‘ভূস্বর্গ ভয়ঙ্কর’ সিরিজ়ের নির্মাণে কোথাও কোনও খামতি রাখেননি পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়।। ছবি: সংগৃহীত।
বাংলা ওটিটির ফেলুদা ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি রাজত্বে আপাতত সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের একাধিপত্যের শেষ হল রায়বাবুর সৃষ্টি ‘ভূস্বর্গ ভয়ঙ্কর’ দিয়ে। সে কারণেই হয়তো, ফেলুদার রহস্য সমাধানের গল্পগুলির মধ্যে অন্যতম কঠিন গল্পটিকেই বেছে নিয়েছেন পরিচালক সৃজিত। এই রহস্য গল্পে চরিত্র একাধিক, তাদের মূল্যবোধও নানা মাত্রার। তার থেকেও বড় কথা, ঘটনার ঘনঘটা এ গল্পে বেশ জটিল। সঙ্গে অবশ্যই যোগ হবে গল্পে ভূস্বর্গ, মানে কাশ্মীরের মতো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থানের অবস্থিতি।
যদিও ছোট পর্দার জন্যই মূলত নির্মিত, ওটিটি আঙ্গিকে এই ছ’পর্বের ছবি (প্রায় তিন ঘণ্টা)। সৃজিত এটি তুলেছেন বড় পর্দার মেজাজে। তাতে যা হওয়ার তাই হয়েছে। একটি আশ্চর্য সুন্দর জায়গায় তোলা বেশ কয়েকটি দুর্দান্ত দৃশ্যের অবতারণা ঘটিয়ে ফেলেছেন পরিচালক ও সিনেমাটোগ্রাফার (রম্যদীপ সাহা) মিলে। শ্রীনগরের ডাল হ্রদের কাচস্বচ্ছ জলে দু’টি শিকারার কাছাকাছি আসার ‘এরিয়াল শট’, কিংবা নাঙ্গা পর্বতশৃঙ্গের ঝলকের মতো কয়েকটি কাব্যময় দৃশ্যের সৃষ্টি হয়েছে, যা সত্যিই দর্শকের চোখকে আরাম দেবে। তবে এ কথাও অনস্বীকার্য যে প্ল্যানচেটের দৃশ্যগুলি তেমন জমাতে পারেননি দু’জনে। শিল্পনির্দেশকও তেমন কোনও ছাপ ফেলতে পারেননি এই দৃশ্যগুলিতে। একটি সবুজ কাচ ঢাকা মোমবাতি, টেবিলের চারপাশে কয়েকটি চেয়ার পেতে প্রায়ান্ধকার ঘরে পাঁই পাঁই করে ক্যামেরা ঘোরালেই তো রোমাঞ্চ তৈরি হয় না। অবশ্য পরিচালক বা সিনেম্যাটোগ্রাফারকে এই দোষে দোষী সাব্যস্ত করাটা উচিত নয়। নিজে পরিচালক হয়েও সত্যজিৎ প্ল্যানচেটের দৃশ্যগুলিতে এর চেয়ে বেশি কোনও সূত্র দেননি মূল গল্পে। তাই পুরো দোষটি সৃজিতদের নয়।
যদিও অন্যদের সংলাপের বা ভাবনার অনেকটাই ফেলুদার মুখ দিয়ে বলিয়েছেন সৃজিত (অবশ্য ছবির ছকে সেটিই নায়কোচিত দেখায়), মূল গল্পকে কখনওই কাটছাঁট করেননি সৃজিত। সত্যজিতের মূল কাহিনিতে যে ঘটনা, যেখানে ঘটেছে, সে রকমই রেখেছেন আগাগোড়া। এমনকি বাংলা ছবির টানাটানির সংসারে (বাংলায় ওটিটির লগ্নিতে আরওই কাটছাঁট) ‘ভূস্বর্গ ভয়ঙ্কর’-এ শ্রীনগরে হাউসবোট, গুলমার্গে লগ কেবিন আর পহেলগামে তাঁবু, ঠিক যেমন মূল গল্পে লেখা আছে, সে রকমই দেখানো হয়েছে সিরিজ়েও। তার সঙ্গে প্রত্যেকটি জায়গার ভূস্বর্গদৃশ্যও। অর্থাৎ, শীতের ছুটিতে বেশ একটি কল্পভ্রমণের ব্যবস্থাও করা হয়েছে সাড়ম্বরে। তার সঙ্গে সৃজিত মূল গল্পের বাইরে ভ্রমণপিপাশুদের জন্য জুড়ে দিয়েছেন অতিরিক্ত কিছু। যেমন কাশ্মীরি লোকনৃত্য এবং একটি ‘ওয়াজ়ওয়ান’ খানাপিনার দৃশ্যও। এর সঙ্গে যোগ হতে পারে, কয়েকটি রসসঞ্চিত দৃশ্যের অবতারণাও: যেমন, ‘কালাশনিকভ’ শব্দটিকে লালমোহনবাবুর ‘কৈলাশে কী বললেন’ আর আমির খসরুর ‘খসরু’কে ‘খুচরো’ শোনা। মানে বলতে চাইছি, নিজের আপাতত শেষ ফেলুদা সিরিজ়ে কোনও খামতি রাখেননি পরিচালক। তবে তার মধ্যে, নিজের তদন্তের গল্পগুলির স্মৃতিচারণার অছিলায় ফেলুদার অন্য কাহিনীগুলির সঙ্গে ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এ মগনলালের আড্ডায় সেই ছুরি ছোড়ার দৃশ্যের পুনর্গঠন কিছুটা হলেও দর্শকমনকে ধাক্কা দেয়। বিশেষত রায়বাবুর তৈরি আসল সিনেমাটি যাঁরা দেখেছেন, তাঁদের কথা বলছি। যতই টোটা, অনির্বাণ, কল্পনকে এখন আপন করে নিক বাঙালি, প্রথম সিনেমাত্রয়ীর সেই দৃশ্যে অধুনা চরিত্রদের দেখতে একটু ধাক্কা মনে লাগে বইকি! বিশেষত যখন সেই ত্রয়ীর দু’জন আর উপস্থিত নেই আমাদের মধ্যে। হাজার হোক, বাঙালি তো এই ছোট ছোট ‘নস্টালজিয়া’গুলি নিয়েই বেঁচে থাকতে পছন্দ করে।
আর একটি কথা, ‘ভূস্বর্গ ভয়ঙ্কর’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৭-তে। কাশ্মীরে, প্রতিবেশী দেশের মদতে জঙ্গি কার্যকলাপ শুরু হতে-হতে গত শতাব্দীর আশির দশকের শেষ দিক, মানে এই ১৯৮৯-’৯০। যে সিরিজ়ে দেখানো হচ্ছে চরিত্রেরা ল্যান্ডলাইনের টেলিফোনের উপর নির্ভরশীল, তাদের কাহিনিতে জঙ্গিহানার আবহ আনার খুব কি প্রয়োজন ছিল? প্রায় সর্বাঙ্গসুন্দর একটি সিরিজ়ে ওই সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামার শেষ দৃশ্যটি একফোঁটা বিষের মতোই মনে হল। বিশেষত যখন মনের কোণে এই বিশ্বাস দৃঢ় যে, সত্যজিৎ রায় কোনওদিন নিজের কিশোর সাহিত্যে এক কণা হিংসাকে স্থান দেননি। এবং প্রাপ্তবয়স্কদের ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হলেও ফেলুদা প্রধানত বাঙালি কিশোরসাহিত্য!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy