কাহিনির চলাচলে মিশে গেছে অতীত এবং বর্তমান।
‘দ্য বিলিয়ন ডলার কোড’। এ এক শিহরণ জাগানো আবিস্কার এবং স্বপ্নের গল্প।
গুগল আর্থ এমন একটা প্রযুক্তি-মাধ্যম, যা সারা পৃথিবীতে অভাবনীয় বিপ্লব নিয়ে এসেছিল। টেরাভিশনের মাধ্যমে দুই জার্মান যুবক এই একই জিনিস আবিষ্কার করেছিলেন গুগল আর্থের অনেক আগে।
ছবি শুরু হয় নয়ের দশকের জার্মানিতে; সেখানকার দুই যুবক কার্স্টেন এবং জুরি, বার্লিনের এক টেকনো ক্লাবে তাঁদের সাক্ষাত্। কার্স্টেন শ্লোটার (লিওনার্দো শ্লেইচার) এক জন উচ্চাভিলাষী ছাত্র; আর জুরি মুলার (মারিয়াস আহরেন্ড) অত্যন্ত মেধাবী কিন্তু অসামাজিক, কম্পিউটারে ডুবে থাকা এক তরুণ। দুজনেরই আগ্রহ প্রযুক্তিগত অগ্রগতিতে। সে ভাবেই তাঁদের বন্ধুত্ব দৃঢ় হল। এবং তাঁরা আবিষ্কার করে ফেললেন যুগান্তকারী এক বিস্ময়।
একটি সত্য ঘটনা, যার ঐতিহাসিক মূল্যও অপরিসীম, সেই কাহিনিই বলা হয়েছে এই গল্পে। কাহিনির চলাচলে মিশে গেছে অতীত এবং বর্তমান। একই সঙ্গে আদালত কক্ষ, সওয়াল জবাব, কার্স্টেন এবং জুরির যৌবন থেকে প্রৌঢ়তা। তাঁদের স্বপ্ন, অধ্যাবসায় এবং স্বপ্নকে সফল করার যুদ্ধ। এ ছবি স্বপ্ন দেখায়; একই সঙ্গে স্বপ্নের অপমৃত্যুও দেখায়।
দুই জার্মান যুবক একজোট হয়ে প্রযুক্তির মধ্যে দিয়ে পৃথিবীকে অন্য ভাবে দেখতে চেয়েছিলেন। শুধু তাঁরা নিজেরাই নন, এই ‘দেখা’র পথটি সারা পৃথিবীর মানুষের জন্য ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন তাঁরা। তাই নিজেদের সংস্থা তৈরি করলেন; আন্ডারগ্রাউন্ড ক্যাওস কম্পিউটার ক্লাব থেকে বিভিন্ন হ্যাকার এবং শিল্পীদের নিয়ে এসে কাজে লাগালেন। অবশেষে জাপানের কিয়োটোতে গেলেন তাঁদের টেরাভিশনের প্রযুক্তি দেখাতে। জুরি এবং ক্লাস্টার আর্থিক সহায়তা পাচ্ছিলেন না। কারণ ইন্টারনেট যে পুরো পৃথিবীকে বদলে দিতে পারবে, তা কোন অর্থলগ্নিকারী সংস্থা বিশ্বাসই করছিল না।
এ ভাবেই জুরি-ক্লাস্টার জুটি পৌঁছয় আমেরিকায়, ব্রায়েন নামে এক ব্যক্তির কাছে। ভিডিও গেম ইন্ডাস্ট্রিতে যিনি সফলতম হতে চেয়েছিলেন। সেই গেমিং প্রোগ্রামের একটা অংশে আগ্রহী ছিল গুগল। যে বিষয়টাতে জুরি এবং ক্লাস্টারকে নিয়োগ করতে চান ব্রায়েন। তবে শর্ত ছিল একটাই। টেরাভিশনের সব কিছু দেখাতে হবে। আর তাতেই যত বিপর্যয়। চুক্তিবদ্ধ হওয়ার সময়ে কার্স্টেন একজন উকিল আনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জুরি তাতে তত গুরুত্ব দেননি। আর তাই হয়ে দাঁড়াল এক ঐতিহাসিক ভুল। সম্ভবত সেখান থেকেই চুরি হয়ে যায় পেটেন্ট। পরবর্তীতে যা নিয়ে দীর্ঘ মামলা চলে টেরাভিশন এবং গুগলের মধ্যে।
নেট ফ্লিক্সে চারটি পর্বে দেখানো হয়েছে এই ওয়েব সিরিজটি। বহু প্রতিভা এবং মেধা কী ভাবে স্বীকৃতি না পেয়ে একেবারে শেষ হয়ে যাচ্ছে, এই সিরিজ দেখতে দেখতে বার বার সে কথাই মনে হয় দর্শকের। বড় মাপের প্রযুক্তি সংস্থাগুলির সাফল্যের আড়ালে কত মেধা এবং ছোট সংস্থার বলিদান থাকে; সে সব কঠিন সত্যের বিস্ফোরক উন্মোচন হয়েছে গল্পে। সাফল্যের গল্পে অনেক সময়েই নায়ক হয়ে ওঠেন খল নায়ক। সমাজ এটাই মাথায় গেঁথে দিয়েছে। তাই জিতেও সত্যিকারের জয় হয় না।
অনবদ্য পরিচালক রবার্ট থালহাইম। গল্পকার অলিভার জিজেনবালগের অসাধারণ চিত্রনাট্য। সঙ্গে দুরন্ত গ্রাফিক্স, অপূর্ব আবহ সঙ্গীত, দুর্ধর্ষ অভিনয়। সবটা মিলিয়ে দর্শকের চোখের পলক ফেলার অবসর থাকেনা। স্বপ্ন পূরণ, বন্ধুত্ব, সত্যের জন্য লড়াই; তারই সঙ্গে নব্বইয়ের দশকের বার্লিন, যুব সমাজ, তাদের হুল্লোড় মজা, নতুন কিছু আবিষ্কারের অধ্যাবসায় আর তীব্র নেশা… এগুলোর সঙ্গে ছুটতে থাকে দর্শকের উত্তেজনা এবং মনন। তবে আয়েশ করে নয়; এ ছবি মস্তিষ্ক এবং মন দিয়ে দেখার।
গুগল আর্থ হত না টেরাভিশন না থাকলে। এ কথা সবার সামনে আদালত কক্ষে স্বীকার করেনি কেউ। কিন্তু ঘটনার সত্যতা সেখানেই। তাই মামলায় জিততে না পেরেও জুরি এবং ক্লাস্টার নতুন পরিকল্পনা শুরু করে। অতএব গল্প শুধু হতাশা আর বঞ্চনার নয়; শেষ পর্যন্ত আছে আশার আলোও।
ছলে বলে কৌশলে জিতলেও, সেই জয়ের পেছনে যাঁদের অবদান; সমস্ত দুনিয়ার কাছে সেই ঋণ কোনও না কোনও ভাবে স্বীকার করতে হয় এই বিশাল প্রযুক্তি সংস্থাগুলোকে। এটুকুই আশার এবং প্রত্যাশার আলো আপামর জনসাধারণের কাছে। আর সেখানেই ছবির চরিত্রের সঙ্গে দর্শকও অপূর্ব তৃপ্তির আরাম পান।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy