Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

জীবন্ত হয়ে উঠল একটা অধরা ইতিহাস

সৌমিকের চিত্রনাট্যে একটা বাঁধুনি রয়েছে। আকাশবাণীর সরকার দরদী দোর্দণ্ডপ্রতাপ শশী সিংহ (প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়) ইমার্জেন্সির বাহানায় কিশোরকুমারকে পর্যন্ত টেলিফোনে এই বলে হুমকি দিচ্ছেন যে, সরকারি অনুরোধে বিনা পারিশ্রমিকে রেডিয়োয় না গাইলে কিশোরকে ‘নিশ্চিহ্ন’ করে দেবেন!

অন্তরা মজুমদার
শেষ আপডেট: ০২ মার্চ ২০১৯ ০০:২৬
Share: Save:

শরৎকাল, পেঁজা তুলোমেঘ, কাশফুল আর... মহিষাসুরমর্দিনী। পুজো শুরু, এই বোধটা বাঙালির রন্ধ্রে চিরকাল অনুভূত হয়েছে মহালয়ার মহালগ্নেই। সুপ্রীতি ঘোষের গলায় ‘বাজলো তোমার আলোর বেণু’ আর বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে চিরকালীন স্তোত্রপাঠের আবহেই ভোর চারটেয় ঘুম ভেঙে বাঙালি বসে পড়েছে রেডিয়োর সামনে... এই ট্র্যাডিশনের ব্যতিক্রম নেই আজও।

কিন্তু একেবারেই কি নেই? ১৯৭৬-এ, জরুরি অবস্থায় দিল্লির আকাশবাণী চেয়েছিল বদলে দিতে ঐতিহ্য। রেডিয়োর কোনও কর্মকর্তার অঙ্গুলিহেলনেই এমন সিদ্ধান্ত। বাঙালির সেন্টিমেন্টের গুরুত্ব আঁচ না করেই তাকে গ্ল্যামারের আঁচে ধাঁধিয়ে দিতে চেয়েছিল বেতার। ধোপে টেকেনি সেই চেষ্টা। ‘মহালয়া’ মুক্তি পাওয়ার বহু আগেই সে ঘটনা সম্পর্কে অনেকে ওয়াকিবহাল। তা সত্ত্বেও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র-পঙ্কজকুমার মল্লিকের মহিষাসুরমর্দিনীকে বদলে দিয়ে কী ভাবে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়-উত্তমকুমারের দেবীং দুর্গতিহারিণীম্‌-এর মাধ্যমে বাঙালির নস্টালজিয়াকে সজোরে নাড়া দিয়েছিল আকাশবাণী, সে গল্প দু’ঘণ্টায় পর্দায় দেখতে মন্দ লাগে না!

সৌমিকের চিত্রনাট্যে একটা বাঁধুনি রয়েছে। আকাশবাণীর সরকার দরদী দোর্দণ্ডপ্রতাপ শশী সিংহ (প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়) ইমার্জেন্সির বাহানায় কিশোরকুমারকে পর্যন্ত টেলিফোনে এই বলে হুমকি দিচ্ছেন যে, সরকারি অনুরোধে বিনা পারিশ্রমিকে রেডিয়োয় না গাইলে কিশোরকে ‘নিশ্চিহ্ন’ করে দেবেন! বেতারে কিশোরের গানের সম্প্রচারও হেলায় বন্ধ করে দেন তিনি। কার্যসিদ্ধির জন্য হেমন্তের (সপ্তর্ষি রায়) সাহায্য নেন উত্তমকে (যিশু সেনগুপ্ত) রাজি করাতে। যে হেমন্তের পঙ্কজকুমারের রেকর্ডিংয়েও থাকার কথা ছিল। কিন্তু মুম্বইয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকায় পঙ্কজ তাঁর ছাত্রসমকেও রেয়াত করেননি। সেই জায়গা থেকে নতুন কাজের বরাত পেয়ে হেমন্ত দুর্গতিহারিণীম্‌কে যে উচ্চতায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, সেখানে একমাত্র মানুষের জেদ আর অহংই পৌঁছতে পারে! কাহিনিতে এই আন্ডারকারেন্ট অন্য মাত্রা দিয়েছে ছবিকে। লার্জার দ্যান লাইফ চরিত্রগুলোকে মানবিক দোষগুণের আওতায় রেখে।

মহালয়া
পরিচালনা: সৌমিক সেন
অভিনয়: শুভাশিস, প্রসেনজিৎ, যিশু, শুভময়, সপ্তর্ষি
৭/১০

ইমার্জেন্সির আবহে ছবির তার বাঁধা। সুতরাং রাজনীতি একটু হলেও গুরুত্ব পেয়েছে ‘মহালয়া’র কথনে। ‘অদৃশ্য’ কোনও উপরওয়ালার দাবিতেই শশী আপাত ভাবে পাল্টাতে চান বাঙালির দীর্ঘতম বেতার অনুষ্ঠান মহিষাসুরমর্দিনীকে। তৎকালীন রাজনীতির সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে স্বৈরাচারী গন্ধ পাওয়া যায় তাঁর কার্যকলাপে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ (শুভাশিস মুখোপাধ্যায়) ‘অব্রাহ্মণ’ হওয়ায় তাঁর চণ্ডীপাঠে দেবীর অমর্যাদা হয়, এই মর্মে আপত্তি তোলে হিন্দু সমাজ। পঙ্কজকুমার মল্লিক (শুভময় চট্টোপাধ্যায়) বীরেন্দ্রর হয়ে তর্কে নামেন। সংলাপের ঘোরপ্যাঁচে জানিয়ে দেন, রবীন্দ্রনাথও যাঁর দিকে আঙুল তুলে কখনও কথা বলেননি, তাঁকে দমিয়ে দেওয়া সহজ কথা নয়। সিকোয়েন্সটা সমকালীন প্রেক্ষিতে দারুণ!

ছবিটিকে অযথা মিউজ়িক্যাল বানিয়ে ভার বাড়ানো হয়নি। দেবজ্যোতি মিশ্র আবহেই মিশিয়ে দিয়েছেন মহালয়ার মায়াবী সুর। তবে ছবির সেরা প্রাপ্য দাপুটে অভিনয়! যিশু বা শুভাশিস কেউই বাস্তব চরিত্রগুলোর ‘মতো’ হওয়ার চেষ্টা করেননি। কিন্তু নিজেদের পারফরম্যান্সকে এমন যথার্থ মাপ দিয়েছেন যে, ভেবে নিতে অসুবিধে হয় না আসল মানুষগুলোরও এমনই ছিল দুঃখ-সুখ! নেগেটিভ চরিত্রে প্রসেনজিৎও অভিনব ছাপ রাখলেন। এঁদের ত্র্যহস্পর্শেই যেন অসময়ের ‘মহালয়া’য় জীবন্ত হয়ে উঠল একটা অধরা ইতিহাস।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE