স্বাধীনতার ৭৫ বছর। হ্যাঁ সেই স্বাধীনতা, যা এসেছে বহু প্রাণের বিনিময়ে। গ্রাফিক- সনৎ সিংহ
অনেক দিন ধরে বন্ধ একটা ঘর। বদ্ধ পরিসরে স্যাতঁস্যাতে বোটকা গন্ধ ঘরের সঙ্গে চিরস্থায়ী চুক্তি করে ফেলেছে। দিনের বেলাতেও নেশাগ্রস্তের ঘোলাটে চোখের মতো বালব জ্বালাতে হয় কারওর মুখ ঠাহর করতে। এ রকম একটা ঘরের জানলা যদি হঠাৎ কোনও জাদুবলে খুলে যায়, আর সেই জানলা দিয়ে প্রবেশ করে অলীক ঐশ্বর্যের মতো রোদ, তখন কি সেই রোদের বয়স জানতে আছে? ওই রোদ তো স্নানের জলের মতো পরিচ্ছন্ন। ওতে বয়সের মদ মিশিয়ে তার অপমান করার মতো ‘নাপাক’ কাজ কিছু হয়?
কিন্তু আমাদের স্বভাবই বলুন বা ব্যর্থতা, সব কিছুর সঙ্গে সংখ্যা না জুড়লে আমাদের চলে না। বাড়ি, গাড়ি, এমনকি কখনও সখনও ভালবাসাও সংখ্যায় হিসেব হয়। স্বাধীনতার ৭৫ বছর। হ্যাঁ সেই স্বাধীনতা, যা এসেছে বহু প্রাণের বিনিময়ে। শিল্প বিপ্লবের যাবতীয় ঐশ্বর্যে ধনী একটি দেশের কাছে ১৯০ বছর পদানত থাকার পর কলঙ্ক থেকে আমরা মুক্তি পেয়েছি। না, কলঙ্ক থেকে মুক্তি কি আদৌ পেয়েছি? না কি পাওয়া যায়? কিন্তু গত ৭৫ বছর আমরা নিজেদের ইতিহাস অন্তত নিজেরা লেখার সুযোগ পেয়েছি। কিন্তু সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পেরেছি আদৌ? স্বাধীনতা বড় কঠিন জিনিস। সবার পেটে তা সহ্য হয় না। স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুতি লাগে। আমি নিজের জীবন দিয়ে তা টের পাই। উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞান নিলাম কেন? স্বচ্ছন্দে বাবা-মাকে দায়ী করা যায়। ক্রিকেটার হিসেবে যত দূর যাওয়া উচিত ছিল, যেতে পারলাম না কেন? কম্পাস যথারীতি ঘুরিয়ে দিতে পারব বাবা-মায়ের দিকে। কিন্তু যখন স্বাধীন হলাম, নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়ার জায়গায় এলাম, তখন ভুল ছবিতে স্বাক্ষর করলাম কেন? ভুল নেশায় জীবনের অমূল্য সময় নষ্ট করলাম কেন? একটির পর একটি ভুল মানুষকে বিশ্বাস করলাম কেন? হতচ্ছা়ড়া কম্পাসকে যত অন্য দিকে ঘোরাতে যাই, ঠ্যাঁটার মতো বোঁ করে ঘুরে আমার দিকেই তাক করে। আর স্বাধীনতা তার গুটখা খাওয়া দাঁত বার করে আমার ব্যর্থতাগুলির দিকে তাকিয়ে খ্যাক খ্যাক করে হাসে।
ঠিক একই অবস্থা আমাদের দেশেরও নয় কি? বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকান। বাংলাদেশে গিয়ে বললেন, মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। শৈশবে নাকি কুমিরের ছানা নিয়ে এক্কা দোক্কা খেলেছেন। সমগ্র রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে মাস্টার্স করেছেন। অথচ তাঁর কোনও গর্বিত সহপাঠী খুঁজে পাওয়া যায়নি। নয়ের দশকে ইন্টারনেট এবং ডিজিটাল ক্যামেরাও নাকি ব্যবহার করেছেন। এ সবই নাকি সত্যি! তা হলে তো এটাই সত্যি, আমি ‘গ্যাংস অব ওয়াসেপুর’ করতে রাজি হইনি বলে নওয়াজউদ্দিনের ভাগ্য বদলাল! ওঁর ভাবসাব দেখে আমি একটি বিদেশি চুটকি অনুবাদ করার লোভ সামলাতে পারছি না। এক জন ভারতীয় মৃত্যুর পর জন্নতে (স্বর্গে) গিয়েছেন। আজীবন পুণ্য করা সেই মানুষকে এক জন গাইড ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে স্বর্গের সব জায়গা দেখাচ্ছেন। অবশেষে একটি ঘরে নিয়ে এলেন, যেখানে অজস্র ঘড়ি। সদ্য স্বর্গে আসা মানুষটি গাইডের দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতে সে বলল, ‘‘এই ঘরের যাবতীয় ঘড়ি এক এক জন রাষ্ট্রনায়ককে চিহ্নিত করে। তারা এক একটি মিথ্যে বললে ঘড়ির কাঁটা এক মিনিট করে সরে যায়। আমরা বুঝতে পারি, সে তার নিজের জাতিকে আর একটা মিথ্যে বলল।’’ ভারতীয় নাগরিক, যতই তিনি মৃত হন, নিজের দেশের প্রতি মায়া তখনও সম্পূর্ণ ত্যাগ করতে পারেননি। স্বভাবতই তার প্রশ্ন হল, ‘‘আমাদের রাষ্ট্রনায়কের ঘড়ি কোনটা?’’ গাইড তৎক্ষণাৎ উত্তর দিল— ‘‘ও! নরেন্দ্র মোদীর জন্য নির্দিষ্ট ঘড়িটা? ওটা এ ঘরে পাবেন না। ওটা আমরা ফ্যান হিসেবে ব্যবহার করি।’’
জানি আপনাদের হাসি পাচ্ছে। আমারও হাসি পেত আগে। এখন আর পায় না জানেন। যখন আমাদের প্রধানমন্ত্রী ‘পোশাক’ দেখে অপরাধী চিহ্নিত করেন, যখন আখলাকের ফ্রিজে গরুর মাংস আছে, শুধুমাত্র এই সন্দেহে তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়, তখন আমার যাবতীয় হাসি শুকিয়ে যায়। তলানিতে পড়ে থাকে আনন্দ বক্সীর লিরিক্স—
মঝধার মেঁ নইয়া ডোলে
তো মাঝি পার লগায়ে
মাঝি যো নাও ডুবোয়ে
উসে কৌন বচায়ে?
('অমর প্রেম')
আসলে আমি রিফিউজি কলোনির ছেলে। তৃতীয় প্রজন্ম যদিও। তাই ১৫ অগস্ট আমার উদ্যাপনে কোনও ভাটা পড়ত না। সার বেঁধে গান গাওয়া, প্রভাতফেরি, লাড্ডু-কেক, স্যারদের সঙ্গে ছাত্রদের ফুটবল ম্যাচ, তার পর পাড়ায় এসে কাদার মধ্যে সারা দিন ব্যাপী ফুটবল টুর্নামেন্ট, সবই ছিল। সেই টুর্নামেন্টের মাইকে ঘোষণা ছিল চমকপ্রদ— ‘‘আর্জেন্টিনার পিন্টু, তাড়াতাড়ি মাঠে এসো। তোমাদের পরের ম্যাচ ভোলার টিম জার্মানির সঙ্গে।’’ এই এত আনন্দ, এত হর্ষের মধ্যেও মূর্তিমান বিষাদের মতো খচখচ করত একলা বসে বিড়বিড় করতে থাকা আমার পূর্বপুরুষ। আমার ঠাকুর্দা। আসলে ওই দিনেই নিজের ভিটে ফরিদপুর জেলার মাদারিপুর সাবডিভিশনের ফুকুরা গ্রাম থেকে চলে এসেছিলেন বা বলা ভাল আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। জীবনেও আর ফিরে যেতে পারেননি। শব্দ পাননি নিশুতি রাতে ঝুপ করে পুকুরে তাল পড়ার। আমাদের স্বাধীনতা তাই ওঁর কাছে স্বাদ-হীনতা। অথচ ওই লোকটার ট্রাঙ্ক ভর্তি খাদির জিনিস। আমাদের ফ্যাশনদুরস্ত খাদি নয়, সত্যিকারের খাদি। ওই দ্বন্দ্ব, ওই কষ্ট বোঝার বয়স বা ধৈর্য, কোনওটিই তখন ছিল না। আজ বুঝি, যখন ধর্ম ধারণ না করে বিচ্ছেদের অস্ত্র হিসেবে মাথা তুলছে আবার। একটা আশ্চর্য আতঙ্ক আমায় গ্রাস করে, যখন দেখি, রাষ্ট্র তাতে ইন্ধন জোগাতে তৎপর। একটা ভি়ড় আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে, যারা সার বেঁধে ডিটেনশন ক্যাম্পের দিকে এগোচ্ছে। ভিড়কে সচরাচর চিনতে পারা যায় না, কিন্তু একটা মুখ আমি ঠিক চিনে যাই। আমার ঠাকুর্দার। শুধু উপবীতের জায়গায় এ বার মাথায় ফেজ টুপি। দু’টোই সাদা, আর একটা মিল; আমার ঠাকুর্দা এ বারও জানেন না তাঁর অপরাধ কী।
‘এভরি নেশন গেটস দ্য লিডার ইট ডিজার্ভস’
আমরা আমাদের যোগ্যতা, রুচি অনুযায়ী আমাদের রাষ্ট্রনায়ক বেছে নিই। এই কথাটা আমার কাছে উদ্ধৃতি হয়েই থেকে যেত, যদি না আন্দামান সেলুলার জেলে আমার বিশেষ অভিজ্ঞতাটা হত। সেলুলার জেলে মূল কম্পাউন্ড থেকে অদূরেই ফাঁসিঘর। ছোট্ট এক চিলতে একটা ঘর, যেখানে মুছে দেওয়া হয়েছে শত সহস্র প্রাণ। ঘরটি এমন ভাবে বানানো, যাতে শবদেহ সরাতে মুদ্দাফরাসের প্রয়োজন না হয়। মৃত্যুর নিশ্চিত হয়ে গেলে ওই সুগভীর ঘরের নীচে ফেলে দেওয়া হত। সমুদ্রের জল জোয়ারে বেড়ে গেলে সব হিসেব নিকেশ বুঝে চলে যেত। নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত একটি সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ। যা একান্ত ভাবে এই দেশের। ওই ঘর আমাকে স্থবির করে দিয়েছিল, মনে হচ্ছিল, অন্তত কিছু ক্ষণ আমাদের মৌনতা দাবি করতে পারে ঘরটি। কিন্তু নীরব সে দাবি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে আমার সহ-নাগরিকরা ব্যস্ত ছিলেন ফাঁসির দড়িকে ফ্রেমে রেখে ‘গ্রুপফি’ তুলতে। কী লজ্জা লেগেছিল সে দিন, বলে বোঝাতে পারব না। ফেরার পথে আমরা বন্ধুরা কেউ কথা বলিনি। বলতে পারিনি। একটা আশ্চর্য অক্ষম ব্যর্থতাবোধ আমাদের আন্দামানের সমুদ্রের মতো গ্রাস করছিল। যে মৃত্যু আমাদের ভাল থাকার জন্য, ভাল রাখার জন্য, ভবিষ্যৎ যাতে পরাধীনতার হীনমন্যতা নিয়ে না বাঁচে, তার জন্য সেই মৃত্যুকেও আমরা রেয়াত করলাম না? এই যদি আমরা হই, আমাদের নেতা ভিন্ন হবে কেন?
‘সিপাহী বিদ্রোহ’ কবিতায় সুকান্ত বলেছেন, ‘ইতিহাসের পাতায় তোমরা কেবল পড়ো মিথ্যে।’ ইতিহাস সত্যিই বড় গোলমেলে জিনিস। যে যখন শাসন করে, সে তার মর্জি মতো ইতিহাসকে মুচড়ে, বিকৃত করে জনতার কাছে পেশ করে। কিন্তু আজ এই নেটমাধ্যমের যুগে তা মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছে। তাজমহল নাকি তেজমহল; মক্কায় লুকনো আছে শিবলিঙ্গ। তার উপর রাষ্ট্র ঠিক করছে আপনি কোন ইতিহাস পড়বেন, কতটা পড়বেন। কী খাবেন (কয়েক দিন আগেই নেটমাধ্যমে বাঙালিদের নিয়ে রোষ তৈরি হয় তারা দুর্গা পুজোয় আমিষ খায় বলে), কী দেখবেন। মানে আপনার জীবনের, আমার জীবনের জন্য কোনটা উচিত, তার সবটা ঠিক করে দেবে রাষ্ট্র। যদি তারা ঠিকও হয়, এই অধিকার তাদের কে দিল? আমরা দরকার হলে ভুল করব, সেই ভুল থেকে শিখব। যে স্বাধীনতায় ভুল করার অধিকার নেই, তা আবার কিসের স্বাধীনতা?
শুরু করেছিলাম একটা বন্ধ ঘরের গল্প দিয়ে। আবার ওই বদ্ধ ঘরটাতেই ফিরে যাই। বুদ্ধদেব যখন দেহত্যাগ করছেন, তখন এক শিষ্য গিয়ে প্রশ্ন করেন, ‘‘আপনি তো চলে যাচ্ছেন, এ বার আমাদের মনে প্রশ্ন উদয় হলে কার কাছে যাব?’’ বুদ্ধদেব বলেছিলেন, ‘‘আত্মদীপ ভবঃ’’। অর্থাৎ আত্মাকে দীপের মতো জ্বালাও, সেই তোমাকে রাস্তা দেখাবে। আত্মা কী আমার জানা নেই। কিন্তু আমাদের সবার একটা হৃদয় আছে। নরম, তুলতুলে হৃদয়। সেই হৃদয়টাকে আর বন্ধ থাকতে দেবেন না। খুলে দিন তার জানলাটাকে ধাক্কা মেরে। লিঙ্গ, বর্ণ, জাত, ধর্ম নির্বিশেষে ভালবাসার রোদ ঢুকুক তাতে। দেখবেন, পৃথিবীতে আপনার ভাগের অক্সিজেন বেড়ে গিয়েছে। বাঁচার জন্য বাঁচতে পারছেন আপনি। তখন, ঠিক তখনই দেখতে পাবেন আমার আপনার মধ্যে একটা নতুন মানুষ জন্ম নিচ্ছে। যে মানুষটা রাস্তায় কোনও ‘হিট স্ট্রোক’ হয়ে পড়ে থাকা মানুষের থেকে দূরে দাঁড়িয়ে মোবাইলে রেকর্ড করছে না, এগিয়ে যাচ্ছে বাঁচাতে। বাঁচাতে গিয়ে মানুষটাকে ভালবেসে ফেলছে। ভালবাসার কাছে যে নতজানু হয়নি, সে পতাকার উচ্চতা বুঝবে কী করে?
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy