Advertisement
০৭ অক্টোবর ২০২৪
Movie Review

উৎসবের কলকাতা থেকে কত দূরে আলো-আঁধারির গথাম? খোঁজ দিতে পারে ‘জোকার: ফোলি আ দ্যু’

‘জোকার: ফোলি আ দ্যু’ দেখতে গিয়ে বড় বিরক্ত হয়েছি। ভয় পেয়েছি। উত্যক্ত হয়েছি। ছবিজুড়ে এত বিষণ্ণতা। উৎসবের শহরে এত বিষণ্ণতা প্রদর্শিত হলো কার আদেশে?

Image of Joaquin Phoenix and Lady Gaga

‘জোকার: ফোলি আ দ্যু’ ছবির পোস্টারে হোয়াকিন ফিনিক্স ও লেডি গাগা। ছবি: সংগৃহীত।

পীযূষ আশ
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০২৪ ১২:৪৯
Share: Save:

হারলিন প্রিয়তমাসু,

জানি, চিঠি লেখবার দিন নয় অদ্য। লেখার কথাও ছিল না। আপনি হয়তো জানেন না, কলকাতায় এখন উৎসব। উৎসবে কারই বা লিখতে ভাল লাগে! উৎসব মানে প্রমোদ। তাতে গা ঢেলে দিতে হয়। গায়ে উৎসব মাখতে হয়। মাখতে হয় আলো, বাজনা, ভিড়-শব্দ-বিস্মৃতি, অনেক কিছু। চিঠি লেখার জো থাকে? আপনিই বলুন।

আর আপনি বলবেনই বা কেন? কলকাতা থেকে গথাম অনেক দূর। আপনার শহর আলো-আঁধারিতে ঢাকা। আমার শহর উজ্জ্বল। ভদ্রজনের পছন্দের রঙ ধূসর, একদা এমনই লিখেছিলেন শাহ্‌যাদ ফিরদৌস। উৎসবের শহরে, এই চড়া আলোয়, ততোধিক অশ্লীল উজ্জ্বলতায় মনে হয় ধূসরতাই ভাল। আলো-আঁধারি ভাল। তা হলে অন্তত আমাদের বিশ্রী ক্ষতগুলো লুকিয়ে রাখা যায়। বৃষ্টিবিন্দুতে মিশিয়ে দেওয়া অশ্রুজলের মতো। কিন্তু, যাক সে কথা।

আচ্ছা, গথাম কি এখন শোকস্তব্ধ? নাকি আনন্দে মাতোয়ারা? দ্বিতীয়টাই স্বাভাবিক। শহরের অন্যতম সুপারভিলেন কারাগারে মৃত। জোকারের দেহ শীতল মেঝেতে শায়িত। শরীর জুড়ে ছুরির আঘাত। রক্ত। সেই রক্তরেখা মেখে নিয়েছে আর একজন। ওষ্ঠরঞ্জনীর মতো। ঠোঁট ছাড়িয়ে রক্তের দাগ উঠে গিয়েছে গালের দু’পাশে। হত্যাকারী হাসছে। গথামও কি উৎসবমুখর, কলকাতার মতো?

Review of the film Joker: Folie a Deux staring Joaquin Phoenix Lady Gaga directed by Todd Phillips

রামধনুর বর্ণচ্ছটার পরিবর্তে এ ছবি যেন লেজারের সুসংহত, সুতীক্ষ্ণ আলোকরশ্মি। ছবি: সংগৃহীত।

কী জানেন, আপনাদের এই ‘জোকার: ফোলি আ দ্যু’ দেখতে গিয়ে বড় বিরক্ত হয়েছি। ভয় পেয়েছি। উত্যক্ত হয়েছি। ছবি জুড়ে এত বিষণ্ণতা! উৎসবের শহরে এত বিষণ্ণতা প্রদর্শিত হল কার আদেশে? তদন্ত হওয়া উচিত।

আসলে, খুলেই বলি, পরিচালক টড ফিলিপসকে সুবিধের মনে হয় না কোনও দিন। ব্রুকলিনের ইহুদি, পকেটে ডলার নেই। অথচ নিউ ইয়র্ক ফিল্ম স্কুলে পড়ার শখ। শেষে ড্রপআউট, দোকান থেকে চুরির অভিযোগে ঝামেলা— এ সব নানা অন্ধকারময় পর্ব। এ হেন মানুষ ক্যামেরা ধরলে, ভেসে যায় আদরের নৌকা, তৈরি হবে পৌনপুনিক, আশা করা যায় না। হয়ওনি তা। ২০১৯-এর ‘জোকার’-এ নয়। ২০২৪-এর সিক্যুয়েল ‘জোকার: ফোলি আ দ্যু’-তেও না।

ব্যাটম্যানের মতো সুপারহিরোর বিপ্রতীপে থাকতে হলে শুধু ভিলেন হলে চলবে না। তাকে হতে হবে সুপারভিলেন। জোকার তা-ই ছিল। কিন্তু সময় বদলায়, ভাঙনের ছাপ পড়ে সর্বত্র। চরিত্রটাকে ভাঙতে শুরু করলেন হিথ লেজার। পরিচালক ক্রিস্টোফার নোলানের সুবাদে। কিন্তু, হিথের জোকার বেশি দিন দেখতে পেলেন না দর্শকেরা। ‘দ্য ডার্ক নাইট’-এ অভিনয়ের সুবাদে পুরস্কার পেলেন হিথ ‘জোকার’ লেজার। পুরস্কার মঞ্চে উঠে পুরস্কার নিলেন পরিচালক নোলান, পরিবারের লোক। কেন না হিথ তখন মৃত, ২৮ বছরে।

Review of the film Joker: Folie a Deux staring Joaquin Phoenix Lady Gaga directed by Todd Phillips

এই ছবিতে লেজার রশ্মির মতোই ধ্বংসাত্মক লেডি গাগা অর্থাৎ হারলিন কুইনজেলের উপস্থিতি। ছবি: সংগৃহীত।

এরপর টড ফিলিপসের হাত ধরে জোকারের মঞ্চে পা-রাখলেন হোয়াকিন ফিনিক্স। ভাঙাচোরার আর কিছু বাকি রইল না। অবশ্য পরিচালকের মতো অভিনেতাও অনেক ভাঙাগড়ার মধ্যে দিয়ে গিয়েছেন। অভিনয় করছেন ছোটবেলা থেকে। ফিনিক্স ভাইবোনেরা ছোটবেলা থেকে প্রকৃতিপ্রেমী। দাদা রিভার ফিনিক্স বেশ নাম করছিলেন হলিউডে। ১৯৯৩ সালে নৈশক্লাব ‘দ্য ভাইপার রুম’-এর বাইরে মাদক ব্যবহার করতে গিয়ে মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েন। হোয়াকিন সঙ্গে ছিলেন। পুলিশ, প্যারামেডিক ডেকেও ফল হয়নি। বাঁচানো যায়নি রিভারকে। প্রকৃতিপ্রেমী হোয়াকিন তখন নিজেকে ‘লিফ ফিনিক্স’ বলে পরিচয় দিতেন। এই নামেই অভিনয় করতেন। দাদার মৃত্যুতে অভিনয় ছেড়ে দিলেন কয়েক বছরের জন্য। ফিরলেন স্বনামে, হোয়াকিন হয়ে। আমাদের বর্তমান‘জোকার’।

না, ‘হার্টথ্রব হিরো’ কোনও দিনই হতে চাননি ফিনিক্স। কিন্তু কমিকসের জোকার যে এমনটা হতে পারে, তা কি কোনও দর্শক আন্দাজ করতে পেরেছিলেন? না। এই জোকার এক কৃশকায় মানুষ। নাম আর্থার ফ্লেক। কৃশকায় মানুষেরও বড় স্বপ্ন থাকে। আর্থারের স্বপ্ন সফল কমেডিয়ান হওয়া। কিন্তু তার পদে-পদে বাধা। চাকরি যাওয়া, দারিদ্র, মায়ের অসুস্থতা। এবং নিজের অসুখ। অসুখটা বিচিত্র। কেন না, রোগের নামই হাসি। এবং সেই হাসির উপর আর্থারের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। থাপ্পড় খেয়ে, পুলিশের গাড়িতে, গণপরিবহণে— নানা অবস্থায়, নানা পরিস্থিতিতে রোগ তাকে উচ্চগ্রামে হাসতে বাধ্য করে। হাসি থামাতে গিয়ে চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে আসে। দমবন্ধ হয়ে যায়। হাসি থামে না। আর্থার পকেটে কার্ড নিয়ে ঘোরে। যাতে লেখা, হাসি তার রোগ। শারীরিক সমস্যা। পড়া হয়ে গেলে কার্ডটি তাকে যেন ফেরত দেওয়া হয়। হাসির ব্যাধিতে আক্রান্ত টড ফিলিপসের জোকার আত্মপ্রকাশ করে ২০১৯ সালে।

ব্যাটম্যান বা ব্রুস ওয়েনের সঙ্গে এই জোকার যে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে, তা নয়। প্রছন্ন নানা সূত্রে ঘুরেফিরে এসেছে ওয়েন পরিবার। একাধিক হত্যাকাণ্ডের জেরে বন্দি হয় আর্থার। প্রথম ছবির গল্প মোটামুটি এখানেই শেষ। ‘জোকার: ফোলি আ দ্যু’ শুরু হয়েছে বন্দি আর্থারকে দিয়ে। একটি সফল আগ্নেয়গিরি হওয়ার রসদ পেটে পুরে যাত্রা শুরু করেছিল সিক্যুয়েলটি। কিন্তু গলন্ত লাভা এই ছবিতে বেরিয়ে আসেনি। বরং প্রথম ছবির চেয়েও এটি বেশি সংযত। রামধনুর বর্ণচ্ছটার পরিবর্তে যেন লেজারের সুসংহত, সুতীক্ষ্ণ আলোকরশ্মি। হোয়াকিনের পর্দা-উপস্থিতি দর্শককে আসনে বসিয়ে রাখবে শেষ পর্যন্ত। যাঁরা মেথড অ্যাকটিং জানেন, এবং বোঝেন, তাঁরা হয়তো এই নিয়ে বিশদ বলতে পারবেন। সে সব আমি বুঝি না। তবে এটুকু বুঝি, এই ছবিতে লেজার রশ্মির মতোই ধ্বংসাত্মক লেডি গাগা অর্থাৎ হারলিন কুইনজেলের উপস্থিতি। তা সরাসরি প্রবেশ করে দর্শকের হৃদয়ে। মট-মট করে ভেঙে দেয় গুটিকয় পাঁজর। লেডি গাগা, এই চিঠি তাই আপনার হারলিনকেই লেখা।

সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের যাবতীয় লেখালেখির মতো সিক্যুয়েলের গল্পও আড়াই লাইনের। আর্থারের আইনজীবী জানায়, আদালতে বুঝিয়ে দিতে হবে জোকার এবং আর্থার পৃথক ব্যক্তিসত্তা। সে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছে ঠিকই, কিন্তু এক মানসিক ‘ডিজ়অর্ডার’-এর কারণে। শাস্তি নয়, শুশ্রূষা প্রয়োজন তার। মিউজিক থেরাপির ক্লাসে আর্থারের সঙ্গে আলাপ হয় হারলিন কুইনজেলের। আলাপ, পরিচয় এবং প্রণয়। আদালতের দীর্ঘায়িত শুনানিতে আর্থার তার আইনজীবীকে বরখাস্ত করে। নিজেই সওয়াল করার আবেদন জানায়। এবং শেষ পর্বে বিরক্ত, উত্যক্ত আর্থার বলে দেয়, জোকারের কোনও পৃথক ব্যক্তিসত্তা নেই। তারা এক এবং অভিন্ন। জুরিরা আর্থারকে দোষী সাব্যস্ত করে। এরই মধ্যে মুক্তি পায় হারলিন। জানা যায়, সে অপরাধী নয়, মনস্তত্ত্বের ছাত্রী। আর্থারের সঙ্গে দেখার করার জন্যই সংশোধনাগারে প্রবেশ করেছিল। জুরিরা যে দিন আর্থারকে দোষী সাব্যস্ত করে, সে দিন এক বিস্ফোরণে আদালত কক্ষের একাংশ ভেঙে পড়ে। বিস্ফোরণে ‘মুক্ত’ আর্থার শহরের রাস্তায় হারলিনকে দেখতে পায়। আর্থার তাকে নিয়ে নতুন জীবন শুরু করার কথা বলে। হারলিন রাজি হয় না। সে আর্থার নয়, জোকারকে ভালোবাসে, জোকারকেই চায়। আর্থার তার জোকার-সত্তাকে অস্বীকার করায় হারলিনের ভালোবাসা বেপথু হয়েছে। ইতোমধ্যে পুলিশ আবার ঘিরে ফেলে তাদের দু’জনকে। আর্থার সংশোধনাগারে ফিরে যায়। এবং এক সহবন্দির ছুরিকাঘাতে মারা যায়। সে প্রসঙ্গ চিঠির শুরুতেই রয়েছে।

Review of the film Joker: Folie a Deux staring Joaquin Phoenix Lady Gaga directed by Todd Phillips dgtl

ছবিটি মিউজিক্যাল। সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার হওয়া সত্ত্বেও। গান ছবির প্রাপ্তি না মেদ, তা সমালোচকরা বিচার করবেন, কিন্তু অভিনয়ে আর উপস্থিতিতে এই ছবির সম্পদ হয়ে থাকবেন লেডি গাগা। ইটালিয়ান বংশোদ্ভূত স্তেফানি জোয়ানে অ্যাঞ্জেলিনা জেরমানত বা গানের জগতের লেডি গাগা যদি অভিনয়ে আর একটু বেশি সময় দেন, তা হলে প্রাপ্তি সকলেরই। টড ফিলিপস জানিয়েছেন, জোকার নিয়ে আর কোনও ছবি তাঁর ভাবনায় নেই। কিন্তু হার্লে কুইন, মার্গো রবির পরিবর্তে নতুন হারলিনকে নিয়ে স্ট্যান্ডঅ্যালোন ছবি হতেই পারে। প্রতীক্ষায় থাকবেন অনেকেই।

‘জোকার: ফোলি আ দ্যু’ নিয়ে আর কিছু বলার নেই। শারদ-সাহিত্যের মতো পুজোর ছবিও বাঙালির আগ্রহের জায়গা। তাদের কে ক’টা প্রাইজ পেল, বক্স অফিসে কতটা সাড়া ফেলল, নাগরিক অবকাশে সেই আলোচনাও হয়। এই বছর কি তার ব্যতিক্রম? সঠিক জানা নেই। তবে কাকতলীয় হলেও, এমন একটি বিষাদমাখা ছবি হয়তো নাগরিকদের একাংশ এ সময় দেখতে চেয়েছিলেন। আশ্বিনের শারদপ্রাতে পুজোর হাওয়া বয় শনশন। সে হাওয়া আর্দ্র— বৃষ্টি কিংবা বন্যার জলে, অশ্রুতে, এবং মানতে না চাইলেও, রক্তের লোনা স্বাদে। আবশ্যিক উৎসবে আনন্দ থাকে না। তাই বাংলা ভাষায় তৈরি না হলেও,বাংলার পুজোর অন্যতম সিনেমা এটাই। অন্তত, এই বছরের জন্য।

ধন্যবাদ ছবি নির্মাতা, অভিনেতাদের সবাইকে।

ইতি,

উৎসবের শহরে নামহীন একজন

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE