চলচ্চিত্র বা সিনেমার ইতিহাসে কিছু পুরুষ চরিত্র রয়ে যায় যারা তাদের পুরুষ ফ্যানেদের কাছে অর্থাৎ পাঠক বা সিনেমা দর্শকদের কাছে আজীবন কালজয়ী হয়ে থাকে।
আমার নিজের চোখে দেখা এবং পড়া এমন দুটি চরিত্র হল শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যোমকেশ এবং ইয়ান ফ্লেমিংয়ের জেমস বন্ড। পুরুষমানুষেরা জেমস বন্ড বা ব্যোমকেশের মধ্যে কী পান যেটা অন্য কোনও কাল্পনিক চরিত্রে পাওয়া যায় না চট করে?
আসলে আমরা সবাই বাস্তবে অনেকটাই অনিশ্চয়তায় ভুগি নিজেদের নিয়ে। এই অনিশ্চয়তার জায়গা থেকে যখন বড় পর্দায় জেমস বন্ড এসে বারবার আমাদের দেখিয়ে দেয় শক্তিশালী হওয়া কাকে বলে, সফিসটিকেশন কাকে বলে, কী ভাবে টাক্সিডো পরতে হয়, অসম্ভব ভাল গাড়ি চালাতে হয়, মার্টিনি হাতে রেখে কী ভাবে একটি মেয়েকে প্রেমে পড়াতে হয়, সকালে উঠে একটা ডিম কী ভাবে ভেজে নিতে হয়, তখন কোথাও যেন নিজেদের স্বপ্নপূরণটা জেমস বন্ডের হাত ধরে হয়ে যায়। সবটাই জেমস বন্ড জানে এবং পারে। এই জন্যই কি শন কনারি থেকে ড্যানিয়েল ক্রেগ অবধি জেমস বন্ডের নতুন ছবির জন্য দর্শকেরা এখনও উন্মাদের মতো অপেক্ষা করে থাকেন?
জেমস বন্ড ফ্র্যানচাইজির নতুন অধ্যায় ‘স্পেক্টর’ দেখে এসে এইটুকু শুরুতে বলে দিই, জেমস বন্ড বলতে যা বুঝে এসেছি ড্যানিয়েল ক্রেগ সেই চরিত্রে এখনও অনবদ্য। তবে ড্যানিয়েলের অভিনীত জেমস বন্ডের মধ্যে এখনও আমার প্রিয় দুটি ছবি ‘ক্যাসিনো রয়াল’ এবং ‘স্কাইফল’। তাই বলতে বাধ্য স্যাম মেন্ডিস পরিচালিত ‘স্কাইফল’য়ের পরে ‘স্পেক্টর’ হয়তো একটু কম ভাল লাগবে। সেটা ‘স্পেক্টর’য়ের দোষ নয়, ‘স্কাইফল’য়ের গুণ। আসলে বলা যায় ‘স্কাইফল’ এতটাই দুর্দান্ত, মনের মধ্যে একটা তুলনা হতে বাধ্য। কিন্তু ‘স্কাইফল’য়ের সঙ্গে তুলনাটাকে মুহূর্তের জন্য যদি সরিয়ে রাখতে পারি তা হলে কিন্তু আমার মতে ‘স্পেক্টর’ যথেষ্টই ভাল ছবি। জেমস বন্ডের ছবি থেকে দর্শক যা যা আশা করেন, তা ভরপুর পাবেন।
এই ছবিতে চিত্রনাট্য একটা বড় ভূমিকা নিয়েছে। তার কারণ এই প্রথম বার জেমস বন্ডের মতো একটা ছবিতে তার আগের গল্পগুলোর ছোঁয়া থাকছে। ছোট করে গল্প বলতে গেলে ‘স্পেক্টর’য়ের বন্ড এখনও বোঝার চেষ্টা করছে ওর জীবনকে এত জটিল এবং রহস্যময় কে বা কারা করে তুলেছে। এবং এই সমস্যার যত বার সমাধান করার চেষ্টা করে তত বার একটাই সত্যি বেরিয়ে পড়েছে যে, জেমস বন্ডের সবথেকে বড় শত্রু হচ্ছে তার নিজের অর্গানাইজেশন ‘স্পেক্টর’।
খলনায়ক ফ্রানজ ওবারহাউজের চরিত্রে ক্রিস্টোফ ওয়াল্টজ অতুলনীয়। ক্রিস্টোফের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় এবং প্রেম সেই কোয়েন্টিন ট্যারেনটিনোর ‘ইনগ্লোরিয়াস বাস্টার্ড’ থেকে। এখনও দর্শককে কী ভাবে হতবাক করে দিতে হয় সেটা ক্রিস্টোফ ভাল ভাবেই জানেন। জেমস বন্ডের সিনেমার কথা এলে বন্ড গার্লদের বাদ দিয়ে ভাবাটা ভুল। ‘স্পেক্টর’য়ের প্রথম বন্ড গার্ল মোনিকা বেলুচ্চি অসামান্য এবং একই সঙ্গে চোখ ধাঁধানো লুসিয়া স্কিয়েরা চরিত্রে। লুসিয়া হচ্ছে বন্ডের হাতে নিহত এক খলনায়কের স্ত্রী, বিধবা। এবং যে কয়েকটা মুহূর্তের জন্য রয়েছেন মোনিকা, হয়তো সেটা হাতে গুনে দশ মিনিটও হতে পারে, কিন্তু এই চরিত্র ভোলবার নয়। ‘স্পেক্টর’য়ে আর এক বন্ড গার্ল হল, লিয়া সিঁদু, যাকে দর্শক মনে রেখেছে টম ক্রুজ অভিনীত ‘মিশন ইমপসিবল: ঘোস্ট প্রোটোকল’ থেকে। এই ছবিতে লিয়া অভিনয় করেছেন ডা. ম্যাডেলিন সোয়ান নামে এক মনোবিদের চরিত্রে। ম্যাডেলিনের সঙ্গে বন্ডের অতীতের একটা যোগাযোগ আছে। লিয়া এই ছবিতে ভোলবার নয়।
তবে এক কথায়, সিনেমার ম্যান অব দ্য ম্যাচ বলতে গেলে পরিচালক স্যাম মেন্ডেস। কী ভাবে অ্যাকশন সিক্যুয়েন্স শ্যুট করতে হয়, সেটা সত্যি এই ছবিতে দেখিয়ে দিয়েছেন। এবং আড়াই ঘণ্টা ধরে কী ভাবে একটা ছবিতে সাসপেন্স ধরে রাখতে হয়, তার মাস্টার ক্লাস নিয়েছেন স্যাম।
তবে ছবি দেখে বেরোতে বেরোতে একটাই প্রশ্ন রয়ে যায়, সত্যিই কি জেমস বন্ডে দাঁড়ি টানা হল ‘স্পেক্টর’য়ের হাত ধরে! নাকি আরও জেমস বন্ড হতে পারে? এটা ভাবতেই কী রকম ভয় লাগে যে এমন একটা ভবিষ্যতের দিকে আমরা এগিয়ে চলেছি যেখানে জেমস বন্ড নেই।
তবে ব্যোমকেশ যদি থাকতে পারে, বন্ড আর কোথায় যাবে? নিজেকে এই প্রশ্ন করে নিজেই উত্তর দিয়ে ভয়টা কমেছে। যে ফ্র্যানচাইজের পঞ্চাশ বছর পার হয়ে গিয়েছে তাকে কালজয়ী না বলে আর কী বলি বলুন? যদি সত্যি বন্ডের গল্প শেষ হয় ‘স্পেক্টর’য়ের হাত ধরে তা হলে বলতে হয় বন্ড শেষ ইনিংসে সেঞ্চুরি করে বিদায় নিলেন।
এতক্ষণ আমি জেমস বন্ডের ফ্যান হিসেবে লেখাটা লিখলাম, কিন্তু যাঁরা জেমস বন্ডের ছবি দেখেন না তাঁরা ‘স্পেক্টর’টা অন্তত একবার দেখে আসতে পারেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy