পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়। —নিজস্ব চিত্র।
আপনি সিকিয়োরিটি রাখেননি?
ভারতের মানুষ আমার সিকিয়োরিটি, দেশের সংবিধান, আইনি ব্যবস্থা, কেন্দ্রীয় সরকারের তৈরি করা সেন্সর বোর্ড আমার সিকিয়োরিটি, রাজ্য সরকারের পুলিশ ও প্রশাসন আমার সিকিয়োরিটি। ছবি না দেখেই ছবি নিয়ে এত মন্তব্য কেন? যারা হুমকি দিচ্ছে, থ্রেট করছে, তারা ভাবছে আমি গুমনামি বাবার বায়োপিক করছি। এমন কিছু হয়তো সেখান থেকে বেরিয়ে আসবে যাতে তাদের স্বার্থে ঘা লাগবে। তবে এত কিছুর পরে বুঝেছি, সাধারণ মানুষ আমার সঙ্গে আছে। তারা বলেছে, দাদা আপনি লড়ে যান, আমরা সঙ্গে আছি।
আর ইন্ডাস্ট্রি?
ইন্ডাস্ট্রি থেকে যেমন সাড়া পাওয়ার কথা পাইনি। আসলে ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশন খুব গোলমেলে জিনিস। পরমব্রত, অনুপম, পিয়া করেছে। অনিকেত চট্টোপাধ্যায়, যিনি গুমনামির বিরুদ্ধে এত বলেছেন, তিনিও বলেছেন ছবিটা মুক্তি পাক। অরিন্দম শীল সমর্থন করেছেন।
আপনি হঠাৎ নেতাজিকে নিয়ে কেন ছবি করতে চাইলেন?
আমি এখানে একটা প্রশ্ন করি। কেন ছবিটা আগে করা হয়নি বলুন তো? অনেকে ভয় পেয়ে করেননি। অনেকের কোনও স্বার্থ লুকিয়েছিল। এত সরকার বদল হল। তবুও নেতাজির মৃত্যু সম্বন্ধে ধোঁয়াশা রয়ে গেল। আমার মনে হয়েছিল এই ধোঁয়াশা কিছুটা হলেও যদি সরানো যায়। কারণ নেতাজি শুধু দেশনায়ক নন। তাঁর জন্যই দেশের স্বাধীনতা এসেছে। এটা আমার কথা নয়। বি আর অম্বেডকরের কথা, ক্লেমেন্ট অ্যাটলি-র কথা।
এই বক্তব্য তো ইতিহাসকেও অনেকখানি চ্যালেঞ্জ করে!
হ্যাঁ। ইতিহাস যারা জিতে যায় তারাই লেখে। সেটা আক্ষরিক অর্থে সব সময় সত্যি হবে এমনটাও নয়।
নেতাজি কি হেরে গিয়েছিলেন!
আক্ষরিক অর্থে হয়তো তাই। কারণ তাঁর দিল্লিতে পৌঁছনোর কথা ছিল। তিনি আশা করেছিলেন আইএনএ-র জন্য সারা দেশে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠবে। কিন্তু দেশের কাছ থেকে তিনি সাড়া পাননি। তাই তিনি হেরে যাননি, আমরা হেরে গিয়েছিলাম। আমাদের হার।
কিন্তু এই ছবি কি গুমনামি বাবা আর নেতাজিকে এক করে দেখাবে?
কখনওই না। আমার ছবির নাম ‘গুমনামি’। গুমনামি বাবা নয়। গুমনামির অর্থ, যার নাম নেই, অচেনা অজানা. নেতাজির মৃত্যু নিয়ে যে অচেনা, অজানা রহস্য যা ধোঁয়াশা, আমি সেটাকেই আমার ছবির পোস্টারে, টিজারে সর্বোপরি ছবিতে তুলে ধরতে চেয়েছি।
আরও পড়ুন: দ্বন্দ্বের জেরে বন্ধ ছবি
নেতাজির মৃত্যু নিয়ে তিনটি থিয়োরি আছে...
আমি সেই প্রসঙ্গেই আসছি। আমার ছবিতে এই তিনটি থিয়োরির দৃশ্যায়ন আছে। অর্থাৎ নেতাজি প্লেন ক্র্যাশে মারা যান। নেতাজি রাশিয়ায় মারা যান। নেতাজি গুমনামি বাবা হয়ে ফৈজাবাদে মারা যান। আমার ছবি এই তিনটি মৃত্যুকেই দেখায়। আমার ছবির দুই চরিত্র এই তিন থিয়োরির সাক্ষ্যপ্রমাণ নিয়ে মুখার্জি কমিশনের সামনে লড়ে যায়, শেষে কমিশন তার ভারডিক্ট দেয়। এই নিয়ে। আমার ছবি কোথাও দাবি করে না যে নেতাজি প্লেন ক্র্যাশেই মারা যান বা গুমনামি হয়েই মারা গেছেন বা রাশিয়ায়তেই মারা গেছেন। আমি চেয়েছি মানুষ এই তিনটি সম্ভাব্য মৃত্যুই দেখুক। মানুষ প্রশ্ন তুলুক যে মুখার্জি কমিশন কেন খারিজ করা হল? সেই জন্যই ছবিটা করা।
আপনার বক্তব্য তো পরিষ্কার। তা হলে ছবি নিয়ে এত বিতর্ক কেন?
আমি তো বার বার বলছি। বুঝিয়ে দিচ্ছি। এত বার বলার পরেও এই বিষয়টা যদি কেউ বুঝতে না পারে তা হলে সে মূর্খ বা শয়তান কোনওটাই নয়, শুধু তার আইকিউ সদ্যোজাত অ্যামিবার চেয়েও কম।
আপনি কি শুধু অনুজ ধরের টেক্সট ধরে ছবিটা করেছেন?
দেখুন, এই ভুলভ্রান্তি আবার হচ্ছে। আমি প্রচুর বই পড়েছি। একটা টেক্সট নিয়ে তো কাজ করিনি। আর যাতে কোনও সমস্যা না হয় তাই মুখার্জি কমিশন থেকে কোট তুলে তুলে আমি ছবিতে ব্যবহার করেছি। ইচ্ছে করেই এ সব ভুল তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। হ্যাঁ, অনুজের বই আছে। চন্দ্রচূড়ের বই আছে। বরুণ সেনগুপ্তের বই আছে। অধীর সোমের বই আছে। তিনটি কমিশনের রিপোর্টে আছে। তিনটে কমিশনের রিপোর্টেও আছে প্লেন ক্র্যাশ থিয়োরির সপক্ষে যে বই আছে সেগুলো ও আমি পড়েছি। এত কিছুর পরেও যদি কেউ বলে নেতাজিকে গুমনামি বাবা দেখানোর অভিপ্রায়ে আমার এই ছবি তা হলে তারা যে পুরোটাই ভুল ভাবছেন এটা পরিষ্কার। বা ঠিক ভাবতে চাইছেন না।
নেতাজির পরিবার থেকেও তো আপনার ছবি নিয়ে বিরোধিতা করা হচ্ছে?
পরিবারের জায়গাটাতেও বিস্তর গন্ডগোল। একটি অংশ গুমনামি বাবার থিয়োরিতে বিশ্বাসী আবার আর একটি অংশ এই থিয়োরিতে বিশ্বাসী নয়। কিন্তু বলছেন প্লেন ক্র্যাশটা ভাল করে বিবেচনা করা উচিত কারণ তাতে অনেক অসঙ্গতি আছে। আবার আর একটা ফ্যাক্টর বলছে প্লেন ক্র্যাশেই নেতাজির মৃত্যু। আর চার নম্বর মত, রাশিয়ার কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে নেতাজির মৃত্যু হয়েছে। পরিবার থেকেই এত রকমের মত!
আরও পড়ুন: ‘অপু’কে বড় পর্দায় ফিরিয়ে আনতে প্রথমবার বাংলা ছবির নিবেদকের ভূমিকায় মধুর ভাণ্ডারকর
আর কেন্দ্রীয় সরকার?
কেন্দ্রীয় সরকার তো নেতাজির মৃত্যুদিন ১৮ অগস্ট টুইট করে উইথড্র করে। তারাও প্লেন ক্র্যাশ নিয়ে নিশ্চিত নয়। স্বভাবতই মৃত্যুদিন নিয়েও নয়। মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও জানতে চেয়েছেন নেতাজির মৃত্যু নিয়ে। অর্থাৎ তাঁর কাছেও বিষয়টা পরিষ্কার নয়। দেখুন, কমিশন প্রশ্ন তোলে, খবরের কাগজে প্রবন্ধ প্রশ্ন তোলে। তেমনই ছবিটাও প্রশ্ন তোলে। ইনফ্যাক্ট, এই ছবিকে দ্বিতীয় মুখার্জি কমিশনও বলা যায়, কারণ, এর পরিচালকের পদবিও মুখার্জি। যদিও, এই ছবি কমিশনের মতো কোনও ভারডিক্ট দেয় না।
এত পড়াশোনা, তার পর ছবি করা। এক জন পরিচালক হিসেবে কী মনে হয়, নেতাজির মৃত্যু আজও রহস্য কেন?
রহস্য থেকে গেল তার কারণ রাজনৈতিক সমীকরণ। আজও সেই সমীকরণ কাজ করছে। রাজনীতিবিদদের সঙ্গে বিদ্বজ্জনের অশুভ আঁতাতের কথাও শোনা যায় নেতাজির মৃত্যুকে প্রকাশ না করার জন্য। তাই মৃত্যুর রহস্য উদ্ঘাটন হচ্ছে না। আমার সিনেমার একটাই উদ্দেশ্য, নেতাজিকে নিয়ে আলোচনা হোক। তাঁর মৃত্যুর ধোঁয়াশা কাটুক। তাঁকে এই যে সরিয়ে রাখা, আলোচনা না করা, এটার মধ্যে ভয়ঙ্কর অবমাননা আছে। এক জন দেশনায়ক হিসেবে উনি সেটা ডিজার্ভ করেন না।
ছবি মুক্তির বহু আগে এত বিতর্ক কি আপনার ছবিটাকে এগিয়ে রাখল?
নেতাজির মতো মনীষীর উপর ছবি হলে তার কোনও বিতর্কের প্রয়োজন হয় না।
প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়কে নেতাজি হিসেবে ভাবলেন কেন?
ওর মুখের আদলে নেতাজির মতো করাটা অপেক্ষাকৃত সহজ। আর নেতাজির জন্য লার্জার দ্যান লাইফ ব্যক্তিত্ব প্রয়োজন ছিল, যেটা বুম্বাদার মধ্যে দেখেছি। ২৩ দিন ধরে লুক টেস্ট হয়েছে। মেক আপ করতে আড়াই ঘণ্টা, তুলতে দেড় ঘণ্টা। আর ওই গরমে ঘাম জমে মাথার পেছনে থলে হয়ে যেত! বুম্বাদার ফিজিকাল কমিটমেন্ট নিয়ে কোনও কথা হবে না। লখনউতে ৪৫ ডিগ্রি গরমে শুট হয়েছে। ওর মাথা থেকে ঘামটা কলের জলের মতো বেরিয়ে আসত!
আর অনির্বাণ?
খুব প্রিয় অভিনেতা। ওর সঙ্গে ‘গুমনামি’ ছবিটা ধরলে পর পর পাঁচটা ছবি করলাম। খুব তৈরি হয়ে, বইপত্র পড়ে অভিনয় করে। এ জন্যই ওর সঙ্গে কাজ করতে এত ভাল লাগে।
আপনি মানুষের আসল আর নকল আইডেন্টিটি নিয়ে ছবি করছেন... আগে ‘এক যে ছিল রাজা’, এখন ‘গুমনামি’।
মানুষের আইডেন্টিটি তুলে ধরতে চাই আমি। সত্যকে নিয়ে প্রশ্ন করতে চাই আমি... এইটুকুই। বিতর্ক হোক। গণতন্ত্রের জন্য বিতর্ক যথেষ্ট স্বাস্থ্যকর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy