্ছে। হীরালাল সেন বিষয়ে একটি কাহিনিচিত্রও আছে। শুধু হীরালাল সেন বাদ! ডেনমার্কের যুবরাজকে বাদ দিয়ে হ্যামলেটের জন্মদিন পালনের একটা নজির তবু স্থাপিত হল তো! ধন্য ব়ঙ্গভূমি!

(মুভি ট্রেলার থেকে টাটকা মুভি রিভিউ - রুপোলি পর্দার সব খবর জানতে পড়ুন আমাদের বিনোদন বিভাগ।)

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE