ছবির একটি দৃশ্য।
পরিচালনা: প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য
অভিনয়: ঋত্বিক চক্রবর্তী, অপরাজিতা ঘোষ দাস, জ্যোতিকা জ্যোতি প্রমুখ
‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের প্রথম পর্বে অনুপ্রাণিত পরিচালক প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য ‘রাজলক্ষ্ণী ও শ্রীকান্ত’-তে ধরতে চান নিজের উপলব্ধি, নিজের সময়ও। তাই ফিল্মটিকে উপন্যাসের সঙ্গে মেলাতে চাওয়ার চেষ্টা বৃথা। ফিল্ম হিসেবেই ফিল্মটিকে দেখতে হবে।
ফিল্মটি এক অনন্য ভঙ্গিতে চরিত্রগুলি নিয়ে উপস্থিত হয়। সে ভঙ্গি নয় একরৈখিক। অতীতের পেটে ঢুকে পড়ে বর্তমান, বর্তমানের পেটে অতীত এবং বর্তমানের ভেতর বর্তমানও। কখনও কখনও ম্যাজিক রিয়ালিজমকেও ছুঁয়ে যায়। ওই জীবন কি সত্যি ছিল? নাকি এই জীবন? ফিল্মের শেষে ভাববেন দর্শক। প্রদীপ্ত এক জন দক্ষ সম্পাদকও। গল্প বলার ভঙ্গিতে সম্পাদনার যে টেকনিক তিনি ব্যবহার করেন তা ফিল্মটিকে দেয় অন্য মাত্রা। তাঁর আগের ফিল্মগুলো (‘বিশ্বাস নাও করতে পারেন’, ‘বাকিটা ব্যক্তিগত’, ‘পিঙ্কি, আই লাভ ইউ’ প্রভৃতি) মনে রেখে বলা যায়, তিনি তৈরি করে নিয়েছেন নিজস্ব ভাষা। তা প্রচলিত ফিল্মের ভাষা নয়।
বালক শ্রীকান্ত (সোহম মৈত্র) পালিয়ে যেতে চায় জীবনের সমস্ত দুরূহ সঙ্কট থেকে। সমুদ্র তীর ধরে ছুটে চলে। তখন যেন সে ‘ফোর হান্ড্রেড ব্লোজ’-এর সেই বালক যে বালকও পালাতে চায় জীবন থেকে। দীর্ঘ একটি মাত্র শটের শেষে বালকের মুখে সেই বিখ্যাত ফ্রিজ ফ্রেম। ছোট শ্রীকান্ত ফ্রিজ ফ্রেমে আটকে থাকে না। সমুদ্র তীরে দৌড়নোর দৃশ্যে হ্যান্ড হেল্ড ক্যামেরার শেকিং, সম্পাদনায় ‘কাট টু’ টেকনিক ব্যবহার ইঙ্গিত করে, সে যেন ছুটে চলে আর এক নতুন জীবনের দিকে যে জীবন তার জন্য সাজিয়ে রাখবে না বেহেস্তের উপাচার। কখনও কখনও সমস্ত ব্যাকরণ ভেঙে ক্যামেরা টপকে যায় ‘ইমাজিনারি লাইন’। সঙ্গে দর্শকও যেন টপকায় নিষিদ্ধ গণ্ডি।
আরও পড়ুন:রিয়্যালিটি শোয়ে এ কী করলেন করিনা-প্রিয়াঙ্কা! দেখুন ভিডিয়ো
বড় শ্রীকান্ত ঋত্বিক চক্রবর্তীর স্বল্প সংলাপ, হাঁটাচলা, প্রেম-ক্রোধ-হতাশার ভিন্ন ভিন্ন ভঙ্গিতে শৈল্পিক মোচড়। ক্লাইম্যাক্সে হ্যান্ড হেল্ড ক্যামেরায় তাঁর ডিসটর্টেড মুখের ক্লোজ। ভেঙেচুরে যাওয়া রেখা, খড়ি ওঠা ঠোঁট, সংলাপহীন শব্দের প্রায় অব্যক্ত ও অনুচ্চ ভঙ্গি— হতাশা প্রকাশের এমন কারিগরি মন কাড়ে। হুকুমচাঁদের চরিত্রে রাহুল দক্ষতায় ধরে রাখেন তাঁর শরীরী ভাষা, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। জ্যোতিকা জ্যোতি ঋত্বিকের মতো অভিনেতার পাশে যোগ্য সঙ্গত করেন। হুকুমচাঁদ ও শ্রীকান্তর মাঝখানে পড়ে তাঁর মুখে মুডের চেঞ্জ খেলা করে, খুশি ও বিষণ্ণতার। বড় ভাল লাগে। তবু উল্লেখ করতেই হয়, সংলাপে ‘ছ’ ধ্বনির উচ্চারণ, কখনও শব্দ উচ্চারণের টানের ভেতর বাংলাদেশি সত্তা উঁকি দেয়।
গল্পের রাজলক্ষ্ণী বাংলাদেশ থেকে আসা বলে এটুকু মানিয়ে যায়। ছোট রাজলক্ষ্ণী ও শ্রীকান্ত (গার্গী মাজি, সোহম মৈত্র) দারুণ। তাদের এক একটা দৃশ্য ধরে ধরে বলতে ইচ্ছে করে। সায়ন ঘোষ (ইন্দ্রনাথ) নজর কেড়েছেন। তবে কোনও কোনও জায়গায় অতিরিক্ত সংলাপ (স্ক্রিপ্টে না থাকা) বলেছেন বোধ হল। অন্নদাদিদি অপরাজিতা (ঘোষ দাস) নিজেকে ভেঙেছেন, সংলাপ বলার ভঙ্গি থেকে শরীরী বিভঙ্গে। চরিত্রটি পরিচালক নির্মিত হলেও অভিনেতার দায়িত্বটুকু তাঁর নিজের। যদিও সংলাপের ক্ষেত্রে একই স্থানে একাধিক আঞ্চলিক ভাষা শোনা গিয়েছে। অন্নদাদিদি যে ডায়লেক্টে কথা বলে, তারই উঠোনে জমে যাওয়া ভিড় থেকে শোনা যায় ভিন্ন ডায়লেক্ট, মুর্শিদাবাদের। এটা হতে পারে অন্নদাদিদি যদি অন্য অঞ্চলের মেয়ে হন। গল্পে এ সূত্র অনুপস্থিত। কিছু বিষয় চোখে পড়ে। যেমন, শ্রীকান্ত সহকর্মীর সঙ্গে কথা বলছে, হুকুমচাঁদের ডেরায় যাওয়ার আগে। পিছনে এক চরিত্র অহেতুক দাঁড়িয়ে থাকে, তাও পিছন ফিরে। মূল চরিত্রদের সঙ্গে দূরত্ব এত কম, বিসদৃশ লাগে।
‘রাজলক্ষ্ণী ও শ্রীকান্ত’ ছবির একটি দৃশ্য
প্রধান চরিত্রদের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকানোর মনস্তত্ত্ব থেকে বেরিয়ে এসেছেন পরিচালক। তাঁর রাজলক্ষ্ণী তন্বী, পাতলি কোমরের অধিকারী নন। সুচিত্রা সেনের মতো মায়াময় চোখে বিদ্ধও করেন না। এক মেয়ের ছিন্নমূল জীবনে তুলতুলে সৌন্দর্য বোধহয় অনভিপ্রেত। ছোট রাজলক্ষ্ণীকে দিয়ে খুব ভারী চালের ব্যাগ বইয়ে নেওয়ার ভেতরেই বোধহয় সে ইঙ্গিত আছে। জ্যোতিকা জ্যোতি তাই সঠিক নির্বাচন। অন্য দিকে, অপরাজিতার সৌন্দর্য ভেঙে চুরমার করে তাঁকে এক মামুলি গৃহবধূর রূপেও পান দর্শক। দর্শককে পরিচালক যেন খানিক ধাক্কাই দিতে চান। সিনেমায় পরিচিত মুখ নন এমন অভিনেতারাই বিভিন্ন চরিত্রে। কোনও কোনও দৃশ্যে উচ্চকিত অভিনয় বাদ দিলে প্রত্যেকেই ভাল। খুবই স্বল্প সময়ের জন্য দেখা গেছে অমিত সাহাকে (পিয়ারীবাঈয়ের সহকারী)। এটুকুতেই তাঁর অন্যান্য ফিল্মের মতোই নিজেকে প্রমাণ করেছেন তিনি।
আরও পড়ুন:পার্টি কোথায়?
ডিওপি শুভদীপ দে আমাদের দেখার স্বাভাবিকতা বজায় রেখে চিত্রায়ন করেছেন। বেশির ভাগ সময় ব্যবহার করেছেন নরম্যাল লেন্স যাতে একটি চরিত্র তাঁর চারপাশের প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়েই স্পষ্ট ভাবে দর্শকের সামনে হাজির হন। কখনও কখনও ওয়াইড লেন্স পর্দা জুড়ে উদ্ভাসিত করে বাংলা প্রকৃতির রূপ। ঋত্বিক ঘটক যেমন চরিত্র নয়, প্রকৃতিকেই দেখছেন ‘আমার অঙ্গে অঙ্গে কে বাজায় বাঁশি...’ (‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’) গানের আবহে। ওয়াইড লেন্সে ধরা দৃশ্যে চরিত্র দৌড়ে মিশে যাচ্ছে প্রকৃতিতে। কিন্তু এই ফিল্মে সৌন্দর্য দেখার ওই রোম্যান্টিক ভঙ্গি ব্যবহার হয়নি। নাগরিক জীবনের খরখরে বেদনা যেন ধরা পড়েছে সৌন্দর্য দেখার মধ্যেও। কালার কারেকশন বা কালার গ্রেডের সুবিধা নিয়ে মূল সিনেমাটোগ্রাফিকে ব্যালান্স করার বা অহেতুক সৌন্দর্য বাড়ানোর চেষ্টাও করা হয়নি বোধ হল।
ছবির একটি দৃশ্যে রাহুল এবং জ্যোতিকা
খুব কম দৃশ্যে অন্য রকম লেন্স ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন, ছোট রাজলক্ষ্ণী ও শ্রীকান্ত আভূমি নত ডালপালায় বিশাল গাছের নীচে। তাদের ক্লোজ আপের ব্যাক গ্রাউন্ডে আউট অব ফোকাসে গাছের পাতা, পাতার ফাঁক দিয়ে বিচ্ছুরিত আলো। খুবই কম দৃশ্যে ড্রোন ক্যামেরা ব্যবহার করা হয়েছে। সৌন্দর্য দেখানো অভিপ্রায় না হলেও ড্রোন ক্যামেরায় ধরা হুকুমচাঁদের ডেরায় গাড়িতে শ্রীকান্তর আসার দৃশ্যটি এরিয়াল ভিউ-এ কয়েকটি মেঠো রাস্তা নিয়ে চমৎকার। তাঁবুতে শ্রীকান্ত ও রাজলক্ষ্ণীর সাক্ষাতের দৃশ্যে প্রায় একটিই লাইট সোর্স। শ্রীকান্তর মুখে এসে পড়ছে আলো, রাজলক্ষ্ণীর মুখে আলো কম। আলোর এই কমবেশি মাত্রা নিয়েই ক্লোজ শটে দেখা যায় দু’জনকে। অন্য দৃশ্যে টেবিলে বসা পিয়ারিবাঈয়ের গলায় কাঁপতে থাকে গ্লাসের তরল থেকে প্রতিফলিত এক চিলতে আলো। অন্নদাদিদির নিষিদ্ধ সম্পর্ক দেখে ফেলে ছোট শ্রীকান্ত। তার পয়েন্ট অব ভিউ-এ ক্যামেরা। অনবদ্য!
পার্থ বর্মণ শব্দ যোজনায় ও ধারণে অহেতুক গ্র্যাঞ্জার এড়িয়েছেন। তাঁর আগের কাজ খেয়াল করলেও এটা বোঝা যায়। দেখা ও না দেখা শব্দেরা ধরা দিচ্ছে। কখনও ঘুঘু, কখনও পেঁচার ডাক, কখনও বা জলের ছলাৎছল। সাত্যকি বন্দ্যোপাধ্যায় ফিল্মে প্রথম আবহসঙ্গীত করলেন। উড (দোতারার মতো, Udh, মধ্যপ্রাচ্যের বাদ্যযন্ত্র), বাঁশি, গিটার, ঢোল মিলিয়ে আবহ বেশ লেগেছে।
যে যার গানের মিউজিক কম্পোজ ও অ্যারেঞ্জমেন্ট করেছেন নিজেই। তিনটি নতুন গান ব্যবহার হয়েছে। একটা কীর্তনিয়া ফোক স্টাইলে, দুটো আধুনিক স্টাইলে। অনির্বাণ দাসের কথা, সুর, মিউজিকে গেয়েছেন তিমির বিশ্বাস। এমন গা শিরশির করে ওঠা ‘কৃপণ শেষ বসন্ত হাওয়া’, ‘তার হৃদয় ঘেঁষে বসি, তার শিরায় আউশ চষি’ (‘আমার এটুক শুধু চাওয়া’) এমন ভাবে বাংলা সিনেমার গানে কেউ বলেননি অনেক দিন। একটি মাত্র গিটার সঙ্গী করে গানটি অন্য অনুভূতির জগতে নিয়ে যায়। তন্ময় সরকারের কথা, সুর, মিউজিকে গেয়েছেন বাবলু সাইন। সেমি ক্লাসিকাল অনবদ্য দুটি গানের মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্ট এবং কণ্ঠ সোহিনী চক্রবর্তীর। এন্ড টাইটেলে দ্বিজেন্দ্রলালের ‘আমরা এমনি এসে ভেসে যাই...’ খালি গলায় গেয়েছেন সোহিনী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy