অবিরত মারামারি-কাটাকাটির অবিমিশ্র দৃশ্য ছবি জুড়ে। ছবি: সংগৃহীত।
অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তবে এমন কোটি কোটি টাকার ছবি তৈরি হয় বটে। সারা দেশে ২০২১ সালে ঝড় তুলে ‘পুষ্পা: দ্য রাইজ়’, অর্থাৎ এই ফ্র্যাঞ্চাইজ়ির প্রথম ছবিমুক্তির কিছু দিন পরেই ঘোষিত হয়েছিল এই ছবির কথা। তার পর অবশ্য গঙ্গা... থুড়ি নর্মদা (দাক্ষিণাত্যের প্রধান নদী বলতে চাইছি, যে নদী পার করতে ঐতিহাসিক ভাবে উত্তরের বেশির ভাগ সাম্রাজ্যের ঘুম উড়ে গিয়েছিল) দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। যার ফলস্বরূপ বছর তিনেক পরে ‘পুষ্পা২: দ্য রুল’ ছবি মুক্তি পেল ২০২৪-এ এসে। ‘পুষ্পা: দ্য রাইজ়’-এর ক্ষেত্রে দেশের সব রাজ্যে জনপ্রিয়তা, বক্স অফিস সাফল্য এবং সর্বোপরি বাণিজ্যবসত দেখে পরিচালক সুকুমার প্রথম ছবির সঙ্গে তোলা দ্বিতীয় ছবির প্রথমাংশের অনেকটাই বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। নায়ক অল্লুর শরীর খারাপের জন্য বেশ কয়েক দিন ছবির শুটিং বন্ধ রাখতে হয়েছে, বিদেশের সমুদ্রবন্দর আগাগোড়া গড়ে তুলতে হয়েছে হায়দরাবাদের অদূরে রামোজি রাও ফিল্ম স্টুডিয়োয়। যাই হোক, অনেক বাধা পেরিয়ে অবশেষে তৈরি হয়েছে দীর্ঘ ৪ ঘণ্টা নয় মিনিটের ছবি ‘পুষ্পা: দ্য রুল’। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে ইচ্ছে করে, ‘অগত্যা, অবশেষে!’
গঙ্গা এবং নর্মদার মধ্যে ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বের কথা উল্লেখ করেছি একটু আগে। এই রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব কিন্তু ছবির একটি বড় অংশ জুড়েও রয়েছে। এই ছবিতে রাজনীতি বলে যদি কিছু থাকে, তা হলে সেটি হচ্ছে উত্তর ভারত এবং দক্ষিণ ভারতের দ্বন্দ্ব। পুলিশ আধিকারিক ভাঁওর সিংহ শেখাওয়াত (ফাহাদ) একজন রাজস্থানি এবং এই ছবির অন্যতম প্রধান খলনায়ক। মোদ্দা কথা, এই ছবিতে প্রায় যত জন পুরুষ চরিত্র রয়েছে, পুষ্পারাজ ছাড়া, তারা হয় সকলেই পুষ্পার সহচর, নয় খলনায়ক। মাঝামাঝি, ছাইরঙা কোনও পুরুষ চরিত্রের স্থান এই ছবিতে নেই। অবশ্য থাকার কথাও নয়।
‘পুষ্পা২: দ্য রুল’ ছবিতে নানা ধরনের মূল্যবোধের শিক্ষণীয় কিছু সংলাপ (সংলাপ: শ্রীকান্ত বিষ্য) প্রোথিত হয়েছে, অবশ্য সবটাই খুব মেপে। এটি এমন একটি ছবি যেখানে, কন্যার বিবাহে বরপক্ষকে পণ দেওয়ার বিষয়টি যে খারাপ সে বিষয়ে একটি সংলাপ রয়েছে, তেমনই রোজগারের সঙ্গে সামঞ্জস্য না রেখে সন্তানকে ‘ডোনেশন’ দিয়ে স্কুলে ভর্তি করানোর বিষয়েও একটি সংলাপ রয়েছে। অবশ্য যে বিষয়টি নিয়ে কোনও মাপজোক করা হয়নি সেটি হলো নারীর অসম্মান। এই বিষয়টি নিয়ে একটি তুমুল মারামারির দৃশ্য দিয়েই ছবিটির মোটামুটি এই পর্যায়ের মতো ইতি টানা হয়েছে। এই দিকটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণ ভারতে এটি সামাজিক মূল্যবোধের একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় মাপকাঠি। যা সত্যি বলতে, উত্তর ভারতে ক্রমশ হ্রাসমাণ। সে দিক থেকে এটিকেও এই ছবির এক রকম সামাজিক-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব বলা যায়।
আরও একটি বিষয় যা এই ছবিতে দেখার মতো তা হল ‘সিনেমাটোগ্রাফি’ এবং ‘ফাইট কোরিয়োগ্রাফি’। মারামারির প্রত্যেকটি মুহূর্ত মসৃণ ভাবে বানানো এবং মাপা। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে তোলা হয়েছে দৃশ্যগুলি। তা ছাড়াও অনেকগুলি দৃশ্যই পাহাড়-জঙ্গল-বৃষ্টির আবহে রাত্রে তোলা। তার মধ্যে কিছু দৃশ্য আবার ড্রোন ক্যামেরায় শুট করা, কিন্তু পরিষ্কার এবং ঝকঝকে। ‘সিনেমাটোগ্রাফি’ আগেরটির মতোই মিরস্লাভ কুবা ব্রোজেকের। ‘ফাইট কোরিয়োগ্রাফি’ করিয়েছেন চার জন। তার মধ্যে দু’জন বিদেশি, পিটার হিন এবং কেচন কামফকডি। দু’জন ভারতীয়। ড্র্যাগন প্রকাশ আর নবকান্ত। যেটুকু নম্বর এই ছবিকে দেওয়া গেল তা মূলত এঁদের কাজের মূল্যায়ন। কারণ বাকি পুরো ছবিটিই হচ্ছে একটি অবিরত হয়ে চলা মারামারি-কাটাকাটির অবিমিশ্র দৃশ্য। যেন এক মহাযুদ্ধ চলছে। একটির পর একটি দ্বন্দ্বের সূত্র তৈরি করা হচ্ছে এবং পুষ্পা গিয়ে সকলকে মেরেধরে তা সমাধান করে দিচ্ছে।
মোদ্দা কথা অল্লু অর্জুনকে এই ছবিতে এক অতিমানবিক চরিত্রে গড়ে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়েছে। এমন একটি ছবি যেখানে রশ্মিকা মন্দানার মতো সুন্দরী নায়িকারও বলার মতো কিছুই করার নেই। ছবিতে আবার লিঙ্গসমতাকে উল্টে দেওয়ারও চেষ্টা আছে। পুষ্পা এক পরিপূর্ণ পুরুষ, যে পত্নীব্রতী, মাতৃভক্ত, শক্তিশালী এবং নারী সম্মানের প্রধান দ্বাররক্ষী এবং এমন একজন অতিপুরুষকে গড়ে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা— যে নিজের কাঁধে আগুন জ্বললে সেটিকে জ্বলতে দিয়ে প্রথমে সিগারেট ধরায় এবং পরে এক চাপড়ে তা নিভিয়েও দিতে পারে, যা প্রায় হাস্যকর। সেই পুরুষটি আবার প্রয়োজনে কব্জিতে সোনার বালা পরে শাড়ি পরতেও দ্বিধা করে না। এমনকি সে শাড়ি পরে হাত-পা বাঁধা অবস্থাতেও অবলীলায় দুর্দান্ত মারামারি করতে পারে স্রেফ দাঁত, নিঃশ্বাস এবং আস্ফালন দিয়ে।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত ‘পুষ্পা২: দ্য রুল’ ছবিটি দক্ষিণ ভারতের এক বিরাট সামাজিক সমস্যার কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হয়। যে পুষ্পার কোনও কুলপরিচয় ছিল না, সেই পুষ্পা শেষ পর্যন্ত স্বকুলে মান্যতা পায়। অর্থাৎ, এত বিপ্লব সত্ত্বেও দক্ষিণী সমাজের একটি স্তম্ভকে শেষ পর্যন্ত বিন্দুমাত্র নাড়াতেও সফল হয় না পুষ্পা। অতএব শেষ পর্যন্ত দর্শকমনের গভীর বিশ্বাসটিকে ঠিকঠাক রেখে বক্স অফিসের হিসেবটির সমতা রাখে। মানে শেষ পর্যন্ত ‘হাতে রইল পেনসিল’।
‘পুষ্পা২: দ্য রুল’ সাকুল্যে ৪ ঘণ্টা নয় মিনিটের ছবি। এই মহাব্যস্ত জীবনে এতটা সময় ধরে ছবি দেখার বিলাসিতা কত জনের করার সময় আছে, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকবে। এক, যদি আপনি অল্লু অর্জুনের বিরাট অনুরাগী না হন!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy