তরুণ মজুমদার এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে নেওয়া।
চলচ্চিত্রে ‘জুটি’ কি কেবল নায়ক-নায়িকারই হয়? বা নায়ক-নায়িকার সঙ্গে নেপথ্য কণ্ঠশিল্পীর? না। জনপ্রিয় জুটি হতে পারেন চিত্রপরিচালক আর সঙ্গীত পরিচালকও। তরুণ মজুমদার আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের দীর্ঘ ২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে যে যৌথযাত্রা, চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তার দ্বিতীয় নজির খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তনুবাবু (এই নামেই তরুণ পরিচিত ছিলেন সিনেমাজগতে) যখন ‘যাত্রিক’-এর ব্যানারে ‘চাওয়া পাওয়া’ ছবির পরিচালক (শচীন ও দিলীপ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে), তখন নচিকেতা ঘোষের সুরে সেরা সময়ের হেমন্ত গেয়েছিলেন, ‘যদি ভাবো, এ তো খেলা নয়...।’
সেই অর্থে ‘পলাতক’ ছবি থেকেই তরুণ-হেমন্তর একত্রযাত্রার সূচনা। এই ছবির গানগুলি হবে লোকসুরাশ্রিত— তা বুঝে হেমন্ত প্রথমে ফিরিয়ে দেন তনুবাবুকে। বলেন, ‘‘লোকসঙ্গীতে আমি ‘মাটো’ আছি।’’ পরে নাছোড় তরুণের জেদের কাছে এক প্রকার হার মানেন হেমন্ত। ছবিতে যখন হেমন্ত-কণ্ঠে শোনা যায়, ‘জীবনপুরের পথিক রে ভাই’ (অভিনয়ে অনুপকুমার), বা ‘দোষ দিয়ো না আমায় বন্ধু’, তখন বোঝা যায়, পরিচালকের নির্বাচন কতখানি সার্থক ছিল। পলাতকের হিন্দি ‘রাহগীর’-এও হেমন্ত সঙ্গীত পরিচালক ও মুখ্য গায়কের ভূমিকা নেন।
এর পর থেকে তরুণের ছবিতে হেমন্ত নির্বিকল্প হয়ে ওঠেন। ‘ফুলেশ্বরী’র মতো ছবিতে শমিত ভঞ্জর লিপে হেমন্ত-কণ্ঠ মিলেমিশে যায়। কখনও লোকসুর, কখনও পুরোদস্তুর আধুনিক, আবার কখনও রবীন্দ্রনাথের গান, দ্বিজেন্দ্রগীতি, এমনকি, খেউড় গানের সুর দরকার মতো তরুণবাবুর ছবিতে জুগিয়ে যান হেমন্ত। ‘আলোর পিপাসা’ ছবিতে সুর বসান কালিদাসের সংস্কৃত স্তোত্রে, দেহাতি সুরের চাল নিয়ে আসেন ‘সংসার সীমান্তে’ ছবিতে। ‘দাদার কীর্তি’ ছবিতে নবীন নায়ক তাপস পালের ঠোঁটে দু’টি রবীন্দ্রগান ওই ‘ছবির গান’ হয়েই দীর্ঘ দিন থেকে যায় বাঙালি-মানসে। ‘বালিকা বধূ’, ‘নিমন্ত্রণ’, ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’, ‘খেলার পুতুল’ ইত্যাদি ছবিতেও এই জুটি স্বর্ণফসল ফলিয়েছে।
অনেক শিল্পীকে দিয়ে তরুণের ছবিতে গাইয়েছেন হেমন্ত। ‘ফুলেশ্বরী’, ‘গণদেবতা’, ‘দাদার কীর্তি’র মতো ছবিতে মান্না দে-কে ব্যবহার করেন সঙ্গীত পরিচালক হেমন্ত। ‘কুহেলি’ ছবিতে লতাকণ্ঠে ‘কে জেগে আছ’ ভুলতে পারবে কি বাঙালি দর্শক? আরতি মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠও তরুণবাবুর ছবিতে হেমন্ত ব্যবহার করেন। অরুন্ধতী হোমচৌধুরী সুযোগ পান তরুণ মজুমদারের ছবিতে। হেমন্তের সুরে চমৎকার গেয়েছেন তিনিও।
হেমন্ত-তরুণের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ওঁদের আড়াই দশকব্যাপী নিরবচ্ছিন্ন সংযোগের একটা বড় কারণ। তরুণের সঙ্গীতবোধের প্রতি আস্থা রাখতেন হেমন্ত। বলতেন, ‘‘তনুবাবুর মতো রবীন্দ্রনাথের গান কোনও পরিচালক বোঝেন না।’’ আবার তরুণ মজুমদারের কথায়, ‘‘হেমন্তবাবু থাকলে আর কিছুই দরকার নেই।’’ এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করতে হয়। জলমগ্ন কলকাতার রাস্তা উজিয়ে স্টুডিয়োতে এসে গাড়ি থেকে হারমোনিয়াম বার করে বন্ধু তরুণের ঘরে বসে আদ্যোপান্ত চণ্ডালিকা গেয়ে যাচ্ছেন খ্যাতির মধ্যগগনে থাকা হেমন্ত— স্মৃতিমেদুর তরুণ এই ঘটনা কত জায়গায় যে বলতেন!
বস্তুত, আশির দশকের মাঝামাঝি অসুস্থ হেমন্তকেও ছাড়তে চাননি তরুণ। ‘ভালবাসা ভালবাসা’ ছবিতে তাপস-কণ্ঠে সুরকার হেমন্ত নিয়ে আসেন উদীয়মান শিবাজী চট্টোপাধ্যায়কে। হেমন্ত-সুরে ‘খোঁপার ওই গোলাপ দিয়ে’ শিবাজীকে রাতারাতি জনপ্রিয় করে দেয়।
শেষের দিকে ‘আগমন’, ‘পরশমণি’ ছবিতে তরুণ-হেমন্ত জুটি অবিচ্ছিন্ন থাকলেও তাঁর ছবিতে নায়ক-কণ্ঠে তেমন ভাবে আর পাওয়া যায়নি হেমন্তকে। তরুণের ছবি ‘আপন, আমার আপন’-এ সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন রাহুল দেব বর্মণ। সেই ছবিতে ছোট্ট একটি দৃশ্যে নিজের চরিত্রেই অভিনয় করেন হেমন্ত। আরও একটি তথ্য উল্লেখ করার মতো। নিধুবাবুর জীবন-আশ্রিত ‘অমর গীতি’ ছবিতে টপ্পা গানগুলির জন্য রামকুমার চট্টোপাধ্যায়কে সঙ্গীত-উপদেষ্টা হিসাবে নিয়ে আসা হলেও ছবির সঙ্গীত পরিচালক হেমন্তই ছিলেন।
‘ঠগিনী’ ছবিতে অনুপকুমার অভিনীত চরিত্রটি রেকর্ড-প্লেয়ারে ‘যৌবনসরসীনীরে’ গানটি বাজানোর আগে বলেছিল, ‘‘হেমন্ত, মাই ফেভারিট!’’ চরিত্রের মুখ দিয়ে আসলে কি বলেছিলেন তরুণই!
পারস্পরিক গুণগ্রাহিতা, সম্মানবোধ ওঁদের কাজে প্রতিফলিত হয়েছে শেষ দিন পর্যন্ত। ১৯৮৯ তে জুটি ভেঙে চলে যান হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। তার ৩৩ বছর পর বিদায় নিলেন তরুণ মজুমদার। প্রযুক্তির দাক্ষিণ্যে থেকে গেল তাঁদের কাজ, বাঙালিকে যার কাছে ফিরে ফিরে যেতেই হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy