রূপা গঙ্গোপাধ্যায়ের কলমে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। ছবি: সংগৃহীত।
মন বড় অশান্ত। বিশেষ কাজে কুরুক্ষেত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছি। শহর থেকে দূরে আমি এই মুহূর্তে, যে শহর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের শহর। রাজনৈতিক ভাবে ‘ভদ্র’ মানুষটা চলে গেলেন। ওঁর শেষের দিনগুলির কথা বেশি করে মনে পড়ছে। মানুষটা এত বই পড়তে ভালবাসতেন, যে তাঁকে বই পড়ে শোনাতে হত। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান যা পরিস্থিতি তা অবশ্য সৌভাগ্যক্রমে উনি কম দেখতে পেয়েছেন, কম শুনতে পেয়েছেন। ওঁর জন্য যা নিঃসন্দেহে শান্তিজনক।
আমার কিছু বিরক্তি রয়ে গিয়েছে তাঁর পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর। আজ যেমন অনেক নাটক দেখব! কিন্তু উনি থাকতে থাকতে আক্রোশ দেখানোর বিন্দুমাত্র জায়গা ছাড়েননি কেউ! দু’কামরার ছোট্ট বাড়িতে থাকতেন, সেই বাড়ি মমতা নীল-সাদা রঙ না-ই করতে পারতেন। ওইটুকু বাড়ি তো ছেড়ে দিতে পারতেন! সংস্কার করার নামে নানা জায়গায় ওঁর নামের ফলক ভেঙে ফেলা হয়েছিল। সেগুলো তো না-ই ভাঙা যেত! ভদ্র মানুষের ভদ্রতার সুযোগ নিয়ে এই অভব্য আচরণ না করলেই হত। আমি মনে করি না, ব্যক্তিগত আক্রোশ দেখানোর জায়গা রাজনীতি। ফলে ওঁর প্রতি ব্যক্তিগত আক্রোশ দেখানোর কোনও প্রয়োজন ছিল না। আজ অবশ্য আক্রোশ নয়, অনেকে সেলাম ঠুকবেন!
আমি তাঁকে নন্দনে দেখেছি বহু বার। সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ গাড়ি করে ঢুকতেন সেখানে। তার পরে পিছনে একটা পুলিশের গাড়ি আসত। দোতলার ঘরে বসতেন, বৈঠক হত। রাজনীতি নিয়ে কখনও আলোচনা হয়নি আমার। সেই সময় রাজনীতির বিষয়ে আমি অজ্ঞ ছিলাম। চলচ্চিত্র উৎসব সংক্রান্ত কথা হয়েছে বহু বার। হাসতেন, কথা বলতেন, মজা করতেন। আমার মনে আছে, টেকনিশিয়ান্স স্টুডিয়োয় একবার একটি বৈঠকে ওঁকে অনেক সমস্যার কথা বলা হয়েছিল। উনি শুনলেন শান্ত ভাবে। রাগ, মেজাজের লেশটুকু নেই। সকলের কথা শুনে আশ্বস্ত করেছিলেন, সমস্যা সমাধানে তৎপর হয়েছিলেন।
একবার রইটার্স বিল্ডিংয়ে লাল বাড়িটায় গিয়েছিলাম। সেই সময় আমি মুম্বইয়ে যাতায়াত করতাম, ‘মহাভারত’-এর জন্য। আমার বাবা আট বছর ধরে ক্যাথিটার রুগী ছিলেন। বাবার বাংলাদেশের পাসপোর্ট। বাবা পাসপোর্ট বদলাতে চাইতেন না। আমৃত্যু বাংলাদেশের নাগরিকত্ব চেয়েছিলেন। বাবাকে স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। আমি গিয়ে বুদ্ধদেববাবুকে জানালাম, দু’দিন পর পর যেতে বলা হয় বাবাকে, সোনারপুর থানা থেকে বার বার ফোন করা হয়। বাবার সব কাগজপত্র দেখালাম। আমি বাংলাদেশের কমিশনে গিয়ে বার বার ভিসা পুনর্নবীকরণ করাতাম। পুরো বিষয়টি শুনে পুলিশ ভেরিফিকেশনের জন্য বাড়িতে লোক পাঠিয়েছিলেন বুদ্ধবাবু। পুলিশ যে রাজনৈতিক কার্যকলাপের মধ্যে পড়ে, সেই ধারণাই ছিল না আমার।
আমি বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পরে একবার দেখা করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু পারিনি। ওঁর অসুস্থতার কথা শুনেই যাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। বন্ধুর সাহায্য নিয়ে ঠিকানা জোগাড় করে গিয়েছিলাম। কিন্তু এতটাই অসুস্থ ছিলেন দেখা করা হয়নি আর।
২০১২-২০১৩ সালে মুম্বই থেকে কলকাতায় ফিরে এলাম যখন, দেখলাম অনেক কিছুই বদলে গিয়েছে। তার পর থেকে তো নন্দনে কোনও দিন যাইনি আমি। কিন্তু সেই মানুষটাকে কোনও দিন ভুলিনি। তিনি সদা হাস্যমুখ, গুনগুন করে গান গাইতেন নন্দনে। বাচ্চাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। জিজ্ঞেস করতেন, “কী, কেমন আছ? কী পড়ছ?” কোনও টেলিফিল্ম খুব ভাল লাগলে প্রশংসা করতেন। কোনও ছবি খারাপ লাগলে বলে দিতেন, “এ বাবা! কী অখাদ্য ছবি হয়েছে!” খুব সহজ মানুষ ছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী মানে বিরাট ব্যাপার। অনেক পুলিশ, বাউন্সার নিয়ে ঘুরবেন, এমনটাই জানি আমরা। কিন্তু ওঁকে দেখে কোনও দিনই মনে হয়নি, উনি মুখ্যমন্ত্রী। সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি, সাদামাঠা মানুষ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy