‘স্যাম বাহাদুর’ ছবিতে ভিকি কৌশল। ছবি: সংগৃহীত।
ভারতীয় সেনায় চার দশকের কর্মজীবন। পাঁচটি যুদ্ধের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। ব্যক্তিজীবনের একাধিক আঙ্গিক। সব মিলিয়ে দেশের প্রথম ফিল্ড মার্শাল স্যাম মানেকশর জীবনকে আড়াই ঘণ্টার মধ্যে পর্দায় তুলে ধরা কষ্টসাধ্য। তবে চেষ্টা করেছেন পরিচালক মেঘনা গুলজ়ার। কিন্তু ‘স্যাম বাহাদুর’ ছবিতে পরিচালকের এই প্রয়াসকে আরও সহজ করে দিয়েছে এই কিংবদন্তি সেনাপ্রধানের চরিত্রে ভিকি কৌশলের অভিনয়।
সিনেমার শুরুতেই দেখা যায়, এক জন সৈনিককে কাছ থেকে জরিপ করছেন স্যাম। পুরো ছবি জুড়ে সেনার সঙ্গে মানুষটির এই নৈকট্যের মালা গেঁথেছেন পরিচালক। ১৯৩২ সালে মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে যোগদান, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগ থেকে ক্রমে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ— স্যামের বর্ণময় কর্মজীবনের উপর আলোকপাত করে এই ছবি। সেনা সর্বাধিনায়কের বিরুদ্ধেই এক সময় ‘দেশদ্রোহিতা’-র অভিযোগ ওঠে। সঙ্গে রয়েছে তাঁর পারিবারিক জীবনের ওঠাপড়া এবং তৎকালীন একাধিক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে নৈকট্য। বিশেষ করে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাঁর শ্রদ্ধাশীল অথচ মধুর সম্পর্ক ছবির অন্যতম আকর্ষণের জায়গা। প্রধানমন্ত্রীকে ‘সুইটি’ সম্বোধন তাঁর মুখেই মানায়!
স্যাম মানেকশর মতো ব্যক্তিত্বের জীবনের সবটা এই ছবিতে তুলে ধরা হয়নি। তাঁর সেনাজীবন, রণকৌশল, অনুজ কর্মীদের প্রতি মমত্ব এবং ফিল্ড মার্শাল হয়ে অবসরগ্রহণ পর্যন্তই ছবিতে জায়গা পেয়েছে। ছবিতে মানুষটির রসবোধ, সততা এবং অন্যায়ের সঙ্গে আপস না করার মানসিকতাকেও তুলে ধরা হয়েছে। তাই ব্যারাক তৈরির জন্য সৈনিক চাইলে তিনি অনায়াসে বলেন, ‘‘আমরা সৈনিক তৈরি করি, মজদুর নয়!’’ কিন্তু পরিচালকের সঙ্গে ভবানী আইয়ার এবং শান্তনু শ্রীবাস্তবের লেখা চিত্রনাট্যে তথ্য বেশি, নাটকীয়তা কম। তাই ছবির কোনও কোনও জায়গায় মনে রাখার মতো মুহূর্ত তৈরি হয়েছে। ছবিতে স্যামের কেরিয়ারের বিভিন্ন পদোন্নতির নেপথ্য ঘটনাগুলোকে জুড়তে বিভিন্ন বাস্তব ভিডিয়ো ফুটেজ এবং সংবাদপত্রের কাটআউট ব্যবহার করা হয়েছে। বড় পর্দায় তা দেখতে মন্দ নয়। তবে তা দর্শককে তৃপ্তি দিতে পারে না। বারাকপুরে ছবির অনেকটা অংশের শুটিং হয়েছিল। তবে পর্দায় তা আলাদা করে ফুটে ওঠেনি। এই ধরনের ছবিতে শেষ পর্যন্ত দর্শকের আগ্রহ ধরে রাখতে প্রয়োজন আকর্ষণীয় অ্যাকশন। এই ছবিতে তার বড্ড সরলীকরণ করা হয়েছে। স্যামকে কেন্দ্রে রাখতেই এমন সিদ্ধান্ত কি না, মনে প্রশ্ন জাগে। ছবিতে বেশ কিছু রক্ত গরম করা সংলাপ রয়েছে, যা উপভোগ্য এবং একই সঙ্গে ভিকির ‘উরি: দ্য সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ ছবিটির কথা মনে করায়। প্রথমার্ধে ছবি যতটা ধীর, দ্বিতীয়ার্ধে তুলনায় তা গতিময়। ছবির পোশাক এবং সেট পরিকল্পনা প্রশংসনীয়। শঙ্কর মহাদেবনের কণ্ঠে ‘বান্দা’ গানটি ছবির মূল সুর বেঁধে দিয়েছে।
সব শেষে আসে ভিকির প্রসঙ্গ। কারণ, তাঁকে ঘিরেই এই ছবি আবর্তিত হয়েছে। এর আগে মেঘনা গুলজ়ার পরিচালিত ‘রাজ়ি’ ছবিতে দর্শক ভিকিকে দেখেছেন। যদিও সে ছবিতে ভিকি ছিলেন পার্শ্বচরিত্রে। এ বারে তাঁর স্থান ছবির কেন্দ্রে। উভয় ছবির তুলনা অর্থহীন। কারণ প্রেক্ষাপটে সাদৃশ্য থাকলেও তাদের প্রাসঙ্গিকতা ভিন্ন। তবুও বলতেই হয় পরিচালকের হাতে ভিকি এ বার আরও বেশি স্বতন্ত্র। এই ছবিতে তাঁর অভিনয় বহুমাত্রিক। এই চরিত্রে তাঁকে নির্বাচন করার জন্য পরিচালককে ধন্যবাদ। সামনের দিকে ঝুঁকে, দু’হাত আড়ষ্ট করে সারা ছবি জুড়ে হাঁটা। পাশাপাশি পার্সি বাচনভঙ্গি রপ্ত করা— অভিনয়ের প্রতিটি ক্ষেত্রে স্যামকে যেন পর্দায় যাপন করেছেন ভিকি। ‘সর্দার উধম’-এর পর এই ছবি। দু’বছরের ব্যবধানে দুটি বায়াপিকে লেটার মার্কস পেয়ে পাশ করে গেলেন ভিকি। সম্ভবত, ভিকির কেরিয়ারের সেরা অভিনয় এই ছবিতেই নিংড়ে নিলেন মেঘনা।
সময়ের দাবি মেনেই ছবিতে তৎকালীন দেশের গুরুত্বপূর্ণ একাধিক চরিত্র এসেছে। ভিকির মতো তাঁরা কিন্তু ততটা দাগ কাটতে পারেননি। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর চরিত্রে নীরজ কবি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। তুলনায় ইন্দিরা গান্ধী ছবির অনেকটা জায়গা জুড়ে রয়েছেন। এই চরিত্রে ফতিমা সানা শেখের লুকে আরও যত্ন নেওয়া উচিত ছিল। তবে তৎকালীন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের জাতীয় সুরক্ষা বিষয়ক পরামর্শদাতা হেনরি কিসিঞ্জার সঙ্গে কথোপকথনের মতো কয়েকটি দৃশ্যে ফতিমা কিন্তু ভিকিকে ভাল টক্কর দিয়েছেন। পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের চরিত্রে মহম্মদ জ়িশান আইয়ুবের অভিনয় এবং লুক ভাল লাগে। স্যামের স্ত্রী সিলু মানেকশনর চরিত্রে সান্যা মলহোত্রর অভিনয় বড্ড ফ্যাকাশে। একটি মাত্র দৃশ্যে বিশেষ চরিত্রে কল্কি কেঁকলার উপস্থিতি না থাকলেও ক্ষতি ছিল না।
এমন এক জন ক্ষুরধার বুদ্ধিদীপ্ত মানুষ, যাঁর অবর্তমানে আধুনিক ভারতের ইতিহাস হয়তো অন্য ভাবে লেখা হত। তাঁর জীবনীচিত্রের সৎ প্রচেষ্টা বাহবাযোগ্য। তবে এই ছবি যে বক্স অফিস কাঁপাবে, সে আশা হয়তো নির্মাতারাও করছেন না। এখন ‘অ্যানিমাল’ জ্বরে কাবু দর্শক সেনানায়ক মানেকশকে যথাযথ সম্মান দেবেন কি না, দেখা যাক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy