মধুবালা।
বেবি মুমতাজ় ছিল এগারো ভাইবোনের মধ্যে পঞ্চম। দিল্লিতে থাকত, বাবা আতাউল্লা খান ভদ্রস্থ চাকরিও করতেন। কিন্তু রগচটা স্বভাবের কারণে সে কাজটা চলে যায়। তার পরই সাত বছরের মুমতাজ়কে অল ইন্ডিয়া রেডিয়োয় গায়িকার চাকরিতে ঢুকিয়ে দেন তিনি। বম্বে টকিজ়ের ম্যানেজার রায়বাহাদুর চুনীলাল সেখানেই বাচ্চা মেয়েটার মিষ্টি বুলি শুনে আতাউল্লাকে বলেন, একে বম্বে নিয়ে এসো।
সে কথা শুনেই সপরিবার বম্বেতে এসে বিপদে পড়েছিলেন হঠকারী আতাউল্লা। ‘গোশালা’য় থাকতেন নাকি তাঁরা, শিশুসন্তান আর চিররুগ্ণ স্ত্রীকে আতাউল্লা এত মারতেন যে, তাদের গায়ের কালশিটের রং কখনওই ফিকে হত না। খুঁত হয়ে গেলে ফিল্মে নামতে মুশকিল হবে, তাই মারধর থেকে ছাড় পেত ছোট্ট মুমতাজ়!
চুনীলালের কথামতো বম্বে টকিজ়েই জুটে গেল প্রথম ফিল্ম। ১৯৪২-এর ‘বসন্ত’ নামের ছবিটি হিট, ন’ বছরের মুমতাজ়ও চোখে পড়ল। সিনেমাশেষে পুতুল-মেয়ে দর্শকের দিকে তাকিয়ে বলত, “কাল ফির আইয়েগা!” সেই জাদুচূর্ণ মাখানো আহ্বানে লোকে সত্যিই আবার সিনেমাটা দেখতে ফিরতেন! জানিয়েছেন পঞ্চাশের দশকের তারকা নিম্মি। আরও কয়েকটি ছবিতে শিশুশিল্পীর কাজ পেল সে। মাসে ১৫০ টাকার মতো পারিশ্রমিক। তাতে ভর দিয়েই আতাউল্লা পাঠানের বিরাটকায় সংসারের চাকা গড়াতে শুরু করল। অশোককুমার বলেছিলেন, “আশ্চর্য হয়ে যেতাম স্টুডিয়োর লাঞ্চটাইমে, ওইটুকু বাচ্চা অত খেতে পারে দেখে! মনে হত কত দিনের খিদে বেচারির পেটে জ্বলছে!” অবাক পরিচালক কেদার শর্মাও। “মেয়েটা বারো কি তেরো। তাকে প্যাডেড পোশাক পরিয়ে এনে বাবা বললেন, স্টার বানিয়ে দিন।”
এক বছর পরেই স্বপ্নপূরণ, মেয়েকে নায়িকার বেশে পর্দায় দেখা গেল। চোদ্দোয় নায়িকা সাজা শুরু, ত্রিশেই পর্দাজীবনে যবনিকা। জন্মেছিলেন ১৯৩৩-এর ১৪ ফেব্রুয়ারি, একেবারে ভ্যালেন্টাইনস ডে-তে। অকালে সেই মেয়ের আয়ু ফুরিয়ে গেল জন্মগত হার্টের অসুখে। আর তার ছয় দশক পেরিয়েও, অদ্যাবধি তিনি বেঁচে রইলেন কোটি কোটি ভারতবাসীর স্বপ্নে, ‘কুইন অব হার্টস’ হয়ে! এই অদ্ভুত সব সমাপতন, অলৌকিক রূপ মিলিয়েমিশিয়ে তিনি আজ মিথ, মায়াকুহক। ‘ভেনাস অব ইন্ডিয়ান স্ক্রিন’-এর আখ্যা পেয়েছেন। কেউ বলে, তাঁর দুধে-আলতা ত্বক নাকি এত পাতলা ছিল, ফলের রস খেলে তা গলা দিয়ে গড়িয়ে নামতে দেখা যেত। কত নায়ক-পরিচালক তাঁর মোহে অন্ধ হয়েছেন, সে সব লিস্টি দিয়ে তাঁকে ‘পুরুষঘাতিনী’ বলে দাগিয়ে দেওয়া চলছে আজও। কে জানে কতটা ঘটনা আর কতটা রচনা! তবে তাঁর হ্রস্ব জীবনের পাতায় পাতায় এমন বহুবিধ গল্পগাছার দেখা মেলে, যাদের সহস্র ডানায় ভর দিয়ে তাঁর জীবন প্রায় উপকথা হয়ে উঠেছে। কিন্তু কঠোর বাস্তব হল, কিংবদন্তির সে সব জৌলুসময় রত্ন মুমতাজ় জেহান বেগম দেহালভি ওরফে মধুবালার বন্ধুর জীবনের নুড়িপাথর বই কিছুই নয়।
রহস্যের সূত্রপাত
পরিচালক কেদার শর্মার ‘বেচারা ভগবান’ ফিল্ম-এর মহরতের দিনই তাঁর স্ত্রী তথা ছবির নায়িকা মারা যান। নামী শিল্পীরা মুখ ফেরালেন, অপয়া ছবি। তখন কেদার রঞ্জিত মুভিস্টোনের ক্ল্যাপার বয়কেই নায়ক বানিয়ে দিলেন। আর নায়িকা চরিত্রে ডাকলেন আতাউল্লার রূপসী কন্যাটিকে। সেই ক্ল্যাপার বয় আসলে পৃথ্বীরাজ কপূরের ছেলে। দু’জন আনকোরা ছেলেমেয়েকে নিতে নারাজ রঞ্জিত মুভিস্টোনের মালিক। কেদার নিজের জমি বেচে নতুন কোম্পানি গড়ে সিনেমা তৈরি করলেন। ছবির নামও পাল্টে দিলেন। ‘নীলকমল’। ভাগ্যতাড়িত রাজকন্যার সঙ্গে এক শিল্পীর প্রেমকাহিনি। শেষে সরোবরে ডুবে রাজকন্যার মৃত্যু হয় আর সেই সরোবর অপরূপ নীল পদ্মে ভরে যায়। নায়িকাচরিত্রে প্রথম সিনেমাই যেন তাঁর নিজের নিয়তির দিঙ্নির্দেশ করেছিল। কেদার বলেছেন, “রাজ কপূরের চেয়েও প্রতিভা বেশি মধুবালার। রোম্যান্স সিন রাজ ওর কাছেই শিখত, আবার ওকেই হিংসা করত। স্টুডিয়োয় ওর নাম ছিল ‘মেশিন’। ভিড় ট্রেনে বাদুড়ঝোলা হয়ে শুটিংয়ে আসত, কোনও দিন লেট হয়নি। মনে হত বাড়ির প্রতি কর্তব্যে ধুঁকছে।” ‘নীলকমল’ তেমন ব্যবসা করেনি, তবে স্ক্রিন-ঈশ্বরী দেবিকা রানি ছবির মধ্যে ঠিকই আসল পদ্মফুলটিকে বেছে নিয়েছিলেন। তিনিই মুমতাজ় নামটি বাতিল করেন। ‘মধুবালা’— দেবিকা রানির অমোঘ সেই নামকরণ এখনও যেন শিল্পীমহল থেকে আমজনতাকে মায়ায় বেঁধে রেখেছে!
বছর দুয়েকেই প্রায় এক ডজন ছবির নায়িকা তিনি। অধিকাংশই ‘নীলকমল’-এর শুটিং চলাকালীন বাবার মর্জিতে সই করেন। তার তিনটিতে নায়ক রাজ কপূর। একটিতে নায়ক কেদার শর্মা স্বয়ং! রাজ-মধুবালা ছাড়াও গীতা বালি ও তনুজাকে ব্রেক দিয়েছিলেন কেদার। এঁরাও তাঁরই হাতে তৈরি। কিন্তু মধুবালা সম্পর্কে তাঁর উচ্ছ্বাস মাত্রাছাড়া। জওহরলাল নেহরুর প্রিয় শায়র কেদার জানিয়েছেন, তাঁর লেখা এক গুচ্ছ ভালবাসার পঙ্ক্তি ‘নীলকমল’-এ ব্যবহার হয়নি। জীবনের শেষ দিনগুলিতে নায়িকা চিঠি লিখে নাকি পরিচালকের থেকে কথাগুলি বরাবরের মতো চেয়ে নেন, যাতে সেগুলি অন্য নায়িকাকে দেওয়া না হয়। এ সবের ভিত্তিতে বাতাস সরগরম হয়েছিল কেদার ও মধুবালার সম্পর্কের জল্পনায়। মধুবালার বোন মধুর ব্রিজ ভূষণ ক্ষোভের সঙ্গে বলেছেন, “কেদার শর্মা মধুআপার চেয়ে ২৩ বছরের বড়। এমন লোক কী ভাবে এক জন টিনএজারে মোহগ্রস্ত হতে পারেন জানা নেই, কিন্তু আপার তরফ থেকে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা বই কোনও অনুভব ছিল না।”
দূর আকাশের সেই তারা
এই মধুবালা-রহস্যের কুয়াশা আরও ঘনীভূত হল প্রথম সুপারহিট ‘মহল’-এ। জন্মান্তরের কাহিনি, একটি মেয়ে কখনও দেখা দেয়, কখনও গায়েব হয়ে যায়। এই ছবি খুঁড়িয়ে চলা বম্বে টকিজ়কে স্বমহিমা ফিরিয়ে দিল, সাসপেন্স-হররের নতুন ধারাও প্রতিষ্ঠা করল। ফিল্মে ‘কামিনী’ চরিত্রে এমন নায়িকা দরকার যাঁর রূপ অপার্থিব, সম্মোহক। মানুষকে ভুলিয়ে বিপদের পথে টেনে নিয়ে যাবে। বম্বে টকিজ়ের কর্ণধারদের মত, সিঙ্গিং স্টার সুরাইয়া এই চরিত্রে আদর্শ। লেখক-পরিচালক কামাল আমরোহি বললেন, “ফিল্ম বনেগি তো মধুবালাকে সাথ...” মধুবালার স্ক্রিনটেস্টটা পর্যন্ত ‘ডিরেক্ট’ করেছিলেন তিনি। মাথায় দোপাট্টা জড়িয়ে আলো-ছায়ার মায়া তৈরি করে নায়িকার ছবি নিলেন। ফলাফল? মধুবালা-ম্যাজিক। ৭,০০০ টাকা পারিশ্রমিকের হিরোইন মধুবালা ৪০,০০০ টাকার ‘অভিজ্ঞ’ সুরাইয়াকে ছবি থেকে ছিটকে দিলেন। ‘মহল’ ব্লকবাস্টার হতেই আতাউল্লা নাকি ‘আরও অসহ্য’ হয়ে ওঠেন। মেয়েকে সাইন করাতে এলে আগে তাঁর শর্তগুলির বেড়া ডিঙোতে হত। সিনেমায় মধুবালার অংশ সকাল সাতটা থেকে ছ’টার মধ্যে শুটিং করাতে হবে। সন্ধের পর, রাতে শুটিং চলবে না। প্রিমিয়ার, ফিল্মি পার্টিতে যাবেন না। শহরের বাইরে আউটডোর লোকেশনে যাবেন না। শুটিংয়ে অন্যদের খাবার দেওয়া যাবে না, বাড়ির খাবার খাবেন। জল আনতে হবে বম্বের একমাত্র পার্সি কুয়ো থেকে।
মধুবালা একটিমাত্র নিজস্ব শর্ত জুড়েছিলেন। তাঁর উপরে চিত্রায়িত গানের শিল্পী হবেন লতা মঙ্গেশকর। ‘মহল’-এ তাঁর খ্যাতির অনেকখানিই যে ‘আয়েগা আনেওয়ালা’ গানেরও প্রাপ্য, বিলক্ষণ বুঝেছিলেন বুদ্ধিমতী। ওই গানের মতোই, লতার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কও অবিচ্ছেদ্য হয়ে গিয়েছিল। শেষশয্যায় হাতে গোনা যে ক’জন মানুষ দেখতে যেতেন বা দেখতে পেতেন তাঁকে, লতা তাঁদের অন্যতম।
শোনা যায়, তেরো বছর বয়সেই মধুবালার হার্টের অসুখ ভেন্ট্রিকুলার সেপ্টাল ডিফেক্ট ধরা পড়েছিল। সাধারণ ভাষায় হার্টে ফুটো। তখন তার চিকিৎসা ছিল না। ডাক্তারেরা খুব সাবধানে থাকতে বলেছিলেন। বোন বলেছেন, তাই আব্বা অত ‘ব্যান’ চালু করেন। দূরে যেতে অনুমতি দিতেন না, কারণ অসুস্থ হলে চিকিৎসা মিলবে না। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, অমানুষিক পরিশ্রমে বাধ্য করলেন কেন? নৃত্যগুরু সিতারা দেবী বলেছিলেন, “বলেছিলাম, তুমি রূপসী, নাচ শিখছ কেন? মধু বলল, কাজে ত্রুটি রাখব না। ও নাচতে গিয়ে পাঁচ মিনিটেই হাঁপিয়ে যেত।”
অসুখের ফিরিস্তিতে লোকের আগ্রহ নেই, তারা কেবল রূপকথার সন্ধানেই মত্ত। সকলে বুঝল, নায়িকা ফিল্মি পার্টিতে আসেন না। লোকে তাঁকে দেখে ঘড়ি মেলায়। সন্ধে ছ’টা বাজলেই প্রাসাদের সুরম্য দরজার পিছনে মিলিয়ে যান। অচিরেই চিরকালের পাষাণ ইন্ডাস্ট্রিতে তাঁর নাম হল সিন্ডারেলা। কেউ ডাকলেন ভারতের গ্রেটা গার্বো। অনেকেই নিশ্চিত, কামাল নায়িকাকে যে ভাবে পর্দায় দেখিয়েছেন, যে ভাবে তাঁর সঙ্গে আচরণ করেন, তা নিখাদ অনুরাগ। আমরোহিরা দাবি তুলেছেন, মধুবালা ৯ লাখ টাকা দিয়ে পরিবারের থেকে কামালকে কিনে নিতে চেয়েছিলেন, যাতে তিনি স্ত্রী-সন্তানদের ছেড়ে দেন। তিন বার বিবাহিত কামালের তৎকালীন স্ত্রীই নাকি রাজি হননি। মধুর ভূষণের প্রশ্ন, “সবে দিদির সাফল্যে ভর করে আমাদের পরিবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল। তখন আমাদের পেট কেটে তিনি ৯ লাখ টাকা দিতে চাইবেন?”
শাম্মি কপূর জানিয়েছেন, “পর্দায় যা দেখেছেন, তার ১০০ গুণ সুন্দরী ছিলেন মধুবালা। তাঁকে দেখলে সবার মাথা ঘুরে যেত, এক মাত্র তাঁর জন্য স্টুডিয়োর বাইরে লোক জমত।” এত কথা ঘুরত, গসিপ ছাপা হত যে, এক বার আতাউল্লা মিডিয়াকেও ব্যান করে দিয়েছিলেন। শুটিংয়ে ঢুকতে না পেরে কিছু ফিল্ম-সাংবাদিক নাকি মধুবালাকে নিয়ে নানা কুৎসা রটান। পরিস্থিতি এত উগ্র আকার নেয়, মধুবালার জন্য বন্দুকধারী রক্ষী নিয়োগ করতে হয়।
শাম্মির কথায়, “আমার একতরফা ভালবাসার বিষয়ে মধুবালা জানতেন। উনি নিজেই আমার সঙ্গে স্নেহময় কথা বলে আবহাওয়া সহজ করেন। মাটির মানুষ ছিলেন। ক’জন নিজেদের ইগো পুষ্ট করতে সেই মিশুক স্বভাবের অন্য ব্যাখ্যা করেছেন, বলতে পারব না। তবে, স্বাস্থ্য ও বাবার কড়া অনুশাসনের কারণে স্বাভাবিক হতে পারতেন না। ভিড়কে ভয় পেতেন, জল দেখলে ঘাবড়ে যেতেন। স্টুডিয়ো আর বাড়ির বাইরের জগৎটাকে চিনতেনই না তো। তাতেই অনেকে তাঁকে দূরগ্রহের মনে করত। তবে, দু’জনের সঙ্গে তাঁর সত্যিই সম্পর্ক হয়। আমাদের আত্মীয় প্রেমনাথ আর অবশ্যই দিলীপ কুমার।”
দু’দশকে ভাঙা শরীরে ৭২টি সিনেমায় অভিনয় করেছেন মধুবালা। সেই অনুপাতে মনে রাখার মতো ছবি সত্যিই কম। ‘মহল’, ‘হাওড়া ব্রিজ’, ‘তরানা’, ‘চলতি কা নাম গাড়ি’, ‘মুঘল-এ-আজ়ম’, ‘মিস্টার অ্যান্ড মিসেস ৫৫’, ‘ঝুমরু’... লিস্টে আর খানকয় ঢুকবে বড়জোর। অথচ, পঞ্চাশের দশকের অনেকখানি জুড়ে তিনিই সবচেয়ে দামি নায়িকা। এ সময়ে বিশ্ববন্দিত পরিচালক ফ্রাঙ্ক কাপরা ভারতে আসেন এবং মধুবালাকে হলিউডে নিয়ে যেতে চান। আতাউল্লা তাঁকে নাকচ করে বলেন, “ও কাঁটাচামচে খেতে পারবে না!” এই পাশতুন পাঠান যে পরিচালক তাঁর হুকুম তামিল করতে পেরেছেন তাঁকেই গুরুত্ব দিয়েছেন আর ভাল ছবি-নির্মাতাদের দূর দূর করে তাড়িয়েছেন। এ সব সত্ত্বেও ‘লাইফ’ পত্রিকা মধুবালার ছবি ছাপতে আমেরিকা থেকে ভারতে ছুটে এসেছিল। নিউ ইয়র্কের ‘থিয়েটার-আর্টস’ পত্রিকা লিখেছিল— পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্টার। কিন্তু তিনি বেভারলি হিলস-এ নয়, বম্বেতে থাকেন। তাঁর মতো ফ্যান ফলোয়িং বিশ্বে কারও নেই।
সবাক সিনেমার প্রথম জমানার নায়িকা দেবিকা রানির ভাবমূর্তি ছিল মন্দিরগাত্রের ভাস্কর্যসম কামরূপিণীর। পরের দশকে সিনেমার মেয়েরা স্বাধীনতা সংগ্রামী হিরোর পার্শ্বচর। কিন্তু স্বাধীনতা আসতে দেখা গেল, মানুষের মন থেকে ইউরোপীয় মেয়েদের প্রতি মুগ্ধতা তাড়ানো যায়নি। এ সময়ের সিনেমায় তাই নায়িকা আধা-ব্রিটিশ, মেমসাহেব ধরনের। মধুবালা এই চরিত্রেই ‘পারফেক্ট ফিট’। ব্যালেনর্তকীর মতো শরীর, দু’আঙুলে স্কার্টের কোনা আলতো ধরে হিল্লোল তুলে যান বিভঙ্গে। তাঁর আঙুলের ফাঁকে সিগারেট দেখে কত হৃদয় পুড়ে গেল, এক ভক্ত তাঁর নাম উচ্চারণ করতে করতে আত্মহননও করল। এদেশি পত্রিকা তাঁকে ডাকত ‘ডার্লিং’, ‘ফ্যাব মিস’। গাঢ় ঠোঁট, মুক্তোঝরা তির্যক হাসি, কেশবিন্যাস দেখে মেরিলিন মনরোর সঙ্গে তুলনা হত। অনেকে বলেন, মধুবালা কে— জানতে চান? সিনেমাগুলোও দেখতে হবে না। ‘হাওড়া ব্রিজ’-এর ‘আইয়ে মেহেরবান’ গানটা দেখুন শুধু। তাঁর লাস্য আর আবেদন স্তম্ভিত করে দেবে।
পেয়ার কিয়া তো...
সেই সপ্তদশী যখন ‘বাদল’-এর নায়ক প্রেমনাথকে গোলাপ ফুল পাঠালেন, তিনি প্রথম থেকেই বিয়ের কথা ভাবছিলেন। তবুও রোম্যান্স ক্ষণস্থায়ী হল কেন? প্রেমনাথের ব্যাখ্যা, “দিলীপ কুমার আমার বন্ধু। ‘তরানা’র সেটে তিনি মধুর কাছাকাছি এলেন। আমার মনে হয়েছিল, গভীরতর সম্পর্কে খুশি থাকবেন দু’জনই। তাই সরে আসি।” গুঞ্জন, কারণটি ধর্মীয়। দিলীপের সঙ্গে ভবিষ্যৎ চিন্তায় সেই বাধা ছিল না। বরং ভাবালু এই অভিনেতা বছর এগারো বড় হলেও মধুর জন্য সব দিক দিয়ে উপযুক্ত ছিলেন। বোনেরা বলছেন, “দু’জন দু’জনায় বুঁদ হয়ে থাকতেন। ইউসুফ ভাইয়া আপার সঙ্গে ইদ কাটাতে চেন্নাই থেকে বম্বে চলে এসেছিলেন।” ‘বহুত দিন হুয়ে’-র সেটে মধুবালা রক্তবমি করলে দিলীপসাব বড় ডাক্তারকে বিমানে উড়িয়ে আনেন। নিজের দায়িত্বে মধুবালাকে প্রথম নিয়ে আসেন ‘ইনসানিয়ত’-এর প্রিমিয়ারে। দিলীপ কুমারের দিদি বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে মধুবালার বাড়ি গেলে, ফিরিয়ে দেন আতাউল্লা। কারণ, দিলীপ বিয়ের পর মধুকে সিনেমা করতে দেবেন না।
দিলীপসাব নিজের প্রযোজনায় তৈরি সিনেমার লাভের টাকা পুরো আতাউল্লাকে দিয়ে মধুবালাকে পেতে চেয়েছিলেন। ‘ঢাকে কি মলমল’-এর সেটে মধুকে বলেন, “আমার বাড়ি চলো, কাজি বসে আছেন।” মধু বাবাকে দুঃখ দিতে চাননি। এর পরই দিলীপসাব ক্ষিপ্ত হয়ে আতাউল্লাকে শাস্তি দেওয়ার সুযোগ খুঁজতে থাকেন। ইতিমধ্যে নির্মাতারা দিলীপ-মধু জুটিকে নিয়ে পরপর ছবি ভেবেই চলেছেন। যেমন, বি আর চোপড়ার ‘নয়া দৌড়’। তার আউটডোর হবে ভোপালে। আতাউল্লা অসুখের দোহাই দিয়ে মেয়েকে ছাড়লেন না। আসলে তাঁর ভয়, নজরের বাইরে গেলেই মধুকে বিয়ে করে বসবেন দিলীপ। চোপড়া মধুকে সরিয়ে সিনেমায় বৈজয়ন্তীমালাকে নিলেন। আতাউল্লা কেস ঠুকলেন, চোপড়া পাল্টা আদালতে গেলেন। সাক্ষীর কাঠগড়ায় তোলা হল দিলীপ-মধুর ভালবাসাকে, দুনিয়ার সংবাদমাধ্যম আদালতে ছুটে এল, সেই ধারাবিবরণী গিলে গিলে খেল আমজনতা। দিলীপ কুমার কেন বি আর চোপড়ার পক্ষে গেলেন— কারণ হিসাবে জনান্তিকে বলেছেন, “ফাঁদে পড়ে গিয়েছিলাম।” তিনি ভরা আদালতে জনসমক্ষে বলে দেন, আমি মধুবালাকে ওর মৃত্যুর দিন পর্যন্ত ভালবাসব। প্রিয়তমের মুখে মৃত্যুকামনা শুনে কান্না চেপে বিস্ফারিত নয়নে তাকিয়েছিলেন নায়িকা।
‘মুঘল-এ-আজ়ম’-এর শুটিং চলেছিল প্রায় এক দশক। কে আসিফ যেন হিরে-জহরতের নেকলেস তৈরি করছেন আর প্রতিটি পাথরের জেল্লাকে সমনিখুঁত করতে দিনরাত এক করে দিচ্ছেন। পৃথ্বীরাজ কপূর বাড়িতেও ‘আকবর’-এর ঢঙে হাঁটছেন-বলছেন। দুর্জন সিংহের মৃত্যুদৃশ্যে অজিত শঙ্কিত। “পরিচালক আমাকে সত্যিই মরতে বলবে না তো?” আর সিনেমায় সেলিম-আনারকলির প্রেম-বিচ্ছেদের সমান্তরালেই চলছে দিলীপ-মধুর সম্পর্কের আলো আর আঁধার। যে দিলীপ প্রথম দিকে তন্ময় হয়ে মধুবালার আনারকলি-রূপ দেখতেন, মুখে পালকস্পর্শের সেই বহুবিখ্যাত দৃশ্যে তাঁর সঙ্গে মধুর বাক্যালাপই নেই! আনারকলি-বেশী মধুকে এমন সজোর চড় কষাচ্ছেন, সবাই তটস্থ। নায়িকা কি সেট ছেড়ে বেরিয়ে যাবেন? কিন্তু মধুবালা সেই আদালতের দিনটির মতোই বিস্ফারিত নেত্রে তাকিয়েই আছেন। তাঁর দোষ, তিনি জ়ুলফিকর আলি ভুট্টোর সঙ্গে দেখা করেছেন!
‘মুঘল-এ-আজ়ম’ আতাউল্লার বাধানিষেধ মানেনি, তাই নিয়ে কেউ ভাবেওনি। মধুবালা কাশছেন, তাঁকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে মূর্তির মেকআপ দেওয়া হচ্ছে। বিশাল সেট, নায়িকা দৌড়তে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন। সিনেমার ৭০ ভাগই তিনি কাটিয়ে দিচ্ছেন গুরুভার লোহার শেকল পরে। ‘পেয়ার কিয়া তো ডরনা কেয়া’ গানটারই শুটিং চলছে ত্রিশ দিন ধরে। টানা এক মাস ভারী পোশাক পরে নেচেই চলেছেন হার্টের রোগী— ‘মত ওহি হো যো দুনিয়া দেখে... পেয়ার কিয়া...” সিনেমার শেষে আনারকলির মৃত্যুদণ্ড মাপ করেছেন দীন-এ-ইলাহি। কিন্তু মধুবালা মরছেন।
সিনেমা মুক্তি পেল ১৯৬০-এর অগস্টে। তখন মধুর সঙ্গে কিশোরকুমারের বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে। ও দিকে পাবলিসিটির জোরে ‘নয়া দৌড়’-ও বিরাট হিট, বি আর চোপড়া কেস তুলে নিয়েছেন। ‘মুঘল-এ-আজ়ম’-এর টিকিটের লাইনে পুলিশ লাঠিচার্জ করছে। আজ়িম-উস-শান শাহেনশার ‘শেখুবাবা’ আসমুদ্রহিমাচলের মসনদে বসছেন। মধুবালা কিশোরের সঙ্গে মধুচন্দ্রিমায় লন্ডন গিয়ে ডাক্তার দেখাচ্ছেন। ডাক্তাররা রেগে গিয়েছেন, “নিজেকে শেষ করে এসেছেন? দাম্পত্য, সন্তানের ধকল নিতে পারবেন না আপনি।”
মৃত্যুর দাম পাঁচ টাকাবারো আনা
কিশোর নাকি টেবল ফ্যানের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে মধুবালার সম্মতি আদায় করেছিলেন। নায়িকা ঘনিষ্ঠ বৃত্তে বলেছিলেন, “আমাকে গান শোনায়, খুব হাসায়।” লন্ডন থেকে ফিরে কিশোর অসুস্থ মধুকে দেখভালের জন্য আতাউল্লার আরবিয়ান ভিলা-য় রেখে যান। অশোককুমার বলেছেন, “কিশোর অত কষ্ট দেখতে পারত না। তাই বেশি করে কাজে মনোনিবেশ করেছিল।” সিদ্ধান্তের ভুল কি মধুবালার সমাপ্তিকে ত্বরান্বিত করল? সহকর্মীরা বলেছেন, মধুবালা হাসতে পারতেন, হাসতে চাইতেন। তাঁর কমিক টাইমিং তারই প্রমাণ। ওই জীবনীশক্তিটুকুর জোরেই তিনি ১৯৬৯ পর্যন্ত বেঁচেছিলেন। নইলে, বহু আগেই তাঁর মারা যাওয়ার কথা। ডাক্তারেরা তাই বলেছিলেন। মধুবালাই বলতেন, আর কিছু দিন। এ রোগের সার্জারি চালু হল বলে।
সত্যিই সত্তর দশকের আদ্যভাগেই এই অসুখের চিকিৎসা আবিষ্কার হয়। সবই ভাগ্যের ফের। তিরিশ বছর বয়সের পর মধুবালাকে নাকি বাইরের কেউ দেখেনি। তাতেই তাঁর রূপ-যৌবন অমর হয়ে গেল। যাঁরা দেখেছে তাঁরা বলেছেন, শরীর কঙ্কালসার হলেও অসুখ তাঁর জ্যোৎস্না কাড়েনি। ভারতভূষণ, রাজ কপূর তাঁকে দেখতে আসতেন। তাঁদের যা বলেছেন, শেষ দিনগুলোয় দিলীপসাব তিক্ততা ভুলে হাসপাতালে এলে তাঁকেও তাই-ই বলেছেন। “ভাল হয়ে গেলে আমার সঙ্গে ছবি করবে? আল্লা... ম্যায় মরনা নেহি চাহতি।”
১৯৬৯-এর ২৩ ফেব্রুয়ারি, ৩৬ বছর বয়সে আসে মৃত্যু। মেয়ের কবরের পাশে রোজ বসে থাকতেন আতাউল্লা। নতুন দেহকে জায়গা দিতে, সেই কবর নাকি সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু মধুবালা আছেন। অশরীরী ‘কামিনী’র মতো আজও প্রখর ভাবে বিরাজ করছেন ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির আকাশে বাতাসে নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে। ভুলের পর ভুলে, অবহেলে তাঁকে হারিয়ে ফেলার দশকের পর দশক পেরিয়েও, তাঁকে আর এক বার ফিরে পেতে কী ভীষণ ব্যগ্রতা! শাম্মি কপূর বলে গিয়েছেন, “দিলীপ কুমার হ্যাজ় আ স্যাড ফেস। মধুবালা আছেন ওখানেই।” প্রদীপশিখায় উপচে পড়া তাঁর রূপ, আনারকলি-সাজ, ভিজে শাড়ির ‘ভিগিভাগিসি’ দেহবল্লরীর অসংখ্য পুনর্নির্মাণ করেও আশ মেটে না বলিউডের। কখনও সমসাময়িক সুচিত্রা সেনের আয়নায় ভেসে উঠেছেন তিনি, কখনও ড্রিমগার্ল হেমা মালিনীর চোখের তারায়, শ্রীদেবীর চাপল্যে, মাধুরীর হাসিতে, এমনকি ক্যাটরিনার তারুণ্যে চাঁদের টুকরো মধুবালা আর তাঁর ছন্দকে এখনও নানা রূপে খুঁজেই চলেছে তামাম ভারত।
যথা, খ্যাপা খুঁজে খুঁজে ফেরে পরশপাথর।
ঋণ: মধুবালার জীবনীগ্রন্থাদি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy