‘অ্যানিম্যাল’-এ রণবীর কপূর। ছবি: সংগৃহীত।
সপ্তাহখানেক আগে মুক্তি পেয়েছিল ছবির ট্রেলার। তার মাস দুয়েক আগে টিজ়ার। ঝলক দেখেই আভাস পাওয়া গিয়েছিল, ‘অ্যানিম্যাল’-এ রক্তারক্তির খামতি হবে না। প্রশ্ন ছিল অন্য। এই মাথায় রক্ত উঠে যাওয়া রাগ নিয়ে ঠিক কোথায় গিয়ে থামবেন পরিচালক সন্দীপ রেড্ডি বঙ্গা? ১ ডিসেম্বর পাওয়া গেল সেই প্রশ্নের উত্তর।
‘অ্যানিম্যাল’ চলতি বছরে রণবীর কপূরের মুক্তিপ্রাপ্ত দ্বিতীয় ছবি। এই বছর ঋষি-পুত্রের প্রথম ছবি ছিল ‘তু ঝুঠি ম্যায় মক্কার’। রোম্যান্টিক কমেডি তথা ‘রম-কম’ ঘরানার ছবি। ছবির ঘরানার সঙ্গে মানানসই রণবীরের চরিত্রও। বছরের শেষে এসে পর্দায় রণবীরের ‘ট্রান্সফর্মেশন’ মনে রাখার মতো। ‘অ্যানিম্যাল’-এর প্রথম ঝলকেই ধরা পড়েছিল তাঁর লম্বা চুল ও একগাল দাড়ির সেই ‘লুক’। অভিনেতা হিসাবে তুখোড় তিনি, ক্যামেরার শাটার সরলেই তাঁর চোখ কথা বলে। উপরি পাওনা তাঁর ওই লুক। পর্দায় স্রেফ রণবীরের ক্যারিশমা দেখার জন্যই মুখিয়ে ছিলেন দর্শকের একটা বড় অংশ। স্বস্তি এই যে, বঙ্গা পরিচালিত এই ছবিতে অভিনেতা হিসাবে তাঁর দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন করার জন্য একচুল জায়গাও ছাড়েননি রণবীর। তবে গোটা ছবি জুড়ে স্বস্তি শুধু সেইটুকুই!
টিজ়ার ও ট্রেলার তো আছেই। পাশাপাশি, ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করলেই বোঝা যায় ‘অ্যানিম্যাল’ আদপে ‘অ্যাকশন/ক্রাইম’ ঘরানার ছবি। তবে হালের ‘ট্রেন্ড’ যা, তাতে গল্পের গরু গাছে উঠলে সেই ঘরানার ছবিও যে মুখ থুবড়ে পড়তে পারে— তার প্রমাণ কম নেই। ‘অ্যানিম্যাল’-এর ক্ষেত্রে অবশ্য খুব একটা ঝুঁকি নেননি সন্দীপ। ছবির মূল গল্প সোজাসাপটা। ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়া, পারিবারিক অশান্তি, সম্পত্তির ভাগ নিয়ে মনোমালিন্য, আর তার ফলবশত হিংসার অবতারণা। তবে বলবীর সিংহ (অনিল কপূরের চরিত্র)-এর প্রজন্ম পর্যন্ত তা স্রেফ হিংসাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। খুনোখুনি আর প্রতিশোধস্পৃহার আমদানি বলবীর সিংহের ছেলের (যে চরিত্রে অভিনয় করেছেন রণবীর) সময় থেকে। বলবীর সিংহের উপরে প্রাণঘাতী হামলা, আর সেই হামলার বদলা নিতে তার রক্তস্নাত ছেলের মেশিনগান নিয়ে গোটা দুনিয়া চষে ফেলা— এই একরৈখিক গল্পেই ৩ ঘণ্টা ২১ মিনিটের চিত্রনাট্য বেঁধেছেন সন্দীপ। ‘অ্যানিম্যাল’ মুক্তির আগে অবশ্য এক অনুষ্ঠানে রণবীর জানিয়েছিলেন, ছবির দৈর্ঘ্য নাকি আগে প্রায় ৪ ঘণ্টা ছিল। পরে সন্দীপ নিজেই সম্পাদনা করে ছবিতে ৩ ঘণ্টা ২১ মিনিটে এনে দাঁড় করিয়েছেন। যদিও ছবি দেখে মনে হতেই পারে, গল্পের যা জোর— তাতে স্রেফ মারামারি আর কাটাকাটি দেখানোর জন্য ৩ ঘণ্টা ২১ মিনিটও বাড়াবাড়ি নয় কি!
গল্পের শুরু রণবীরের চরিত্রের ছোটবেলা থেকে। বাবার জন্মদিন উপলক্ষে স্কুল থেকে তাড়াতাড়ি ছুটি নিয়ে বাড়ি ফেরে সে। বাবাই তার সুপারহিরো। তাই স্কুল থেকে তাড়াতাড়ি ছুটি নিয়ে বেরোতে গিয়ে শিক্ষিকার কাছে মার খেতেও আপত্তি নেই তার। এ দিকে ব্যবসা সামলাতে ব্যস্ত বাবার কাছে ছেলের জন্য দিনে ১০ মিনিটও সময় নেই। এমন অনাদর আর অবহেলার মধ্যে বড় হয়েও, বড় হয়ে বাবার অনুপস্থিতিতে ‘ম্যান অফ দ্য হাউস’ কিন্তু রণবীরই! কলেজে দিদির র্যাগিং হয়েছে শুনে হাই স্কুলের ছাত্র রণবীর সোজা গিয়ে উপস্থিত তার দিদির কলেজে। বেছে বেছে সেই ছেলেদের ‘শিক্ষা’ দিতে হবে তো! সেই ঘটনা থেকে রণবীরের ‘সবক’ শেখানোর হাতেখড়ি। এক সুতোয় বোনা একের পর এক এমন ঘটনাই ‘অ্যানিম্যাল’-এর সারবত্তা। চমক বলতে জনপ্রিয় কোরিয়ান ছবি ‘ওল্ড বয়’-এর আদলে সাজানো অ্যাকশন দৃশ্য, দক্ষিণী ধাঁচে কুর্তা ও ধুতি পরিহিত রণবীরের হিংস্র অবতার, আর মধ্যান্তরের ঠিক আগে বাবার ছত্রছায়া থেকে বেরিয়ে অবশেষে তাঁর চরিত্রের নাম ঘোষণা।
তবে সেখানেই শেষ নয়। ‘অ্যানিম্যাল’-এর প্রচার ঝলক মুক্তি পাওয়ার পর থেকেই ছবিতে ববি দেওলের চরিত্র নিয়ে শুরু হয়েছিল আলোচনা। উৎসাহও কম ছিল না ববির ‘কামব্যাক’ নিয়ে। ছবির দৈর্ঘ্যের তুলনায় খুব একটা বেশি সময় না পেলেও নিজের জাত চিনিয়েছেন ধর্মেন্দ্র-পুত্র। একটাও কথা খরচ না করে স্রেফ অভিব্যক্তির মাধ্যমে রণবীরকে রীতিমতো টেক্কা দিয়েছেন তিনি। অনিল কপূর তথা বলবীর সিংহ, রণবীরের বাবার চরিত্রে উপযুক্ত ও পরিমিত। বলিউডের এই প্রজন্মের অভিজ্ঞ এবং সুঠাম অভিনেতাদের মধ্যে কেন তাঁর নাম প্রথম সারিতে থাকে, তা ফের প্রমাণ করেছেন তিনি। অভিনেত্রী রশ্মিকা মন্দনা ‘গীতাঞ্জলি’ চরিত্রে মানানসই। তবে সন্দীপ রেড্ডি বঙ্গার ছবিতে নায়িকার যে নামমাত্র ভূমিকা, তাতে নিজেকে মেলে ধরার তেমন সুযোগ পাননি তিনি। যতটুকু পেয়েছেন, তা কেটে গিয়েছে রণবীরের রাগ ঠান্ডা করতে করতেই! ছবিতে বিশেষ একটি চরিত্রে আছেন ‘বুলবুল’ খ্যাত অভিনেত্রী তৃপ্তি দিম্রি। তবে ‘বুলবুল’-এ যে মেধার ঝিলিক দেখিয়েছিলেন তিনি, ‘অ্যানিম্যাল’-এর কয়েক মিনিটের ক্যামিয়োয় তা প্রায় নেই বললেই চলে। সন্দীপ রেড্ডি বঙ্গার গতে বাঁধা ছবির নায়িকা হিসাবে তিনি স্রেফ ‘সুন্দরী’!
‘অর্জুন রেড্ডি’, ‘কবীর সিংহ’-এর ধারা বজায় রেখে ‘অ্যানিম্যাল’-এর গান খারাপ নয়। বিশেষত, পাহাড়ি এলাকায় ‘হুয়া ম্যায়’-এর সিনেমাটোগ্রাফি কয়েক মিনিটের জন্য আপনাকে ভুলিয়ে দিতে পারে যে এই ছবি গড়পড়তা বলিউডি প্রেমের ছবি নয়। ছবির শেষের দিকে পঞ্জাবি গায়ক বি প্রাক ‘সারি দুনিয়া জলা দেঙ্গে’ গান ধরলে আপনি বুঝতে পারবেন না, গানটা মন ভরে শুনবেন, না কি ছবির দৃশ্যে মন দেবেন! চিত্রনাট্য লেখা ও পরিচালনার পাশাপাশি এই ছবির সম্পাদনাও করেছেন বঙ্গা। এই ছবিতেই প্রথম বার পুরোদমে সম্পাদক হিসাবে থেকেছেন তিনি। আরও অভিজ্ঞ সম্পাদকের হাতে ছবির দৈর্ঘ্য বেশ কিছুটা ছোট হতেই পারত। শুধু তাই-ই নয়, অতীত ও বর্তমানের টাইমলাইনে সামঞ্জস্য রাখতে গিয়েও একাধিক জায়গায় হোঁচট খেয়েছেন তিনি।
২০১৭ সালে ‘অর্জুন রেড্ডি’ ছবির মাধ্যমে পরিচালক হিসাবে সন্দীপ রেড্ডি বঙ্গার আত্মপ্রকাশ। প্রথম ছবিই ব্লকবাস্টার হিট। ওই ছবির দৌলতেই প্রায় রাতারাতি তারকা হয়ে ওঠেন দক্ষিণী অভিনেতা বিজয় দেবেরাকোন্ডা। বক্স অফিসে দুরন্ত ব্যবসা করলেও ‘অর্জুন রেড্ডি’ নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি। ছবির পরতে পরতে ‘টক্সিক ম্যাসকিউলিনিটি’ তথা উগ্র পৌরুষের উদ্যাপন। শুধু তাই-ই নয়, গার্হস্থ্য হিংসাকেও ‘গাঢ় প্রেম’-এর মোড়কে পরিবেশন করেছিলেন বঙ্গা। তবে ছবি বাণিজ্যিক ভাবে সফল, তার হিন্দি সংস্করণ তৈরি হওয়া যে স্রেফ সময়ের অপেক্ষা— তা আঁচ করতে খুব একটা মাথা খাটাতে হয় না। ২০১৯ সালে মুক্তি পেয়েছিল ‘কবীর সিংহ’। শাহিদ কপূর অভিনীত এই ছবি আদপে ‘অর্জুন রেড্ডি’রই হিন্দি সংস্করণ। সেই ছবিও প্রায় ৪০০ কোটির ব্যবসা করেছিল বক্স অফিসে। বাণিজ্যিক সাফল্যের হুল্লোড়ে ছবি ঘিরে বিতর্ক ধামাচাপা না পড়লেও, প্রেমের অছিলায় পরিচালকের এমন তীব্র নারীবিদ্বেষের ছবি দেখে গা গুলিয়ে উঠেছিল বহু দর্শক ও সমালোচকের। তাঁদের মধ্যে একটা বড় অংশ মহিলা হলেও, শিল্পী হিসাবে সন্দীপ রেড্ডি বঙ্গার শৈলী নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন পুরুষেরাও। ‘অ্যানিম্যাল’-এর মাধ্যমে নিজের ভাবমূর্তি থেকে সেই দাগ মোছার প্রাণপণ প্রচেষ্টা করেছেন বটে বঙ্গা। তবে শুধরানোর বদলে গোটা বিষয়টিকে বরং আরও বিগড়ে দিয়েছেন তিনি। কোনও সম্পর্কে মানসিক বা শারীরিক নির্যাতন সংক্রান্ত বিষয় যে লিঙ্গ রাজনীতির আওতায় পড়ে, সেই রাজনীতির প্রাথমিক পাঠ সম্পর্কেও যে অবগত নন তিনি, তার প্রমাণ ‘অ্যানিম্যাল’-এর ছত্রে ছত্রে।
‘কবীর সিংহ’ মুক্তি পাওয়ার পর ছবি ঘিরে বিতর্ক প্রসঙ্গে মুখ খুলে বঙ্গা বলেছিলেন, ‘‘অনেকে আছেন যাঁরা ‘অর্জুন রেড্ডি’কে হিংসার সিনেমা বলেছেন। আমি দেখিয়ে দেব ‘ভায়োলেন্ট ফিল্ম’ কাকে বলে!’’ জনসমক্ষে এক সাক্ষাৎকারে যে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন বঙ্গা, তাতে নিজের রিপোর্ট কার্ডে লেটার মার্কস পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন তিনি। তবে সাড়ে তিন ঘণ্টা ধরে রক্তারক্তি আর সময়ে সময়ে ‘ফুট ফেটিশ’ (পায়ের পাতার প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার প্রবণতা) দেখালেই যে কোয়েন্টিন টারান্টিনো হয়ে ওঠা যায় না, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণই তিনি নিজেই।
পুনশ্চ: তবে, এখনও টারান্টিনো হওয়ার চেষ্টার ইতি টানতে রাজি নন বঙ্গা! বক্স অফিসে ‘অ্যানিম্যাল’ প্রত্যাশিত সাফল্য অর্জন করলেই আসছে এই ছবির সিক্যুয়েলও। নাম জানেন? ‘অ্যানিম্যাল পার্ক’!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy