ছবি: কৌশিক সরকার
‘‘এ কী! দেখতে পাচ্ছি তো!’’
‘‘বাঃ রে, তার মানে তোমার সাদা মনে কাদা নেই গো,’’ খিলখিলিয়ে হাসে পুতুল-পুতুল মেয়ে।
• কে রে তুই?
পুঁচকি মতো একটা ভূত। এ যাবৎ দেখা সবচেয়ে মিষ্টি ভূতও বটে।
বাচ্চারা, আর ‘যাদের সাদা মনে কাদা নেই’, তারা শুধু দেখতে পায় তাকে।
‘ভুতু’।
জি বাংলার এই সিরিয়ালের টানে এখন দিনভর বাঙালির হাপিত্যেশ। সৌজন্য সাড়ে তিন ফুটের তারকা। আর্শিয়া মুখোপাধ্যায়। ক্লাস ওয়ান।
সিরিয়ালে সেই মেয়ে অবশ্য বোঝেই না সে ভূত। জানে না সে মারা গিয়েছে। ছোট্ট ‘ভুতু’ তাই ভাবে, সে ঘুমোচ্ছিল। তার মধ্যে তাকে বাড়িতে একা ফেলে রেখে মা-বাবা চলে গিয়েছে কোথাও। বছর ছয়ের খুদে তাই খেলার সঙ্গী খোঁজে। আড়ি-ভাব করে। বাড়িতে ভাড়াটে হয়ে আসা পরিবারগুলোর সঙ্গে মিশতে চেয়ে নানা কাণ্ডকারখানা ঘটিয়ে ফেলে। নিজের মতো করে চেষ্টা করে তাদের উপকার করতে। তা করতে গিয়েই আবিষ্কার করে, তাকে দেখতেই পাচ্ছে না কেউ। আর তার পরে? বাকিটা ম্যাজিক!
• ছোট্ট হাতেই বড় চমক
নিজের থেকে অন্তত তিনগুণ বড় সাইজের শার্ট, টিশার্ট বা স্যান্ডো গেঞ্জি পরে ঘুরঘুর করা সেই কুট্টি ভূতের কাণ্ডকারখানা দেখতে রোজ রাতে টিভির পর্দায় প্রায় আঠা দিয়ে চোখ সেঁটে বসেন অন্তত কোটি খানেক মানুষ। টিআরপি বাড়ে রকেট গতিতে।
শুধু ভুতু নয়, এমন মিনি সাইজ তারকারা আপাতত দাপিয়ে বেড়াচ্ছে টিভির পর্দায়। কারও বয়স ছয়, কারও আট। কারও আবার আরও কম। দেখলেই মনে হয় যেন, গাল টিপে দিই এক্ষুনি। পরিসংখ্যান বলছে, টেলি সিরিয়ালের পোকা বাঙালিবাড়ির পছন্দের তালিকায় এখন ছোট্টরা। জি বাংলার ‘ভুতু’ কিংবা স্টার জলসা-র ‘পটলকুমার গানওয়ালা’—টিআরপি-র দৌড়ে প্রথম। চ্যানেলগুলোর তুরুপের তাস তাই খুদে নায়ক-নায়িকারা।
কিন্তু খুদে-প্রীতির বাড়বাড়ন্তের কারণটা কী?
জবাব মিলল সিরিয়ালে বুঁদ বাঙালির কাছে।
কেউ বলছেন, বাংলা সিরিয়াল মানেই তো এখন ‘ভক্তিরূপেণ সংস্থিতা’। চল্লিশের গৃহবধূ অনিন্দিতার কথায়, ‘‘কোথাও শিব, কোথাও দুর্গা, কোথাও কৃষ্ণ, কোথাও মনসা— টিভি খুললেই তো আজকাল ভক্তি চুঁইয়ে পড়ে! ভাল লাগে নাকি? সেখানে বাচ্চারা সিরিয়ালের কেন্দ্রীয় চরিত্র, এটা কিন্তু মস্ত বড় একটা রিলিফ।’’
হিন্দির সাঁস-বহু সিরিয়ালের ধাঁচে বাংলার চ্যানেলগুলোতেও শাশুড়ি-বৌমার ঝগড়াঝাঁটি, ষড়যন্ত্রের গল্প দেখতে দেখতে বোর হয়ে গিয়েছিলেন অবসরপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার দিলীপ মুখোপাধ্যায়। ‘‘গিন্নি দেখেন, তাই একসঙ্গে বসলে ওই সিরিয়ালগুলো দেখা ছাড়া উপায় কী! এত একঘেয়ে! ‘ভুতু’ সেখানে এক্কেবারে মুক্ত হাওয়ার মতো। আর মেয়েটাও কী মিষ্টি! একদম আমার নাতনিটার মতো!’’ এমন ভাবেই তো মজেছিলেন হিন্দি সিরিয়ালের দর্শকেরাও। বছর কয়েক আগে সামাজিক সমস্যা-সংস্কারের বুনোটে গড়া ‘বালিকা বধূ’র অনেকটা আলো কেড়ে নিয়েছিল ছোট্ট আনন্দী ওরফে অভীকা গৌড়।
বাংলা সিরিয়ালের নামে দৌড়ে পালাত ঝিমলিও। রাত ন’টা বাজলে এখন নিয়ম করে টিভির সামনে বসে। ‘‘পুঁচকিটা কি কিউট। সে নাকি আবার ভূত!’’ হেসে গড়িয়ে পড়েন সাতাশের তন্বী।
• জ্যান্ত পুতুল এবং...
কিউট বলে কিউট!
ইন্টারভিউ দিতে হবে শুনে একমাথা এলোমেলো চুল, হাঁটু-ছাড়ানো টিশার্টের একরত্তি মেয়ে এক দৌড়ে সোফায় গুটিসুটি। প্রথম দু’একটা প্রশ্নে একটু যেন রাখা-ঢাকা।
আড়ষ্টতা অবশ্য অল্প কিছুক্ষণে ভ্যানিশ। তার পরেই এক্কেবারে স্বমূর্তিতে বছর ছয়ের খুদে সেলিব্রিটি। এক মুহূর্ত স্থির নেই। এই পা দোলাচ্ছে, এই মুখে হাত। এই কমলারঙা খেলনা-ব্যাগ আঁকড়ে মনোযোগী, তো পরের সেকেন্ডেই আনমনা হাতে দেওয়ালে আঁকিবুঁকি। মাঝে সোফায় চড়ে খানিক নাচানাচি, আবার পরক্ষণে রীতিমতো পাকা গিন্নির কায়দায় জানিয়ে দেওয়া, ‘‘আমি রুটি বেলতে পারি। রিয়েলি পারি! তুমি কেক বানাতে পারো? খাওয়াবে কিন্তু আমাকে!’’ এবং সবটাই বড্ড স্মার্ট। পেশাদার সেলিব্রিটির মতো। শিনচ্যান-মোটু পাতলু, মোবাইল গেম্সে মজে থাকা ছ’বছর অবশ্য ফিরে এল নিমেষে। প্রোডাকশনের ‘কাকু’ এসে যে-ই বললেন, ‘‘ডাবের জলটা খেয়ে নে কিন্তু। না হলে মা বকবে!’’ সঙ্গে সঙ্গে তিড়িং বিড়িং মেয়ে সটান সোফার হাতলে দণ্ডায়মান। এবং ঠোঁট ফুলিয়ে জানিয়ে দিল, ‘‘খাব না। কিছুতেই খাব না, যাও!’’ এই এত্ত বড় জামাগুলো কার? প্রোডাকশনের দিদির দিকে দেখিয়ে সটান জবাব আসে, ‘‘ওর!’’
‘এই মেয়ে, তুই তো ভূত।
ভূতের রাজা তোকে তিন বর দিলে কী চাইবি?’
ঝটিতি পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘বর কী? শিগগিরি বলো।’’
ওহ্, বর মানে উইশ। গুপী গাইন-বাঘা বাইনের বর পাওয়ার গল্পটা ছোট্ট করে শুনিয়েই দিতে হয় অগত্যা। তা হলে তিনটে উইশ?
‘‘পোট্যাটো চিপ্স চাই। হাই হিল একটা জুতো। আর একটা মেক-আপ বক্স।’’ পরক্ষণেই অবশ্য চকোলেটের বাক্স চিবোতে চিবোতে কারেকশন, ‘‘নাঃ, জুতো না। বরং একটা সুন্দর ক্লিপ দিতে বোলো। বোলো কিন্তু।’’
কিন্তু গুপী-বাঘা যে তালি দিয়ে বেড়াতে যেত? ভাল ভাল খাবার খেত?
‘‘আচ্ছা, তা হলে দার্জিলিং যাব। অনেক ছোটবেলায় গিয়েছিলাম, জানো?’’
এখন বুঝি বড়?
পাশের আরও খুদে সহ-অভিনেতাকে দেখিয়ে এ বার সিরিয়াস মুখ, ‘‘বাঃ রে, বড় না? ওই তো আমার থেকে কত্ত ছোট! দু’-ব-ছ-র! (আঙুল গুনে)’’
• টিআরপি যখন রকেট
মাস কয়েক হল, ঘরে-ঘরে ঢুকে পড়েছে ভুতু। রাস্তায় দেখলে ঘিরে ধরে লোকে, পাড়ায় তো নামই হয়ে গিয়েছে ‘জুনিয়র সুচিত্রা সেন’। হবে না-ই বা কেন? প্রোডাকশনের দিদি তো সগর্বে বলছেন, ‘‘জানেন, আজ অবধি একটা শটও এনজি হয়নি ওইটুকু মেয়ের! এত সিরিয়াসলি কাজ করে। ও অনেক দূর যাবে ঠিক!’’ আর জনপ্রিয়তা? ফেসবুক পেজে লাইকের বন্যা ভুতুর একের পর এক মিষ্টি মিষ্টি ছবি আর ভিডিয়োয়। দর্শকসংখ্যা রোজই আকাশছোঁয়া। ‘‘আমাদের পেজে ভুতু-র একটা ছবি পোস্ট করা মানে কিন্তু অ্যাটলিস্ট পঞ্চাশ হাজার লাইক। টিভিতে আজকাল দর্শকেরা বাচ্চাদের বেশি পছন্দ করছেন, ফেসবুক অন্তত সেটাই প্রমাণ করছে,’’ জানালেন ভেঙ্কটেশের পাবলিক রিলেশন কর্মী।
বলছেন প্রযোজক সংস্থা শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্মসের মহেন্দ্র সোনি নিজেও— ‘‘আর্শিয়া প্রথম এসেছিল ‘পটলকুমার গানওয়ালা’র ছোট্ট একটা চরিত্রে। মেয়েটা এত সুইট আর এত ভাল কাজ করছিল, তখন ওকে দেখেই ‘ভুতু’র প্ল্যান মাথায় আসে আমাদের স্ক্রিপ্ট রাইটার সাহানার। যেমন ভাবা, তেমন কাজ। ব্যস! আইডিয়াটা আমাদের সবার মনে ধরে গেল সঙ্গে সঙ্গে। আর তার রেজাল্ট তো দেখতেই পাচ্ছেন!’’
তা হলে কি সত্যিই টিভির পর্দায় এখন খুদেরাই তুরুপের তাস? ‘‘নিশ্চয়ই। বাচ্চাদের কাণ্ডকারখানা দেখতে সকলেই তো ভালবাসে। ‘মা’, ‘পটলকুমার গানওয়ালা’র পরে ‘ভুতু’। সব ক’টা সুপারহিট। আর আমাদের সংস্থায় বাচ্চাদের নিয়ে কাজ করতে সকলে ভালবাসেন। কাজের সঙ্গে খেলা, খেলার সঙ্গে কাজ— এটাই আমাদের মন্ত্র!’’ বলছেন মহেন্দ্র সোনি।
‘ভুতু’র প্ল্যানটা এল কী করে?
‘‘বিশ্বাস করুন। এর পিছনে কোনও গল্প নেই। ‘পটলকুমার গানওয়ালা’র সেটে আর্শিয়াকে দেখেই মনে হয়েছিল ওকে নিয়ে কিছু একটা করা দরকার। তার পরেই এই আইডিয়াটা মাথায় এল। এবং ফাটিয়ে দিল আর্শিয়া,’’ হাসতে হাসতেই বলেন সাহানা। খুদেরাই যে এখন সিরিয়ালের বেস্ট চয়েস, এটা এখনও মানতে চান না সাহানা। বরং বলছেন, ‘‘ছোটদের নিয়ে আরও অনেক বেশি কাজ হোক আগে!’’
• অতঃপর?
আচ্ছা ভুতু, আমায় ক’টা দুষ্টুমির প্ল্যান দিতে পারিস?
সাড়ে তিন ফুটের কন্যের হাত চলে গেল কপালে। আঙুল ঠুকে ঠুকে মিনিট কয়েকের চিন্তা। আর তার পর? ‘‘এক, গায়ে জল ঢেলে দিও। ওই যে, যেমন লাইট-কাকুকে করলাম সেদিন! তোয়ালেটা লুকিয়ে রেখো কিন্তু।
দুই, সব জরুরি কাগজ ছিঁড়ে দিও।
তিন, কেউ যদি ল্যাপটপে কাজ করে, একটু উঠলেই সব কি-গুলো ভুলভাল টিপে দিও। ব্যস!’’
মোক্ষম!
ভূত বলে কি দুষ্টুমিতে মানা?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy