অভিনেতা, পরিচালক ও লেখক সৌরভ চক্রবর্তী
ঠাস! সপাটে বৌমার গালে চড় শ্বাশুড়ির। চড় খেয়ে বৌমা ঘুরতে ঘুরতে দরজার পর্দায় গিয়ে পড়ল। তার পর ‘কী হইতে কী হইয়া গেল’, পর্দা পেঁচিয়ে গেল বৌমার গলায়। শ্বাসরোধ হয়ে যাচ্ছিল বলে! কিন্তু কাঁচি দিয়ে পর্দা কেটে বাঁচানো হল তাকে। হিন্দি সিরিয়াল ‘শ্বশুরাল সিমর কা’ এমনই একটা দৃশ্য নিয়ে তোলপাড় নেটদুনিয়া। ধারাবাহিকের একটি পর্বের ক্লিপিং ভাইরাল হয়েছে সমাজমাধ্যমে। কয়েক সেকেন্ডের সেই ক্লিপিং দেখে হতবাক নেটাগরিকদের জিজ্ঞাসা, ‘এমনও দৃশ্য ভাবা যায়?’ সেই থেকে মিমের জোয়ার লেগেছে ফেসবুক, টুইটারে।
বাংলা সিরিয়ালের জগতেও এমনই একটি ঘটনা ঘটেছিল বছর চারেক আগে। ‘স্টার জলসা’-য় ‘মেম বউ’ নামের একটি সিরিয়াল নিয়ে জোর চর্চা শুরু হয়েছিল বাংলায়। রক্ষণশীল পরিবারে আগমন ঘটে এক বিদেশিনীর। লাহিড়ী বাড়ির বড় ছেলে কৌস্তুভ নিজে রক্ষণশীল হয়েও ধীরে ধীরে ক্যারল ব্রাউনের প্রেমে পড়ে। তার পর বাধা বিপত্তি ও কুসংস্কারের জাল থেকে সমাজ ও পরিবারকে রক্ষা করা। ছ’মাস চলেছিল সিরিয়ালটি। সমাজমাধ্যমে দাবি ওঠে, ‘মেম বউয়ের এ রকম উচ্চারণ কোথা থেকে আাবিষ্কার করলেন নির্মাতারা!’ এই নিয়ে হাসাহাসি, মিম বানানো—কী না হয়েছে তখন! এমনকী, নেটাগরিকরা সিরিয়ালের নামও বদলে ফেলেছিলেন। ‘মেম বউ’ থেকে ‘মিম বউ’-এ পরিণত হয়েছিল।
সম্প্রতি মেগা সিরিয়ালের বিষয়বস্তু ও শৈল্পিক দক্ষতার দিকে প্রশ্ন উঠলে আনন্দবাজার ডিজিটালের তরফে যোগাযোগ করা হয় অভিনেতা, পরিচালক ও লেখক সৌরভ চক্রবর্তীর সঙ্গে। ‘মেম বউ’ ধারাবাহিকে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করতেন সৌরভ। আর এখন তিনি ‘শব্দজব্দ’, ‘ধানবাদ ব্লুজ’-এর মতো একাধিক প্রশংসিত ছবি বানিয়ে ফেলেছেন। প্রায় ১০ বছর অতীতে ফিরে তাকালেন সৌরভ।
সৌরভের কথায়, ‘‘আমি বেশ মজাই পেতাম ওই সমস্ত মশকরা দেখে, মিম দেখে। কারণ মিম বানানোটা কিন্তু একটা শিল্প। মিম বানানো খুব সহজ নয়। সেগুলো দেখে মনের রসদই জুটত আমার।’’
তবে এখানে একটা 'কিন্তু' আছে। মশকরা কখন মাত্রা ছাড়িয়ে ব্যক্তিগত আক্রমণে পৌঁছে যাচ্ছে অথবা অশালীন ও যৌনতা কেন্দ্রিক খোঁচায় পরিণত হয়ে উঠছে, সেটার বোঝার ক্ষমতা নেই বেশ কিছু মানুষের। আর তাঁদের কারণে সৌরভের মশকরা করার মেজাজটা বদলে যেত রাগে।
মেগা সিরিয়ালের ইতিহাসের দিকে তাকালে এমন কিছু উদাহরণ পাওয়া যাবে, যা খুবই উঁচু মানের। তা সে 'সার্কাস' হোক, 'জন্মভূমি' হোক, 'এক আকাশের নীচে'ই হোক বা 'মির্জা গালিব'। এমনকি 'মালগুডি ডেজ'-এর কথাও মনে করলেন অভিনেতা।
অভিনেতার কথায়, ‘‘এমনকি আমার ‘বধূ কোন আলো লাগল চোখে’ সিরিয়ালটার কথা এখানে উল্লেখযোগ্য। বেশ কিছু বিষয়কে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে সেখানে তুলে ধরা হয়েছিল। যেগুলো ফেলনা নয়। কিন্তু একই সঙ্গে ‘মেম বউ’-এর মতো কাজও করতে হয়েছে।’’ সৌরভ কেবল মাত্র নির্মাতাদের দোষ দিতে চান না। তাঁর মতে, মানুষও তার মানে এ ধরনের বিষয়বস্তুর দিকে ঝুঁকছে। নয়তো, ‘শ্বশুরাল সিমর কা’-র মতো ধারাবাহিকগুলির টিআরপি এ রকম বেশি হয় কী করে! তবে কি বিষয়বস্তুর মান নীচের দিকে নামার কারণ সমাজব্যবস্থার অবনতি? প্রশ্ন রাখলেন সৌরভ। বললেন, ‘‘রেটিংয়ের উপর ভিত্তি করে গল্প লেখা হয়। মানুষ কী চায়, সেটা মাথায় রেখে টেলিভিশন চলে। মানুষ যদি হই হই করে না গিলত, তা হলে বোধ হয় এগুলো তৈরিই হত না। এমন উদাহরণও রয়েছে, খুব ভাল একটা সিরিয়াল চালু হল, কিন্তু কোনও রেটিং দিল না বলে সোজা বন্ধ করে দিতে হল। ‘ফিরকি’-র মতো গুরুত্বপূর্ণ সিরিয়াল তৈরির চেষ্টা তো হয়েছিল এখানে। কিন্তু চলল না।’’ প্রসঙ্গত, ‘অ্যক্রোপলিস এন্টারটেনমেন্ট’-এর ধারাবাহিক ‘ফিরকি’ বন্ধ করে দেওয়া হয় মাস কয়েক আগে। প্রযোজকদের তরফেই তার কারণ জানা যায়। টেলিভিশনে তৃতীয় লিঙ্গদের দেখলেই নাকি চ্যানেল ঘুরিয়ে দিচ্ছিল বাংলার দর্শক। তাই বন্ধ করে দেওয়া হয় সেই ধারাবাহিক।
সৌরভের মতে, আমাদের সমাজে সব কিছুর সঙ্গে সব কিছুর যোগ রয়েছে। কোন সমাজে মানুষ বাস করছে, এ ক্ষেত্রে সেটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। জানালেন, ‘‘এ ধরনের সার্কাস তো কেবল টেলিভিশনের পর্দায় নয়, রাজনীতিতেও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে এখন। আমার ধারণা, আমাদের সমাজ একটা গ্যালারিতে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রের মানুষরা এসে সার্কাস দেখাচ্ছে। প্রত্যেকে প্রত্যেককে ‘জোকার’ বলে খুশি হচ্ছে। আসলে আমরা প্রত্যেকেই জোকার। কিন্তু যখনই দর্শকের ভূমিকায় আসছি, অমনি অপর জনকে ‘জোকার’ বলে অপমান করার চেষ্টা করছি। অর্থাৎ একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে যদি দেখা যায়, এ রকম অবাস্তব, পরাবাস্তব, অতিবাস্তব জিনিসের দিকে মানুষের আগ্রহ রয়েছে, তা হলে সেই দায় ভার সমাজব্যবস্থার উপরেও বর্তায় না কি?’’
কিন্তু ‘মেম বউ’ করার সময়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা কেমন ছিল সৌরভের? অভিনেতা জানালেন, ‘‘সে সময়ে মনকে বোঝাতে হয়েছিল। মাস গেলে টাকা ঢুকছে। যেটার প্রয়োজনীয়তা খুবই বেশি। আর এটা আমার কাজ। এটা আমায় করতে হবে। যে মুহূর্তে নিজেকে বোঝাতে পারছিলাম না, তখন ভাবতাম, পরিচালককে বোঝানোটুকুই আমার কাজ। তিনি যদি আমার কাজে খুশি হন, তা হলেই আমি সফল। কারণ, নিজের কাছে যুক্তি সাজাতে কষ্ট হত তো বটেই। তার পর দর্শকের প্রতিক্রিয়ার জন্য মুখিয়ে থাকতে হত।’’ যদিও সৌরভ মনে করেন, টেলিভিশনে কাজ করতে গেলে এ রকম পর্যায় সকলের জীবনেই আসে। কোনও কোনও সিরিয়ালের গল্প প্রথম দিকে খুব আকর্ষণীয় থাকলেও কয়েক দিন পর থেকে তা অবাস্তবতার দিকে ঝুঁকতে থাকে।
তবে এই মুহূর্তে কিছু সিরিয়াল ফের মানের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে বলে ধারণা সৌরভের। ‘‘আমার মা কয়েকটি সিরিয়াল দেখেন। যতটুকু কানে আসে, আমার মন্দ লাগে না। গল্পে বদল আসছে বলেই আমার ধারণা।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy