Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Satyajit Ray

এক অসম বয়সের কিশোরীকে লেখা সত্যজিৎ রায়ের চিঠির কথা

'সোনার কেল্লা' দেখে মোহিত হয়ে গিয়ে মনে হল এ ছবির পারিচালককে একটা চিঠি লিখলে কেমন হয়!

সত্যজিতের সঙ্গে দেবযানী

সত্যজিতের সঙ্গে দেবযানী

দেবযানী রায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ মে ২০২১ ০২:০৮
Share: Save:

আজ মানিকদার ১০০বছর। আমার সামনে খোলা এক চিঠি। জানি না ওঁর জন্মদিনে এই চিঠি নিয়েই কেন বসলাম?

'শতরঞ্জ কি খিলাড়ি' ছবির নামাঙ্কিত একটা কাগজ। নীল হরফে লেখা শব্দেরা। এই চিঠিতেই মানিকদা আমায় পত্রবন্ধু বলে মেনে নিয়েছিলেন। মজা করে লিখেছিলেন, "এবার কিন্তু ছবি পাঠাতেই হবে, না হলে কদিন পরে মনে হবে 'ছায়ার সঙ্গে পত্রালাপে হস্তে হল ব্যথা'। ছবি না পাঠালে কিন্তু বলতে হবে চিঠি লেখা বন্ধ। "
আর এই চিঠি থেকেই বদলে গেল সম্বোধন। এত দিন লিখতেন, 'স্নেহের দেবযানী'। এই চিঠি থেকে তা হল, 'ভাই দেবযানী'। আজও এই খোলা চিঠিতে ওঁর স্বর, অক্ষর, স্পর্শ সব যেন জেগে আছে।

১৯৭৪ সালে আমি তখন নবম শ্রেণীতে পড়ি। সে বছর ডিসেম্বর মাসে মুক্তি পেল 'সোনার কেল্লা'। ছবি দেখে মোহিত হয়ে গিয়ে মনে হল এ ছবির পরিচালককে একটা চিঠি লিখলে কেমন হয়! সন্দেশের সম্পাদক মশাইকে এর আগে অনেকবার চিঠি দিয়েছি কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে চিঠি লেখা এই প্রথম! তখন এমনটা হয়েই থাকত। লেখকরা তাঁর ভক্তের কাছ থেকে চিঠি পেতেন। এই সব চিঠিরা পরবর্তীকালে আলোতে জায়গা না পেলেও সময়ের অনেকখানিকে যে ধরে রাখত তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। যাই হোক, চিঠিতে সোনার কেল্লা দেখে মুগ্ধতার কথা তো ছিলই, তা ছাড়া সন্দেশ পত্রিকা সম্বন্ধেও নানা মতামত জানিয়েছিলাম। সত্যি কথা বলতে কি, তারপর ভুলেই গিয়েছিলাম এ চিঠি লেখার কথা। ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসের সন্ধেবেলা বাবা আমার হাতে একটা এয়ারলেটার দিলেন হাতের লেখা দেখে মুখের কথা আর সরে না! সত্যজিৎ রায় আমার চিঠির উত্তর দিয়েছেন!

দেবযানী রায়

দেবযানী রায়

সেই শুরু। তারপর চিঠির আদানপ্রদান চলেছিল একটানা ১৯৯১ সাল পর্যন্ত। এই যে দুজনের চিঠি বিনিময়, এটা আমার জীবন ঘিরে থাকা সবচেয়ে রোমাঞ্চকর ঘটনা। ১৬ বছর ধরে দুজন দুজনকে চিঠি লিখেছি। মনে হত ওঁর সঙ্গেই পথ চলেছি। চিঠিগুলোই আমাদের মনের কথা বলেছে। 'আমাদের' বলে যদিও কিছু লেখা যায় না। যেতে পারে না। বরং অমন আলোকিত মনের সহজ কঠিন জীবনকথা ধরা আছে চিঠিতে এমন বলাই সঙ্গত। আমি তো ওঁকে লিখতাম, কিন্তু সে চিঠি কখন যে অন্যমনে হারিয়ে গেছে, জানি না।

মনে আছে তৃতীয় চিঠিতে ওঁকে সম্বোধন করেছিলাম 'শ্রীচরণেষু রায়মশাই' বলে। মজা করে লিখেছিলেন ওই সম্বোধনে আপত্তির কথা, কারণ প্রসিডেন্সি কলেজের লাগোয়া এক চায়ের দোকানের মালিককে ওঁরা ওই নামে ডাকতেন! তারপরেই লিখেছেন, সবাই তো আমায় মানিকদা বলে, ওটায় আপত্তি কি! সেই থেকে উনি আমার মানিকদা। কোনও একটা চিঠিতে সম্বোধন করতেই ভুলে গিয়েছিলাম! মজা করে লিখেছিলেন, 'সম্বোধন নেই কেন? ফেলুদা বলছে এর পেছনে গূঢ় কোনও কারণ আছে। সত্যি নাকি?'

চিঠিগুলো এখনও যত বার পড়ি তত বারই তার নির্ভার, ঝরঝরে ভাষা আমায় আপ্লুত করে। আজ মনে আসছে মানিকদার চিঠি আসা মানে বাড়িতে তখন একটা যেন উৎসবের মত ছিল। বাবা, মা, দাদা, দিদি, ভাই, সবাই সে চিঠি পড়তেন। ভাই ছোট, স্ট্যাম্প জমায়। তাই তার নজর থাকতো স্ট্যাম্পের দিকে। প্রতিটা চিঠিতে নতুন নতুন স্ট্যাম্প সাঁটা থাকতো।

৭৬ সালে আমি ভর্তি হলাম লর্ড সিনহা রোডের এক কলেজে। মানিকদার বাড়ি থেকে সেটা হাঁটা পথ। চিঠিতে জানাতেই লিখেছিলেন দু একবার ফেরার পথে ঢুঁ মেরে যাবার কথা। অসম্ভব রক্ষণশীল বাড়ি আমাদের, বিশেষ করে মা। চিঠি লেখালেখি অবধি ঠিক আছে, ওসব সিনেমা পরিচালকের বাড়ি যাওয়া নৈব নৈব চ। আমি ও কি চুপ করে এই বিষয়ে মায়ের কথা শুনব? একেবারেই না। শেষ পর্যন্ত ১৯৭৭ সালে মানিকদার বাড়ি গেলাম। সঙ্গে বাবা। তখন 'হীরক রাজার দেশে'-র প্রস্তুতি চলছে। মানিকদা ওঁর সেই লাল চেয়ারে বসে আমাদের সঙ্গে গল্প করছেন, হাত কিন্তু থেমে নেই, চরিত্রগুলো আঁকছেন, রং করছেন স্বভাবসিদ্ধ ভাবে সামনের চৌকিতে পা তুলে দিয়ে। এর পরেও অনেকবার ওঁর বাড়ি গিয়েছি। ওঁর আমন্ত্রণে মনে আছে, 'হীরক রাজার দেশে'-র শ্যুটিং দেখতেও গিয়েছি।

৭৬/৭৭ সালে যখন মানিকদা চিঠি লিখছেন আমায়, তখন তিনি খ্যাতির মধ্যগগনে। আজ মুম্বই তো কাল চেন্নাই, পরশু হয়ত পাড়ি জমাচ্ছেন মার্কিন মুলুকে। অনেক সময় সংক্ষিপ্ত চিঠি লিখেছেন হয়ত, কিন্তু নিয়ম করে জবাব দিয়েছেন। কখনও অনেকদিন চিঠি না পেয়ে অনুযোগ করলে, পরের চিঠিতে কেন চিঠি লিখতে পারেননি তার বিস্তারিত কারণ লিখে শেষে লিখছেন, 'রাগ পড়েছে আশাকরি?' কিন্তু, কখনও দায়সারা ভাবে জবাব দেননি বা একজন অসমবয়সী কিশোরীকে চিঠি লিখছেন বলে অবহেলা করে চিঠি লেখেননি।

গান, বাজনা, বিশ্বকাপ ক্রিকেট, নিজের ছবির কথা, নিজের লেখালেখির কথা, মাথায় কোনও গল্পের প্লট না আসার কথা, বেড়াতে যাবার কথা সবই থাকত মানিকদার ওই চিঠির শব্দে। চিঠির মাধ্যমে আমিও ওঁর সঙ্গে পৃথিবী ঘুরতাম। বিশ্বকে হাজির করেছিলেন উনি আমার সামনে। ওঁর চিঠির প্রচ্ছন্ন রসবোধের কথাও না বললে নয়।

একবার আমাদের পাশের বাড়ি জুসলা হাউসে ( তখনকার দিনে বিয়েবাড়ি ভাড়া দেবার জন্য বিখ্যাত ছিল) মানিকদা নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন। বারান্দা থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি সত্যজিৎ রায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সৌমেন্দু রায়… উফফ! কী উত্তেজনা! পরে এই ঘটনা চিঠিতে লেখায় উনি লিখেছিলেন, পাশের বাড়িটা তোমাদের জানলে এ দিক ও দিক নজর রাখতে পারতাম আর তা ছাড়া তোমারও চিল্লানোসরাসের মতো একটা হাঁক দেওয়া উচিৎ ছিল। এরকম কত কী যে ছড়িয়ে আছে আমায় লেখা ৭৩ খানা চিঠিতে তার ঠিক নেই।মানিকদার সৌজন্যবোধ ছিল অসাধারণ। বাড়িতে গেলে নিজে দরজা খুলতেন আবার ফিরে আসার সময় নিজে দরজা অবধি এগিয়ে দিতেন। যত বার গিয়েছি এ নিয়মের ব্যতিক্রম হয়নি।

মনে আছে মানিকদা 'সদগতি' আর 'পিকু'-র বিশেষ শো তে নেমন্তন্ন করেছেন। চিঠির বন্ধু তখন ওঁর কাছে পারিবারিক হয়ে উঠেছিল। মানিকদা তো আমাদের বিয়েতেও এসেছিলেন। তো সেই গোর্কি সদনে 'পিকু' আর 'সদগতি'-র বিশেষ উপস্থাপনা। দরজার মুখে দাঁড়িয়ে প্রত্যেকের সঙ্গে কথা বলছেন। চারিদিকে চাঁদের হাট, কে নেই? স্মিতা পাতিল, মোহন আগাশে, ওম পুরী। কিন্তু আমরা যখন পৌঁছলাম আমাদেরও আদর করে ভেতরে নিয়ে গেলেন। অনেকের কাছে তখন শুনতাম উনি নাকি দাম্ভিক, অহংকারী, কিন্তু আমার সঙ্গে যত বার দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে, তার ছিটেফোঁটাও কখনও অনুভব করিনি।

আজ মাঝেমাঝে চিঠির ঝাঁপি খুলে বসে যখন পড়ি ওঁর কথাদের, এই পত্রবন্ধুত্বের সম্পর্কটাই কেমন অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়। মনে হয় এমন হয় নাকি? একেক চিঠি একেক কালিতে লেখা। একেক রকম কাগজ, একেক রকম লেটারহেড। একেক রকমের গন্ধ। এই যে সুদীর্ঘ দিন ধরে ওঁর অক্ষরের হাত ধরে পথ চলা, তাতে একটা মানুষকে ক্রমশ বদলে যেতেও দেখেছি।

সত্যজিতের লেখা সেই চিঠিগুলি

সত্যজিতের লেখা সেই চিঠিগুলি

প্রথম দিকে প্রায় সারা পৃথিবী দৌড়ে বেড়াচ্ছেন। ৮৪ সালে 'ঘরে বাইরে'-র পর শরীর ভাঙছে, ছবি করতে পারছেন না, হাতের লেখা আগের চেয়ে অগোছালো হয়ে পড়ছে। চিঠি লেখা কিন্তু থামেনি, আর সেখান থেকেই বুঝতে পারছি ওঁর কাজ করার কী অদম্য ইচ্ছে। অথচ চিকিৎসকরা রাজি নন ওঁকে কাজে ফেরাতে। আবার যখন বহুদিন বাদে কাজে ফিরছেন, তখন লিখছেন, 'ডাক্তাররা বুঝছে আমি কাজের মধ্যেই ভালো থাকি।'

ক্রমশ চিঠির হরফ বলছিল তাঁর শরীর ভাল থাকছিলো না একেবারেই। ৮ই জুন, ১৯৯১ সালে সপরিবারে গেলাম ওঁকে দেখতে। চিঠির মধ্যে সবটা পাওয়া কী আর পাওয়া যায়? দেখলাম! অনেক রোগা হয়ে গিয়েছেন। সেই শালপ্রাংশু মহাভুজ চেহারা একেবারেই নেই। খুব কষ্ট হয়েছিলো দেখে। আমার ছেলে তখন ৫ বছরের। ছেলের বায়না মেটাতে ওর হাতে দিলেন আঁকার জন্যে আর্ট পেপার, ২৪টা রঙের ফেল্ট পেন। ছেলে মহা আনন্দে ছবি এঁকে ওঁর হাতে দিল। কী খুশি সে ছবি পেয়ে। মনে আছে সেই দিনের কথা। বললেন, 'এটা আমাকে একেবারে দিয়ে দিলে তুমি?'
তখনও জানিনা এই শেষ দেখা...

এর পর ডিসেম্বর মাসে একটা চিঠি পেলাম, চিঠির লাইন সোজা নেই… চিঠি দেখেই বোঝা যায় খুব সুস্থ নন। লিখেওছিলেন যে ১০০% সুস্থ নই। সেই আমার শেষ চিঠি পাওয়া। দুজন অসমবয়সী মানুষের পত্রমিতালীর লম্বা পথ কেমন হুট করে বন্ধ হয়ে গেল।

আজ মানিকদার একশ' বছরের জন্মদিন। আমার কাছে সব চিঠিগুলোই অমূল্য এবং প্রিয় তবে যে চিঠিতে আমায় পত্রবন্ধু বলে স্বীকার করে নিয়েছিলেন আজ ওই চিঠিটাই বারবার পড়তে ইচ্ছে করল।

অন্য বিষয়গুলি:

Satyajit Ray open letter 100th birth anniversary
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy