এক সঙ্গীতায়োজক কাকার জীবিতাবস্থাতেই একটি অন্যায় কাজ করেছিলেন। কাকা এবং দিদি সেটি ধরে ফেলেছিলেন। প্রতিশোধ নিতে সেজোকাকার মৃত্যুর তিন দিনের মাথায় নোংরা কেচ্ছা ছড়িয়ে দেন তিনি। দিদি কার্যত একঘরে, গৃহবন্দি। শেষে তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দায়ের করেন।
মান্না দে-কে নিয়ে মুখ খুললেন ভাইপো সুদেব।
সবার অতি প্রিয় মান্না দে আমার সেজো কাকা। আমার পিতৃতুল্য। গান শিখিয়েছেন। কোলেপিঠে করে মানুষ করেছেন।
এই রবিবার, ১ মে কাকার ১০৩ বছর হল। যাঁরা তাঁর গান শুনে বড় হয়েছেন, তাঁরা এ দিনও তাঁর গানেই নতুন করে খুঁজবেন তাঁকে। আমি স্মরণ করব অতীত স্মৃতি।
বাংলা, হিন্দি এবং অন্যান্য ভাষা মিলিয়ে অজস্র গান কাকার। সেই গানের কত গল্প! ‘সন্ন্যাসী রাজা’ ছবিতে ‘কাহারবা নয় দাদরা বাজাও’ গানের কথাই ধরুন। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার গানের কথায় লিখেছিলেন, ‘আহ্! রাধাকান্ত কী করছ!’ গাইতে এসে গানের কথা শুনে প্রবল আপত্তি করেন কাকা। কারণ, তবলচি রাধাকান্ত নন্দী। সবার শ্রদ্ধেয় ‘রাধুবাবু’ কাকারও ভীষণ প্রিয়। মান্না দে-র তাই প্রবল আপত্তি, ‘‘রাধুবাবুকে নিয়ে লেখা ওই পংক্তি গাইতে পারব না। গুণী মানুষের অপমান হবে। নাম বদলে দিতে হবে।’’
শিল্পীর মহানুভবতায় হতবাক তবলিয়া। কাকার যুক্তি সে দিন সসম্মানে মেনে নিয়েছিলেন গৌরীকাকুও। ‘রাধাকান্ত’ নাম বদলে হল ‘শশীকান্ত’। কাকাও মহানন্দে গেয়েছিলেন সেই গান। তেমনই আরও একটি গান, ‘ও কেন এত সুন্দরী হল।’ কথা পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। পুলককাকু সম্ভবত মুম্বইয়ে সেজোকাকার কাছেই আসছিলেন। বিমানে ছিলেন এক অপরূপা বিমানসেবিকা। পুলককাকু তাঁকে দেখেই মুগ্ধ। সেই বিমানসেবিকাকে দেখেই গান এল। কাকু চেয়েচিন্তে সিগারেটের প্যাকেট জোগাড় করে ফেললেন। প্যাকেটের রাংতার পিছনের সাদা কাগজে লিখে ফেললেন, ‘ও কেন এত সুন্দরী হল! ওমনি করে ফিরে তাকাল, দেখে তো আমি মুগ্ধ হবই। আমি তো মানুষ।’ সেজোকাকার বাড়িতে এসে সেই গান দেখাতেই তৈরি হয়ে গেল নতুন গান।
মান্না দে সম্ভবত একমাত্র বাঙালি গায়ক, যিনি ‘দাদাসাহেব ফালকে’ সম্মানে সম্মানিত। কাকাকে ঘিরে আমার অজস্র স্মৃতি। এই গানপাগল মানুষটিকে বাইরে থেকে দেখে সবাই ভাবতেন ভীষণ রাগী। আদতে কিন্তু প্রচণ্ড রসিক। ছোটবেলায় কাকার সঙ্গে একবার পাইকপাড়ার টালা পার্কের একটি অনুষ্ঠানে গিয়েছি। মান্না দে আসছেন শুনেই উপচানো ভিড়। চারিদিকে অগুন্তি কালো মাথার সারি। অনবদ্য সাজানো মঞ্চ। অনুষ্ঠানের আগে কাকা থমকে দাঁড়িয়ে সেই সাজানো মঞ্চ দেখলেন। তার পরে গাইতে উঠেই প্রশংসায় ভরিয়ে দিলেন আয়োজকদের। জানালেন, এত সুন্দর সাজানো মঞ্চ দেখে তাঁর মন ভরে গিয়েছে। সেই রেশ নিয়েই তিনি ফিরে যেতে চান।
ব্যস, জনতার সে কী গর্জন! দাবি, ‘‘কিছুতেই না। আপনাকে একবার আমাদের কাছে পেয়েছি। আর আপনি গান না শুনিয়েই চলে যাবেন!’’ কাকা তখন নিজের রসিকতায় নিজেই হাসছেন!
সেখানেই গাইতে গাইতে হঠাৎই আক্রমণ একটি মাছির। বোঁ-বোঁ করে কাকার মুখের চারপাশে উড়ছে। গাইতে গাইতে যদি মুখে ঢুকে যায়! সেজকাকা সেই অস্বস্তিতে ভুগছেন। শেষে গান থামিয়ে তাঁর কপট আফশোস, ‘‘রাতে মশা দিনে মাছি, এই নিয়েই কলকাতায় আছি!’’ দর্শক-শ্রোতা হইহই করে উঠেছিলেন তাঁর রসিকতায়।
এটাই ‘মানুষ’ মান্না দে। গাইতে গাইতে রসিকতার মেজাজে চলে যেতেন। এক বছরের শীতে বেহালায় অনুষ্ঠান করতে গিয়েছিলেন কাকা। নির্দিষ্ট স্থান ছাপিয়ে শ্রোতার ঢল। জায়গা না পেয়ে মঞ্চের দু’পাশের বাঁশ ধরে ঝুলছেন বহু লোক। কাকার গান শুনবেন বলে। দেখে কাকা আঁতকে উঠে বলেছিলেন, ‘‘কী করছেন! বিপদে পড়বেন সবাই।’’ কে শোনে কার কথা। ওই ভাবেই সে দিন সবাই গান শুনেছিলেন।
সেই সেজকাকার শেষ জীবনটা নাকি ভীষণ দুঃখে কেটেছে! ছোড়দি সুমিতা নাকি কাকাকে ঘরবন্দি করে রাখতেন বেঙ্গালুরুর বাড়িতে। ঠিকমতো খেতে দিতেন না। কারও সঙ্গে মিশতে দিতেন না। ফোনেও কথা বলতে দিতেন না কাকাকে। আমি জানি, কী ভীষণ অসত্য কথা। এক সঙ্গীতায়োজক কাকার জীবিতাবস্থাতেই একটি অন্যায় কাজ করেছিলেন। কাকা এবং দিদি সেটি ধরে ফেলেছিলেন। প্রতিশোধ নিতে সেজোকাকার মৃত্যুর তিন দিনের মাথায় নোংরা কেচ্ছা ছড়িয়ে দেন তিনি। দিদি কার্যত একঘরে, গৃহবন্দি। কত দিন বেরোতে পারেননি। শেষে ওই সঙ্গীতায়োজকের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দায়ের করেন বেঙ্গালুরু আদালতে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy