যে জীবনে তাঁকে দেখতে যেতে না পারার বেদনায় মন ভিজে আছে, সেই জীবনেই তাঁর সঙ্গে কাজের সুযোগ এল একদিন।
তখন আমি ক্লাস টেন-এ। আমার এক আত্মীয়, সম্পর্কে যিনি আমার পিসেমশাই হন, তিনি কলকাতার অন্যতম একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়াতেন। অনেক নামী মানুষের সন্তান সেই স্কুলে পড়তে আসত। তাদের মধ্যে অনেককেই তিনি প্রাইভেট টিউশন দিতেন। আমার সেই পিসেমশাইয়ের সঙ্গে আমার পিসিমণির তখন নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে। আর আমি আধা মফঃস্বলে বেড়ে ওঠা বাংলা স্কুলে ‘উঠ গো ভারতলক্ষ্মী’ প্রার্থনাসঙ্গীত গেয়ে একটা মধ্যবিত্ত মূল্যবোধের কঠোর গণ্ডিতে বড় হচ্ছি। যে গণ্ডি থেকে অনেক দূরে রুপোলি পর্দার আলো। সেখানকার ঝলমলে মানুষরা প্রকৃত অর্থেই আমাদের কাছে ছিলেন রূপকথার মানুষ।
আমার জীবনে প্রথম দক্ষিণের জানলা আমার সেই পিসেমশাই। তিনি একদিন ভূতের রাজা হয়ে বর দিলেন আমায়— এই শনিবার তোমায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে নিয়ে যাব। ওঁর সঙ্গে কথা হয়েছে। উনি ওইদিন সন্ধ্যাবেলা বাড়ি থাকবেন। নাম শোনার পর থেকেই বুকের ভেতর উথাল-পাথাল! অকারণে ছুটোছুটি। হঠাৎ হঠাৎ হেসে ওঠা। আমার দু’পাশে দু’ খানা ডানা লাগিয়ে দিয়েছে যেন কে! ডানাজোড়ায় অলক্ষ্য রং! সপ্তাহের শুরুর দিকে কথা হয়েছিল। মাঝখানের দিনগুলো স্কুল আর পাড়ায় কারও জানতে বাকি রইল না, শনিবার আমি রাজদর্শনে যাচ্ছি।
হঠাৎ দু’দিন আগে স্কুলে নোটিস এল। সোমবার সাপ্তাহিক পরীক্ষা। অঙ্ক আমার বরাবরই ব্যথার জায়গা। রক্ষণশীল পরিবার। সে দিন ওই দুর্লভ রাজদর্শনের থেকে বেশি গুরুত্ব ছিল অঙ্ক পরীক্ষার উপর। অভিভাবকদের গলায় বিদ্রূপ— ‘‘অঙ্কে নম্বর ওঠে না! আবার লাফানো হচ্ছে! কোথাও যেতে হবে না! তুমি ওঁকে দেখে কী করবে? তুমি কি সিনেমায় নামবে নাকি! মন দিয়ে লেখাপড়া কর!” ব্যস! কথা শেষ!
আরও পড়ুন: প্রয়াত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, চল্লিশ দিনের লড়াই শেষ একটু আগে
আরও পড়ুন: ‘অপু’ হতে অপেক্ষা করেছিলেন ৩ বছর, রেডিয়োর ঘোষক সৌমিত্রকে পছন্দই হয়নি পরিচালকের
চোখের জলে বালিশ ভিজল। যাওয়া হল না। কিশোরকালে এমন কিছু কিছু কান্না থাকে, যা ভোরের শিশিরের মতো পবিত্র আর নির্মল হয়ে সারাজীবন টলটল করতে থাকে মনের মধ্যে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্য ওই কান্নাও ঠিক তেমন ভাবেই এখনও টলটল করে মনের ভিতর। সেদিনের সেই দুঃখ অথবা আক্ষেপ এখনও স্পষ্ট। এখনও তীব্র।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্য ওই কান্না ঠিক তেমন ভাবেই এখনও টলটল করে মনের ভিতর।
এর পরেও অন্তত পাঁচ থেকে ছ’বার ওঁর সঙ্গে দেখা হওয়ার সুযোগ এসেছিল। কিন্তু কোনও না কোনও ভাবে বানচালও হয়ে গিয়েছিল। মঞ্চে-ছবিতে দেখা হচ্ছে বারবার। অনেক বার সুযোগ এসেছে আলাপ করার। কিন্তু তখন এক আশরীর লজ্জা পা দুটো মাটির সঙ্গে প্রোথিত করে রাখত। আসলে স্বভাবের ধরণ বদলেছে ততদিনে। যাঁর প্রতি এত মুগ্ধতা, তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে কী বলব! অমন গুণী মানুষের সামনে নিছক দাঁড়িয়ে থাকাও তো চরম অস্বস্তির। তাই বার বারই এড়িয়ে যাওয়া।
আরও পড়ুন: আমার প্রথম নায়ক
আরও পড়ুন: উত্তমকুমার হয়ে ওঠেননি, কিন্তু বেলাশেষে তিনি সৌমিত্র
একদিন এক ম্যাগাজিনে কাজের সুবাদে দায়িত্ব পড়ল তাঁর সাক্ষাৎকার নেওয়ার। আমি আর আমার এক বন্ধু ছিলাম। তখন লিটল ম্যাগাজিনে লেখা বেরোয়। ‘পরিচয়’, ‘চতুরঙ্গ’ ইত্যাদি সাহিত্য পত্রিকায় নিয়মিত লেখা ছাপা হয়। আমি আর আমার এক সহকর্মী গেলাম দেখা করতে। সহকর্মীর সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল, আমি কোনও প্রশ্ন করব না। শুধু রেকর্ডার অফ-অন করব। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আমাদের দু’ঘন্টার উপর সময় দিলেন। আমার বন্ধু সেই ফাঁকে আমার যৎসামান্য পরিচয় দিল। তাতে লেখার কথাও এল ঘটনাচক্রে। উনি হাসলেন শুধু। ইন্টারভিউ শেষ হল। চলে আসার সময় বললেন, “মেয়েটি ভারি লাজুক তো! তুমি তো কোনও প্রশ্নই করলে না! তোমার কোনও প্রশ্ন নেই?’’ আরও বললেন, “পরিচয় আমি নিয়মিত পড়ি। পড়েছি তোমার লেখা।”
আরও পড়ুন: মঞ্চের সৌমিত্র ছিলেন থিয়েটারের বড়দাদা, লিখলেন বিভাস চক্রবর্তী
অফিসে এসে আবিষ্কার করা গেল, আমি রেকর্ডার অন-ই করিনি! শুধু মুগ্ধ হয়ে শুনে গিয়েছি ওঁর কথা। ওঁর যাপন। সেই ঘটনার কয়েক বছর পর কোনও অনুষ্ঠানে দেখা। ভোলেননি। অবাক হলাম। বললেন, “তোমরা যে সেই ইন্টারভিউ নিলে, তার কপি কি আমাকে পাঠিয়েছিলে?” চাপে পড়ে সত্যি কথা বললাম। বিশ্বাস ছিল, অপমানে পুড়ে ঝালাপালা হব নিজের কৃতকর্মের দায়ে। কিন্তু আমাকে অবাক করে হেসে উঠলেন উনি দরাজ গলায়। সেই হাসির দমকে আমার লজ্জা, আমার অপদার্থতা সব উড়ে যেতে লাগল। পৃথিবীর উজ্জ্বল আলো তাকে নিঃশেষে হরণ করে নিল।
হবে না-ই বা কেন? উনি যে রাজা! রাজা তো এমনই হন।
‘সাঁঝবাতি’ যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা জানেন ওই ছবিতে ‘ছানাদাদু’ কতটা অপরিহার্য।
এক জীবনে কী না হয়! ছিল দিঘির মতো শান্ত, নিস্তরঙ্গ জীবন। যে জীবনে এক চৈত্রবাতাস এসে সবকিছু এলোমেলো করে দিল। শান্ত দিঘির মতো নিস্তরঙ্গ জীবন থেকে এক মহাপ্রলয়ের জীবন। চ্যানেল-চিত্রনাট্য-টেলিভিশন-পরিচালনা-সিনেমা। যে জীবনে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় মতো এক মহারাজকে এক বার দেখতে যেতে না পারার বেদনায় মন ভিজে আছে, সেই জীবনেই তাঁর সঙ্গে কাজের সুযোগ। ‘জলনুপূর’ নামের এক ধারাবাহিকে তাঁর অভিনয়। চার ঘন্টা থাকতেন। সেই চার ঘণ্টা ফ্লোরে থাকতে হত আমাকে। লাইন পড়ে শোনাতে হত। শট নেওয়ার পর জিজ্ঞেস করতেন, “কি? ঠিক আছে? হচ্ছে?” আসলে এ ভাবেই উনি মানুষকে সম্মান দিতেন। তাঁর থেকে অনেক ছোট, প্রায় নতুন আসা ছেলেমেয়েদেরও তারিফ করে তাদের মনোবল বাড়াতেন।
এর মধ্যে সম্পর্ক সহজ হয়েছে। সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের আত্মজীবনী বই হয়ে বেরোনোর পর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আমায় বলেছেন, “বইটা আমি পেয়েছি। কিন্তু তুমি দিলে না তো!” দিইনি যে, তা-ও তো লজ্জায়। নিজের কাজ সম্পর্কে ভরসা কম বলে। সে কথাও মুখ ফুটে বলতে পারলাম না।
‘সাঁঝবাতি’ শুরু হল। সেই সুবাদে বেশ কয়েক বার যাওয়া। তার আগে ‘মাটি’ দেখে ফোন করে বলেছিলেন, ‘‘তুমি যে যন্ত্রণার কথা বলতে চেয়েছো, তা গোটা পৃথিবীর যন্ত্রণা। এ বার টিভি ছাড়ো। ছবি করো।’’
টিভি ছাড়িনি। তবে ছবি করেছি।
‘সাঁঝবাতি’ যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা জানেন ওই ছবিতে ‘ছানাদাদু’ কতটা অপরিহার্য। আসলে উনি তাঁর অভিনয় দিয়ে তাঁর চরিত্রকে অপরিহার্য করে তুলেছিলেন। কী সহজ কথা, শুধু বডি ল্যাঙ্গোয়েজে তার বিন্যাস বদলে যায়। সামান্য একটু অসহায় চাউনি একেবারে ভেতর পর্যন্ত কাঁপিয়ে দেয়। শ্যুটিং চলার সময়, প্রত্যেক দিন স্ক্রিপ্ট শোনানোর সময় প্রথমে চোখ বুজে শুনে নিতেন। তারপর বলতেন, “আমি যদি তোমার লাইনগুলো ভেঙে দিই? একটু দেখো তো কেমন হয়।” বলা বাহুল্য, তখন তিনি আর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নন। অভিনয়ের যাদুমন্ত্রে ‘ছানাদাদু’। সেখানেই শেষ নয়। পুরো সিনটা দুই থেকে তিনবার রিহার্স করতেন সকলের সঙ্গে। তারপর টেক-এ যাওয়া। অন্যদের ভুলে যদি রি-টেক করতে হত, বুঝতে পারতাম তিনি একটু এলোমেলো হয়ে গেলেন। একই মুড আবার আনা কঠিন। কিন্তু পরের বার আবার একই রকম করে ডেলিভারি করতেন। তখন আমরাই কনফিউজড! আগের টেক না এটা? কোনটা বেটার?
প্রথমে চোখ বুজে শুনে নিতেন। তারপর বলতেন, “আমি যদি তোমার লাইনগুলো ভেঙে দিই? একটু দেখো তো কেমন হয়।” বলা বাহুল্য, তখন তিনি আর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নন।
‘সাঁঝবাতি’র শেষ দৃশ্যে তিনি ছেলেমেয়েদের কাছে বাড়ি হ্যান্ড ওভার করে দিয়ে বৃদ্ধাশ্রমে চলে যাচ্ছেন। তখন দু’জন কাজের লোক আসে। ‘চাঁদু (দেব) আর ‘ফুলি’ (পাওলি)। ওরা তাঁর যাওয়া আটকে দেয়। ওঁর তখন চোখে জল আসছে কৃতজ্ঞতায়, ভালবাসায়, পরম বেদনায়। কিন্তু সে জল উনি কাউকে দেখাতে চান না। দু’বার টেক হল। আমরা খুশি। আমার সহযোগী পরিচালক শৈবালকে উনি বললেন, ‘‘আরেকবার দিই?’’ চোখ আর মুখের সামান্য বদল। প্রকাশের একটু আলাদা ভঙ্গি ! কোথায় যে নিয়ে গেল দৃশ্যটাকে!
একটা কথা হয়েছিল, তাঁকে দিয়ে রবি ঠাকুরের নানারকম রাজার অংশ পাঠ করানো হবে। তিনি খুবই সম্মত হয়েছিলেন। নানা ব্যস্ততায় আর হয়ে ওঠেনি। কাজটা করতে পারলে একটা অন্যরকম কাজ হয়ে থাকত। রবি ঠাকুরের ‘রাজা’ এই মুহূর্তে উনি ছাড়া আর কাকেই বা ভাবা যায়?
পুজো চলে গেল। এবার পুজোয় উনি হাসপাতালের সাদা বিছানায়। জটিল এবং কঠিন উপসর্গ। হয়তো ধানকাটা হেমন্তের মাঠ পার হয়ে একাই হেঁটে চলেছেন মানুষটা। হাজার আলোয় সকলের সঙ্গে মিশিয়ে যাঁকে দেখতে পাননি, হয়তো নির্জনে অন্ধকারে একমাত্র হয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে গেলেন এবার। তাই আবাহন আর বিসর্জনের বাজনা মিলেমিশে একাকার হয়ে দূরাগত ধ্বনির মতো ভেসে আসছে। মধ্যরাতের সানাইতে বাজছে দরবারি কানাড়ার আলাপ। তাঁর এই নিরুদ্দেশ যাত্রায় অসংখ্য অগণিত পৃথিবীর মানুষের ভালবাসা কাশফুল হয়ে সঙ্গে রয়েছে। হিমেল বাতাসে কাশের রেণু উড়ে উড়ে ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে।
যুদ্ধক্ষেত্র থেকে জয়ের মুকুট মাথায় পরে লম্বা লম্বা পা ফেলে ভুবনভোলানো হাসি নিয়ে ফিরে আসুন আমাদের দুঃখ রাতের রাজা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy