গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।
দীর্ঘদিন ধরেই শোনা গিয়েছিল বলিউড পুরুষতান্ত্রিক। যতই বলিউড ‘কুইন’ বা ‘গুলাব গ্যাং’ এর ছবি তৈরি করে মেয়েদের প্রাধান্যকে প্রতিষ্ঠা করুক, আসলে পুরোটা ‘আই ওয়াশ।’ নায়কের পারিশ্রমিক আজও একই ছবিতে নায়িকার তুলনায় বেশি। চলছিল এ ভাবেই। মুখে ‘উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট’ কাজে ‘জেন্ডার হায়ারার্কি। আগে নায়ক পরে নায়িকা।’
চলছিল এ ভাবেই।
তনুশ্রী দত্ত-নানা পাটেকরের বিতর্ক অগ্নিতে ঘি ঢালল। মুখোশ ছেড়ে বেরিয়ে এল পুরুষালি মুখের চাপা হুঙ্কার। বলিউড নারী ও পুরুষ দু’ শিবিরে ভাগ হয়ে গেল।
একজন অভিনেত্রী বলছেন বলিউডে কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা হলে সকলে চুপ করে থাকে বা সকলকে চুপ রাখা হয়। এই কথা শোনার পর কী করেই বা চুপ থাকেন বি টাউনের পুরুষকুল? যেমন-শক্তি কপূর! তনুশ্রী দত্তের নাম উচ্চারণ না করে ব্যঙ্গ করে বললেন, 'দশ বছর আগের ঘটনা। আমি তখন বাচ্চা তো! এ নিয়ে বলার কী আছে!'
সত্যি খুব হাস্যকর ঘটনা যেন! ফুঁ মেরে উড়িয়ে দিলেই হল।
এমনটাই হয়ে আসছে মুম্বই ইন্ডাস্ট্রিতে। সলমন খান রেগে গেলে তাঁকে ক্ষমা করে দেয় ইন্ডাস্ট্রি। ঐশ্বর্যা নিজেই বলেছিলেন ‘মাতাল সলমন’ এর নানারকমের মানসিক, শারীরিক অত্যাচারের কথা। কেউ খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। আর তাঁর কেরিয়ারে কোনো আঁচড় পড়েনি। পরেও না। গোবিন্দা সেটে রেগে গিয়ে একজনকে চড় মারলে ইন্ডাস্ট্রি বলে ‘‘ও খুব ভাল মানুষ। এমন হতে পারে না।’’
আরও পড়ুন: ট্যাঙ্ক টপ, আধখোলা ডেনিম জ্যাকেট, সঙ্গে অমলিন হাসি, ফের ভাইরাল সুহানা
কিন্তু তনুশ্রী বিতর্কর রেশ বাড়ছে বই কমছে না। পুরুষ শিবিরে একে একে প্রচুর পোস্ট আর কমেন্ট।
‘উদার’, ‘মানবিক’, ‘পরোপকারী’, ‘গরীবের পাশে থাকা’, ‘ট্যালেন্টেড অভিনেতা’-নানা পাটেকরের বিরুদ্ধে এত বড় অভিযোগ! গায়ে ফোস্কা পরেছে পুরুষদের। আর সহ্য হয় না। থেমে নেই পুরুষ কুলের শিরোমণি বিগ বি।
‘থাগস অব হিন্দুস্তান’ এর প্রচারে অমিতাভ বচ্চনকে তনুশ্রীর অভিযোগ নিয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘আমি তনুশ্রী দত্ত নই, নানা পাটেকরও নই। আমাকে এ বিষয় প্রশ্ন করা হচ্ছে কেন?’ প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেলেন অমিতাভ। তাহলে তনুশ্রী কি ঠিক বলছেন যে মুম্বইতে যৌন হেনস্থার কথা শুনলেও, ঘটনা সবাই জানলেও কেউ এ নিয়ে টুঁ-শব্দটিও করেননি? প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে।
গা ছাড়া ভাব শুধু যে অমিতাভ বচ্চনের এমনটা নয়। আমির খান প্রকাশ্যেই বলেছেন, ‘আদৌ এরকম কোনো ঘটনা ঘটেছিল কি না সেটা মানুষ বলবে। আমি না।’ যতই টেলিভিশনে সামাজিক অন্যায় নিয়ে গলা ফাটান আমির। দঙ্গলে মেয়েদের লড়াই দেখান। ইন্ডাস্ট্রির লড়াইয়ে তিনি প্রথা মেনে পুরুষ শিবিরে। কম যান না জন অ্যাব্রাহাম। নানার মতো মানুষের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ উঠতেই পারে না' সাফ জানিয়ে দিয়েছেন তিনি।
তবে সবাই আমির খান বা অমিতাভ বচ্চন নয়। ‘সুই ধাগা’-র প্রমোশনে বরুন ধওয়নকে এই বিষয় নিয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ' ছবির প্রমোশনের জন্য ব্যস্ত বলে পুরো বিষয়টা ঠিক মতো জানি না। তবে আমি মনে করি কর্মক্ষেত্রে পুরুষ বা নারী দুজনের সম্মানের সঙ্গে কাজ করা উচিত। আমি দেখছি মিডিয়া বিষয়টা ভাল কভার করছে এবং তনুশ্রী যৌন হেনস্থার কথা বলেছেন এটার জন্য সাহস লাগে। তাঁর সাহসকে সম্মান জানাই।'
তাঁর পাশে এখন বলিউডের একাধিক অভিনেত্রী । তনুশ্রীর অভিযোগকে প্রিয়ঙ্কা চোপড়া সমর্থন জানিয়ে একটি টুইট করেন। যে টুইটে লেখা থাকে, ‘বিলিভ সার্ভাইভার্স’। এরপর অক্ষয়ের ঘরণী টুইঙ্কলকেও একহাত নেন এই ঘটনার বিরুদ্ধে।
টুইঙ্কল খান্নাও তনুশ্রীর সপক্ষে এসে মুখ খোলেন। টুইঙ্কলের সমর্থনকে স্বাগত জানিয়ে তনুশ্রী বলেন, ‘ধন্যবাদ ম্যাম আমাকে সমর্থন জানানোর জন্য।’ নিজের ঘরের থেকেই আলাদা হলেন কী টুইঙ্কল? অক্ষয় তো নানার বন্ধু।
ঘটনার আগে বা পরবর্তীকালেও নানা পাটেকরের সঙ্গে অভিনয় করছেন...ফিরছে মহিলাদের স্বর! ইন্ডাস্ট্রির একপেশে পুরুষালী ক্ষমতার বিরুদ্ধে সোচ্চার বি টাউনের মহিলাকুল।
প্রায় দশ বছর আগের এক ঘটনা টেনে এনে কাঠগড়ায় তুললেন নানা পাটেকরকে। অভিযোগ, একটি ফিল্মের সেটে তাঁকে হেনস্থা করেছিলেন নানা পাটেকর। অন্যদিকে রিচা চাড্ডা বলেছেন, ‘‘এক জন নারী যখন তাঁর যৌন হেনস্থার কথা ‘পাবলিক’ করেন তখন বোঝা যায় তিনি কতটা সাহসী এবং একইসঙ্গে সৎ।’’
পাশে থাকার, সমর্থনের টুইট না হয় জুটেছে তনুশ্রীর কিন্তু যাঁর বিরুদ্ধে এই মারাত্মক অভিযোগ তিনি কী বলছেন?
তনুশ্রী দত্তর বিস্ফোরক হেনস্থার অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে নানা আইনি নোটিস পাঠিয়েছেন তনুশ্রীকে। একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে এদিন নানা বলেন, ‘‘কিসের যৌন হেনস্থা? এই বিষয় নিয়ে সংবাদমাধ্যমে কথা বলাও বৃথা।’’ জানান, আইনি পথে কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়, তা আলোচনা করে দেখছেন তিনি। আইনের পাশাপাশি নানা জড় করছেন সে সময়ের কোরিওগ্রাফার গণেশ আচারিয়া এবং রাকেশ সরং-সহ সেটের অধিকাংশকে। বেশ বড়সড় দল তৈরি করছেন নানা তাঁর পক্ষে। গণেশ আচারিয়া সঙ্গে সঙ্গে নিজের মত গুছিয়ে বলেছেন, ‘‘নানা খুব উদার মানুষ। তিনি এ কাজ করতে পারেন না।’’ অর্থাৎ উদার হলে দান করলে যেন যৌন হেনস্থা কেউ করতে পারে না।
আরও পড়ুন: আট বছর আধ্যাত্মিকতায় ডুবে ছিলাম, বললেন তনুশ্রী
কী লিখছেন রেণুকা সাহানে ফেসবুকে?
‘‘খুব ট্যালেন্টেড অভিনেতা নানা পাটেকর। কিন্তু খুব বদমেজাজ। তাঁর রাগের পরিচয় ইন্ডাস্ট্রিতে অনেকেই পেয়েছে।’’
কৃষক দরদী নানার খোলস খুলেছে...
আসল কথা পুরুষ মানুষ। কাজের মানুষ। মাঝে মাঝে কাজের চাপ সহ্য করতে না পেরে মাথা তো গরম হতেই পারে! তবে পুরুষ মহিলার এই লড়াইয়ে ব্যতিক্রম ফরহান আখতার যিনি তনুশ্রীর সাহসকে সম্মান জানিয়েছেন। অন্যদিকে রাখি সবন্ত বলেছেন তাঁর সঙ্গে নাচের দৃশ্য থাকলেও নানা তাঁকে কখনওই ছোঁয়ার চেষ্টা করেননি।
তিন দশক ধরে ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করছেন নানা পাটেকর। তাঁকে চিনতে হলে তাঁর সহকর্মীদের তাঁকে নিয়ে মন্তব্যগুলোর দিকে ঘুরে তাকানো যাক। ২০১০ সালের এক সাক্ষাৎকারে ডিম্পল কাপাডিয়া নানা পাটেকরের ‘প্রহার’ এর নায়িকা জানান, ‘তিনি ‘অবনক্সাস’! অসম্ভব ট্যালেন্টেড অভিনেতা কিন্তু ওর কালো দিকগুলো আমি জানি।’’
সাবধান পুরুষকুল। রাগের নামে ক্ষমতার নামে যথেচ্ছাচার আর বোধ হয় চলবে না। ইন্ডাস্ট্রির কুইনরা এখন গলা চড়িয়ে নিজেদের স্বরে প্রতিবাদ করতে শিখেছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy