কেমন হল ‘বৌদি ক্যান্টিন’?
রান্নায় মশলাপাতি যতই ভাল পড়ুক, নুন দেওয়ার সময়ে যদি অসতর্ক হয়ে পড়েন, তা হলেও সব পরিশ্রম পণ্ড। তাই সুস্বাদু একটা পদ বানাতে গেলে চাই ধৈর্য এবং যত্ন। দুইয়ের কোনওটিরই অভাব রাখেননি পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়। তাঁর পরিচালিত এবং অভিনীত ‘বৌদি ক্যান্টিন’ দেখলে সেটা স্পষ্ট হয়ে যায়।
হেঁশেলের রাজনীতির জটিলতা বোঝা সহজ নয়। যুগ যুগ ধরে মেয়েদের দমিয়ে রাখার অন্যতম উপায় ছিল হেঁশেল। বহু মেয়ে হয়তো সারা জীবন রান্নাঘরেই কাটিয়ে দিয়েছেন। সেখান থেকে মেয়েদের বেরোনোর লড়াই ছিল অনেকটা লম্বা। সেই যাত্রাটাও ছিল নির্মম কঠিন। তাই যাঁদের সেই লড়াইটা করতে হয়েছিল, তাঁদের পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন হয়ে যায় যে বাইরের জগৎ ছেড়ে ফের কিছু মেয়ে আবার সেই হেঁশেলেই ঢুকতে চাইছেন। যাঁরা চাইছেন, তাঁরা অবশ্য বলবেন, তাঁরা হেঁশেলে ঢুকছেন না। বরং বাইরের জগৎটাকেই তাঁরা হেঁশেলে নিয়ে আসছেন। ‘বৌদি ক্যান্টিন’-এর গল্প অনেকটা তা-ই। কিন্তু এর বাইরেও অনেক কিছু।
সৌরীশ (পরমব্রত) এবং পৌলমী (শুভশ্রী) নিজের নিজের কাজের জগৎ নিয়ে অসন্তুষ্ট। সৌরীশ একটি পত্রিকায় মেয়েদের জন্য প্রতিবেদন লেখে। পৌলমী পড়ায় স্কুলে। এক জন চায় লেখক হতে, অন্য জন চায় মন দিয়ে জমিয়ে রান্না করতে। কিন্তু পরিবারের প্রত্যাশা পূরণ করতে গিয়ে কারওরই সে সব করা হয় না। এমনিতে তারা সুখেই সংসার করে। সৌরীশের মেয়েদের জন্য নানা রকম লিখতেও মন্দ লাগে না। পৌলমীও খুশি মনে সংসারের খেয়াল রাখে, স্কুলের পর নানা রকম রান্না করে, শ্বশুর-শাশুড়ি-দেওরকে আগলে রাখার চেষ্টা করে। শাশুড়ির আপত্তি সত্ত্বেও তার মন পড়ে থাকে হেঁশেলেই। তাই হঠাৎ একটা খাবার সরবরাহ দলের সঙ্গে যৌথ ভাবে ব্যবসা করার যখন সুযোগ আসে, সে লুফে নেয়। ব্যবসা রমরমিয়ে চললেও, তার জীবনটা এলোমেলো হয়ে যায়।
চিত্রনাট্যে অবশ্য এই একটি দিকের বাইরেও রয়েছে আরও নানা দিক। বাঙালির ব্যবসা নিয়ে অনীহা, আর্থ-সামাজিক বৈষম্য, লিঙ্গ নিয়ে গতে বাঁধা কিছু ধারণা, প্রান্তিক আচার-বিচার নিয়ে শহুরে ছুৎমার্গ, প্রেম, ঈর্ষা, মেল-ইগো, শাশুড়ি-বৌমার দ্বন্দ্ব, নারী ক্ষমতায়ন, পুরুষতান্ত্রিকতার বিভিন্ন আঙ্গিক, এমনকি স্টার্ট আপ থেকে চিট ফান্ড— বাদ নেই কিছু-ই। সাধারণত একটা দু’ঘণ্টার ছবির মধ্যে এত কিছু ঢোকাতে গেলে সবটা ছড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। কিন্তু নির্মাতারা তা হতে দেননি। বরং অত্যন্ত যত্ন নিয়ে সব খুঁটিনাটি সাজিয়ে-গুছিয়ে পরিবেশন করেছেন। ছবির সম্পাদনা এমন সুন্দর ভাবে এক সুতোয় বাঁধা যে, কোথাও কোনও দৃশ্য এক ফোঁটা বাড়তি মনে হবে না।
কঠিন কথা সহজ করে বলা মোটেই সহজ কাজ নয়। হেঁশেলের রাজনীতিরও সরলীকরণ করা যায় না। সেই রাজনীতি কতটা নৃশংস হতে পারে, তা সম্প্রতি আমরা পর্দায় দেখেছিলাম মালয়ালি ছবি ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান কিচেন’-এ। সেই গল্প ছিল নারী-অবদমনের। তবে ‘বৌদি ক্যান্টিন’-এর হেঁশেলের রাজনীতি নারী ক্ষমতায়নের। পুরুষতন্ত্র যে অস্ত্রগুলির সাহায্যে যুগ যুগ ধরে নির্যাতন চালিয়ে গিয়েছে, সেই অস্ত্রগুলিকে ভর করেই যদি ঘুরে দাঁড়ানো যায়, তা হলে কি সেটাই আসল নারী ক্ষমতায়ন? ভাবতে বাধ্য করবে এই ছবি।
সহজ ছবি হলেও তার গল্পে এমন অনেক জটিলতা লুকিয়ে রয়েছে। চিত্রনাট্যের আরও এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক আধুনিকতা বনাম প্রান্তিকতা। বিশ্বকর্মা পুজো করলে কেন মনসা পুজো করা যাবে না, সেই তর্ক নিয়ে হয়তো এত দিন সাধারণ মানুষ সে ভাবে মাথা ঘামায়নি। কিন্তু যে সময়ে দেশের এক অংশের সংস্কৃতি-ভাষা-আচার-বিচার সুপরিকল্পিত ভাবে বাকি দেশের উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে এবং আঞ্চলিকতা ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে, সে সময়ে বোধ হয় প্রান্তিকতা আঁকড়ে রাখার দায় খানিকটা হলেও বেড়ে যায়। গল্পকার (অরিত্র সেন) খুব সাবলীল ভাবেই এই সব দিকগুলি গল্পে জুড়ে দিয়েছেন। কিন্তু কখনও ছবির বিষয় অত্যধিক ভারী লাগেনি। বরং পাঁচ জন সাধারাণ মানুষের জীবনেরই প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠতে পেরেছে।
হয় অতিনাটকীয়, নয় অতিরিক্ত চতুর সংলাপেই যেন অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছিলেন বাংলার দর্শক। সেখানে এই ছবিতে সম্রাজ্ঞী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংলাপ যেন টাটকা হাওয়ার মতো। ছবিটা খুব সহজেই লিঙ্গবৈষম্য বা ‘জেন্ডার রোল’ নিয়ে ঠিক-ভুলের পাঠ হয়ে উঠতে পারত। সেটা যে হয়নি, তার অন্যতম কারণই হল ছবির সংলাপ। চড়া দাগের সংলাপ ছাড়াও যে ছবির বার্তা সহজেই দর্শকের মনে পৌঁছনো যায়, তার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ এই ছবি।
মেয়েলি-পুরুষালি ধারণার গণ্ডি সযত্নে মুছে দেওয়া হয়েছে এই ছবিতে। এই ছবির নায়ক সহজেই কাঁদতে কাঁদতে ক্ষমা চাইতে পারে। ছবির নায়িকা বাড়ির কর্তাদের মতো রোজ সকালে বাজার করে যায়, অনায়াসে প্রেম নিবেদন করে, এমনকি, প্রয়োজনে বাড়ির অর্থনৈতিক হালও নিজের হাতে তুলে নিতে পারে। পরব্রত এবং শুভশ্রীর রসায়নে বোধ হয় এই কঠিন কাজগুলিই আরও সহজ হয়ে গিয়েছে।
অভিনেতা পরমব্রতকে নিয়ে এখন আর আলাদা করে কিছু বলার প্রয়োজন পড়ে না। তাঁর অভিনয় দক্ষতার কদর এখন দেশজুড়ে। বাবলুদার চরিত্রে (পৌলমীর ব্যবসারা পার্টনার) সোহম আলাদা করে নজর কাড়েন। অনসূয়া মজুমদারের চরিত্র (পৌলমীর শাশুড়ি) যতটা মার্জিত, তেমনই মার্জিত এবং নিয়ন্ত্রিত তাঁর অভিনয়। তবে এই গল্প বোনানোই হয়েছে যেন শুভশ্রীর অভিনয় দেখার জন্য। কথায় আছে, পুরনো চাল ভাতে বাড়ে। ঠিক তেমনই ছবি যত এগোবে, পরিস্থিতি যত জটিল হবে, শুভশ্রীর অভিনয় যেন আরও খুলবে!
ছবির গানগুলি বুদ্ধি করে বানানো। রান্নায় নানা ধরনের মশলা লাগে। এ ছবিতে গানও সেই প্রয়োজন মতো দেওয়া হয়েছে। অপ্রয়োজনীয় কিছুই কি নেই? অনেকে বলবেন, এখন পর্দাটা (স্ক্রিন) উত্তর-আধুনিক একটা স্পেস। যেখানে সিনেমা, টেলিভিশন, বিজ্ঞাপন, ওয়েব সিরিজ, ইউটিউব ভিডিয়ো, ইনস্টা রিল সবই মিলেমিশে এক হয়ে যায়। তাই ছবির মাঝে খানিক বিজ্ঞাপন নিয়ে কারও তেমন ছুৎমার্গ নেই। কিন্তু রক্ষণশীল দর্শকের হয়তো কিছু বিজ্ঞাপনী শট অতিরিক্ত লাগবে। এবং তাঁরা অপেক্ষায় থাকবেন যে কবে বাংলা ছবির বাজেট এতটা বেশি হবে যে, এ সব অপ্রয়োজনীয় বিজ্ঞাপনের ভার নির্মাতাদের উপর পড়বে না!
গত পুজোয় পরমব্রত দর্শককে উপহার দিয়েছিলেন একটা টানটান থ্রিলার (বনি)। এ বছর তিনি দিলেন একটি মিষ্টি ছবি। তাঁর কথা ধার করেই বলা যায়, এ ছবির মিষ্টি স্বাদ দর্শকের মনে হল থেকে বেরোনোর পরও লেগে থাকবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy