সোনাদা-আবির-ঝিনুক এ বার পৌঁছে গেল রোহিতাশ্বগড়। রাজা শশাঙ্কের হারিয়ে যাওয়া গুপ্তধনের সন্ধানে শুরু হল তাঁদের নতুন অভিযান। ছবি: সংগৃহীত
পুজোর সময় বাঙালি কী চায়? ভিড় ঠেলে ঠাকুর দেখা, লাইন দিয়ে রেস্তরাঁয় খাওয়া, দেদার আড্ডা দেওয়া। আর যদি এমন একটা ছবি বাজারে আসে যা সপরিবারে হইহই করে দেখা যায়, তা হলে তো হয়েই গেল— পুজো ভাল কাটবেই! বাঙালির সেই চাহিদা পূরণ করতেই পরিচালক ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায় এ বার হাজির হয়েছেন তাঁর ‘সোনাদা’ ফ্র্যাঞ্চাইজ়ির তৃতীয় ছবি ‘কর্ণসুবর্ণের গুপ্তধন’ নিয়ে। সোনাদা-আবির-ঝিনুক এ বার পৌঁছে গেল রোহিতাশ্বগড়। রাজা শশাঙ্কের হারিয়ে যাওয়া গুপ্তধনের সন্ধানে শুরু হল তাদের নতুন অভিযান।
পুজোয় প্রতি বারই মুক্তি পায় এক গুচ্ছ বাংলা ছবি। কোনওটা চলে, কোনওটা কম চলে। তবে মোটের উপর বাকি বছরের তুলনায় এই সময়টা সব ছবিই ভাল চলে। তার মধ্যে কোনও একটা ছবি পেয়ে যায় বক্স অফিসের গুপ্তধন। ইতিহাসের অধ্যাপক তথা গুপ্তধনের খোঁজে পারদর্শী সুবর্ণ সেন বা ‘সোনাদা’ (আবীর চট্টোপাধ্যায়) এমনিতেই সব কঠিন সঙ্কেতের সমাধান নিমেষে করে ফেলতে পারে। এতটাই যে তাকে এক মুহূর্তের জন্যেও কিছু ভাবতে হয় না। সে ঠিক জানে, কী ভাবে কী করলে কোনও গুপ্ত দরজা খুলে যেতে পারে আর বেরিয়ে আসতে পারে লুকনো ধনসম্পদ! তাই তার পক্ষে বক্স অফিসের গুপ্তধনটাও বোধহয় সহজে পেয়ে যাওয়া সম্ভব। কারণ, তাকে সঙ্গ দিচ্ছে বিভিন্ন ছোট ছোট সহজ সঙ্কেত। রয়েছে বাংলার ইতিহাসের রোমাঞ্চকর কাহিনি, আবির (অর্জুন চক্রবর্তী)-ঝিনুকের (ইশা সাহা) মজাদার রসায়ন, বেড়াতে যাওয়ার স্বাদ, মনে ফূর্তি আনা কিছু গান, সপরিবারে বসে ঘন ঘন পাত পেড়ে খাওয়া, দুষ্টু ভিলেন, হাসির ভিলেন, অপহরণ, কার চেজ, ধাঁধার সমাধানে বুদ্ধির খেলা, নায়কের গোপন প্রেমের আভাস, একাধিক স্থান পরিবর্তন— সবই যখন মুচমুচে মোড়কে সাজানো হবে, খাপে খাপে বসবে প্রতিটা সঙ্কেত, তখন বক্স অফিসের গুপ্তধন তো হাতের মুঠোয় আসবেই।
অন্যান্য ফ্র্যাঞ্চাইজ়ির মতো সোনাদার গল্পগুলোর ভিত সাহিত্য নয়। তাই গল্প নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার বিস্তর সুযোগ রয়েছে। যদিও সব অভিযানই যদি গুপ্তধনের সন্ধানে হয়, তা হলে খানিকটা এক রকম হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে বৈকি। এ ছবির চিত্রনাট্যের পরতে পরতে তাই ছড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন ধংসস্তূপে যাওয়া, কোনও বিশেষ জায়গায় জেনে বা না-জেনে চাপ পড়ে যাওয়া এবং গোপন কোনও দরজা খুলে যাওয়া! বড় পর্দায় এই ধরনের ‘স্পেক্টাক্ল’ অবশ্য দেখতে মন্দ লাগবে না দর্শকের। বিশেষ করে ছোটদের বিস্ময়কর চোখে তো এ সবই উপভোগ্য। আর ইন্ডিয়ানা জোন্স যদি প্রত্যেক ছবিতে ইতিহাস ধাওয়া করে কামাল দেখাতে পারে, আমাদের সোনাদাই বা কেন পারবে না!
দু’টো ছবির পর সোনাদার চরিত্রের সঙ্গে আবীর সহজেই মিলেমিশে গিয়েছেন। ব্যোমকেশের ধুতি-পাঞ্জাবিতে তিনি যতটা স্বচ্ছন্দ, ততটাই কেতাদুরস্ত জ্যাকেট-ট্রাউজ়ার-গগল্সে। এখনকার প্রজন্মের মধ্যে ইতিহাস নিয়ে কতটা উৎসাহ রয়েছে জানা নেই, তবে সুবর্ণ সেনের মতো স্মার্ট অধ্যাপক পেলে নতুন করে উৎসাহ জাগতেই পারে। আবীরের কথা বলা, অভিব্যক্তি, শরীরী ভাষা— সবেতেই যে সততা ফুটে ওঠে, তাতে সোনাদার দর্শকের মনে জায়গা করে নিতে অসুবিধা হয় না। এই ছবির চিত্রগ্রহণ এবং সম্পাদনার গুণে অনেক জায়গাতেই সোনাদার চরিত্রটাকে একটু ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে (ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি যত বড় হয়, এই ধরনের গল্প বলার কায়দার প্রয়োজন তত বাড়ে, সেটাই স্বাভাবিক)। তবে আবীরের অভিনয় এতটাই জোরালো যে এই অস্ত্রগুলোর আলাদা করে প্রয়োজন পড়ে না।
সোনাদার অভিযান এখন আবিরলাল-ঝিনুক ছাড়া অসম্পূর্ণ। অর্জুন চক্রবর্তীর আবির এবং ইশা সাহার ঝিনুককে দর্শক সোনাদার মতোই ভালবাসেন। তাঁরা এর আগের ছবিগুলোর মতোই এ ছবিতেও একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন— দর্শককে হাসানোর। গল্পে তাদের রসায়ন বেশ ‘পিজি থারটিন’ বলা যেতে পারে। সপরিবারে দর্শক হলে আসবেন ভেবেই নিশ্চয়ই চিত্রনাট্যে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে আইন পাশ করা আবিরলালের চরিত্র বোধহয় আর একটু পরিণত করে তোলার সময় হয়েছে এ বার। অন্যান্য চরিত্রে এ ছবিতে রয়েছেন বরুণ চন্দ, কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত ও আরও অনেকে। ছোট ছোট চরিত্রে তাঁরা যথাযথ অভিনয় করেছেন। তবে গল্পের খলনায়কদের কথা না বললেই নয়। সৌরভ দাসকেই ছবির মূল খলনায়ক বলা যায়। তাঁকে নিষ্ঠুর স্থানীয় মাফিয়ার চরিত্রে মন্দ লাগছিল না। কিন্তু যে-ই গল্পে দ্বিতীয় খলনায়কের আবির্ভাব হল, তখনই চরিত্রটা নিষ্ঠুরতার খোলস ছেড়ে মজাদার হয়ে উঠল। এই হঠাৎ বদলটা ঠিক বোঝা গেল না। এ বার আসা যাক দ্বিতীয় খলচরিত্রে— রজতাভ দত্ত। সোনাদার দর্শক তাঁকে আগেও দেখেছেন। রজতাভ ফ্রেমে থাকলে দর্শকের নজর নিজের দিকে ঠিক টেনে নেবেন। ছবির সবচেয়ে মজাদার সংলাপগুলো তাঁর জন্যেই রাখা ছিল। ছবিতে ইতিহাস নিয়ে এত বেশি তথ্য ছড়িয়ে রয়েছে যে, খানিক বিরতি দেয় এই মজার দৃশ্যগুলোই।
সোনাদা আমাদের বাংলার নিজস্ব ফ্র্যাঞ্জাইজ়ি। ইন্ডিয়ানা জোনস বা ড্যান ব্রাউনের রবার্ট ল্যাংডন থেকে তাকে ধার নিতে হয় না। প্রয়োজন পড়ে না অ্যাভেঞ্জার্স বা ‘ব্রহ্মাস্ত্র’-এর মতো বিশাল বাজেটেরও। বঙ্গের ইতিহাস এবং বাঙালিয়ানার হাত ধরেই সে স্বতন্ত্র। এবং সেই স্বতন্ত্রতার জন্যেই বিপুল জনপ্রিয়। তাই আশ্চর্য নয় যে এ ছবি এ বার পুজোয় সবচেয়ে বেশি অ্যাডভান্স বুকিং পেয়েছে বলে প্রযোজকদের দাবি। তিনটে ছবির পর ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি কি আর এগোবে? ছবির সাফল্য এবং নির্মাতাদের ইচ্ছার উপর তা নির্ভর করবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy