বলিউডের বেশ কিছু ছবিতে বরাবরই সমকামিতাকে খুব অস্বাভাবিক কোনও প্রবৃত্তি বা হাস্যকর কোনও ভঙ্গিতেই দেখানো হয়েছে।
রেনবো কালার। রামধনু রং খুঁজে নিতে হবে মেঘের আনাচেকানাচে। এমনটাই জানিয়ে দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত। কিন্তু বলিউড কি সাবালক হতে পারবে?
সমকামিতা আর অপরাধ নয় এ দেশে। এক মত হয়ে ঐতিহাসিক রায় দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতি। ২০১৩ সালে সুপ্রিম কোর্টের আগের রায়ের বিরুদ্ধে গিয়েছে এই রায়। এই রায়ে উচ্ছ্বাসে মেতেছে বলিউড। রায়ের সমর্থনে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছেন ফরহান আখতার, আলিয়া ভট্ট-সহ আরও অনেকেই। কিন্তু সমকামিতা বৈধতা পেলেও বলিউডের দৃষ্টিভঙ্গিটা কি বদলেছে? কী বলছেন ছবির জগতের মানুষরা?
১৩০ কোটির দেশে বলিউডের প্রভাব যথেষ্ট। বলিউডের বেশ কিছু ছবিতে বরাবরই সমকামিতাকে খুব অস্বাভাবিক কোনও প্রবৃত্তি বা হাস্যকর কোনও ভঙ্গিতেই দেখানো হয়েছে। ঘরে ঘরে এখনও ‘কাল হো না হো’-র ‘সংস্কারী’ কান্তাবাইরাও রয়েছেন, যিনি শাহরুখ-সইফকে দেখলেই আঁতকে উঠতেন।
আরও পড়ুন
শ্রীলেখা-সিধুর ‘দাম্পত্য’... দার্জিলিঙে?
চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ ও অধ্যাপক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বলিউডে যে ভাবে সমকামিতাকে দেখানো হয়েছে, তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অত্যন্ত অসংবেদনশীল। তবে এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হল ওনিরের ‘মাই ব্রাদার নিখিল’ কিংবা দীপা মেটার ‘ফায়ার’। এই ছবিগুলি অত্যন্ত সংবেদনশীল।’’
সমকামিতা বৈধ হলেও ‘হোমোফোবিয়া’ থেকে মুক্ত হতে কিন্তু বেশ খানিকটা সময়ই নিচ্ছে বলিউড। এখনও যে হোমোফোবিয়া থেকে বলিউড মুক্ত হতে পেরেছে তা কিন্তু নয়, এমনটাই বলেন পরিচালক মৈনাক গুহ।
দীপা মেটা পরিচালিত ছবি ‘ফায়ার’।
‘সংঘর্ষ’ কিংবা ‘হনিমুন ট্রাভেলস প্রাইভেট লিমিটেড’-এর মতো ছবিগুলির ক্ষেত্রে সমকামী চরিত্রগুলিকে নেতিবাচক ভাবে দেখানো হয়েছে। কোথাও ভিলেন, আবার পতিতাপল্লিতে মেয়েদের জোর করে ধরে নিয়ে আসা কোনও চরিত্র মানেই যেন তিনি ‘ট্রান্স পার্সন’।
‘দোস্তানা’ কিংবা পার্টনার ছবির ক্ষেত্রেও বলিউডের ট্রিটমেন্টটা খুব একটা সংবেদনশীল নয়, বলছেন চলচ্চিত্র সমালোচকরাও। সুরেশ মেননের চরিত্রটিকে পার্টনার ছবিতে শুধুমাত্র ‘হাসির খোরাক’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ঠিক যে রকম ভাবে ‘দোস্তানা’ ছবিতে বোমান ইরানির চরিত্রটিকে দেখানো হয়েছিল।
এর আগে ‘লাওয়ারিস’ ছবিতে অমিতাভ বচ্চনের ক্রস ড্রেসিং কিংবা ‘আপনা সপনা মানি মানি’ ছবিতে রীতেশ দেশমুখ, ‘বাজি’ ছবিতে আমির খানের ক্রস ড্রেসিং নিয়েও আপত্তি জানিয়েছিলেন কেউ কেউ। অনেকেই বলেছিলেন, এর ফলে এলজিবিটি সম্প্রদায়ের মানুষদের পরোক্ষ ভাবে হলেও অপমান করা হচ্ছে।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবীবিদ্যা বিভাগের গবেষক রাজলক্ষ্মী ঘোষ বলেন, ‘‘বলিউড ছবির ক্ষেত্রে সমকামিতাকে অনেক ক্ষেত্রেই খুব ইনসেনসিটিভ ভাবে দেখানো হয়েছে। ‘দের ইশকিয়া’কে খানিকটা ব্যতিক্রম বলা যেতে পারে। সমকামিতার উল্লেখ না থাকলেও ছবিটিতে মাধুরী-হুমার সম্পর্ক খুব সুন্দর ভাবে দেখানো হয়েছে।’’
ওনির পরিচালিত ‘মাই ব্রাদার নিখিল’।
‘গুলাব গ্যাং’ ছবির পরিচালক সৌমিক সেন আনন্দবাজার ডিজিটালকে বললেন, ‘‘সমকামিতা কখনওই অপরাধ ছিল না। মান্ধাতার আমলের একটা আইন ছিল আগে, সেটার বদল দরকার ছিল। আর সেটাই হয়েছে। সম্প্রতি ‘ভিরে ডি ওয়েডিং’ ছবির ক্ষেত্রেও আমরা দেখেছি করিনার পরিবারের সদস্যের চরিত্রটিকে অত্যন্ত সহনশীল ভাবে দেখানো হয়েছে। মহেশ ভট্টর ছবি সদকেই মহারানির চরিত্রটিকে যে ভাবে দেখানা হয়েছিল তা একেবারেই কাম্য নয়। পরবর্তীতে তিনিই ‘তামান্না’ ছবির ক্ষেত্রে পরেশ রাওয়ালের চরিত্রটিকে অন্য রকম ভাবে দেখিয়েছেন।’’
সৌমিকের মত: ‘‘বলিউড এখন সহানুভূতিশীল হচ্ছে, কারণ যে ধর্ম প্রোডাকশন ‘দোস্তানা’ বানিয়েছিল, তারাই ‘কপূর অ্যান্ড সনস’ তৈরি করেছে। এখানে ফাওয়াদ খানের চরিত্রটিকে অত্যন্ত সহানুভূতির সঙ্গে দেখানো হয়েছে। ওনিরের ‘মাই ব্রাদার নিখিল’ এ ক্ষেত্রে ল্যান্ডমার্ক বলা যেতেই পারে।’’
‘ফ্যাশন’ ছবিতে সমকামিতার অন্য দিক তুলে ধরেছিলেন মধুর ভান্ডারকর। সমাজের সামনে নিজের সমকামিতা লুকিয়ে রাখতে বন্ধুকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিলেন এক ডিজাইনার।
এই প্রসঙ্গে মুম্বইয়ের সমাজকর্মী দেবস্মিতা বলেন, ‘‘স্টিগমাসেন্ট্রিক চরিত্রায়নের বদল ঘটানোর সময় এসেছে। কারণ এক জন সমকামী মানুষকে কতটা লড়াই করতে হয়, তা একমাত্র তাঁরাই বুঝতে পারবেন। ‘গার্লফ্রেন্ড’ ছবিতে লেসবিয়ান সম্পর্ককে একটা আধা-পর্নোগ্রাফিক ছবি হিসেবে ট্রিট করা হয়েছে। কিন্তু সম্পর্ক তো দুটো মানুষের মধ্যে। আর কেউ সেখানে কিছু ঠিক করে দিতে পারে না। তাই সুপ্রিম কোর্টের এই রায় অত্যন্ত জরুরি ছিল।’’
‘‘ইয়ারানা’ ছবির ‘তেরে জ্যায়সা ইয়ার কাঁহা’ গানটির মধ্যে একটা সমকামী দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম স্টাডিজের অধ্যাপক অনিন্দ্য সেনগুপ্তের কথায়: ‘‘ইয়ারানা’ ছবির ‘তেরে জ্যায়সা ইয়ার কাঁহা’ গানটির মধ্যে একটা সমকামী দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, যেটা আমার কাছে অত্যন্ত স্পষ্ট। রয়েছে শোলের জয়-বীরুর সম্পর্কের মধ্যেও। সেই সময়ে মূলধারার ছবির মধ্যে এই আবেগ আর উচ্চারণটা রয়েছে। তবে তা রেখেঢেকেই। আর এই আবেগের ইতিহাসটাও অত্যন্ত জরুরি।’’
বলিউডে যে সমস্ত ছবি সাম্প্রতিককালে প্রশংসা কুড়িয়েছে, ‘মার্গারিটা উইথ আ স্ট্র’ তার অন্যতম। ছবিতে কল্কি কোয়েচলিনের সঙ্গে ছিলেন সাওনী গুপ্ত। দু’জনের অভিনয়ই মন কেড়েছিল দর্শকদের। সমকামী সম্পর্ককে ছবিতে যে ভাবে তুলে ধরা হয়েছে, তার জন্য পরিচালিকা সোনালী বসুকে বার বার ধন্যবাদ দেন সাওনী। তিনি বলেন, ‘‘মার্গারিটা কিন্তু আলাদা করে হোমোসেক্সুয়ালিটিকে দেখানোর জন্য কোনও ছবি নয়। বড় হয়ে ওঠার মুহূর্তে দু’টি মানুষের প্রেমের গল্প। নিজেকে চেনার গল্প।’’
বলিউডের আর পাঁচটা ছবির চেয়ে এটা অত্যন্ত সেন্সিটিভ ভাবে দেখানো হয়েছে। সাওনী বলেন, ‘‘সারা ভারতজুড়ে ছবিটার জন্য অডিশন নেওয়া হয়েছিল। অনেকেই নানা রকম সোশ্যাল ট্যাবুর কারণেই ছবিটি করতে রাজি হননি। পরে আমি এটা জানতে পারি। এঁদের মধ্যে অনেকেই বেশ প্রতিষ্ঠিত।’’ আসলে বলিউড একটা অত্যন্ত শক্তিশালী মাধ্যম। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিকে বদলাতে পারে সিনেমা। মানসিকতা শোধরানোর জন্য এ রকম একটা ছবি অত্যন্ত জরুরি বলেই স্পষ্ট জানান তিনি।
বলিউডে যে সমস্ত ছবি সাম্প্রতিককালে প্রশংসা কুড়িয়েছে, ‘মার্গারিটা উইথ আ স্ট্র’ তার অন্যতম।
পার্চড অভিনেত্রী বলেন, দেশের বাইরে অজস্র জায়গায় ছবিটার প্রদর্শনীতে যেমন বিপুল সাড়া পেয়েছিলেন তাঁরা, তেমনই সাড়া মিলেছিল পুণের রক্ষণশীল পরিবারগুলির তরফেও। তাঁদের মধ্যে অনেক প্রবীণই বলেছিলেন, বিষয়টা নিয়ে তাঁদের ধারণা ছিল না। তাই খারাপ বলেই মনে হত সমকামিতাকে। কিন্তু সমকামিতা যে একেবারেই স্বাভাবিক একটা প্রবৃত্তি তা তাঁরা বুঝতে পারছেন। তাই বলিউড ধীরে ধীরে যেমন সাবালক হচ্ছে, তেমনই সমকাম নিয়েও ধারণাটা পাল্টাচ্ছে।
আরও পড়ুন
ঋতুপর্ণ থাকলে আজ উৎসব হত শহরে, বলছেন কৌশিক
বছর দু’য়েক আগে মুক্তি পেয়েছিল হনসল মেটা পরিচালিত ছবি ‘আলিগড়’। অধ্যাপক শ্রীনিবাস রামচন্দ্র সিরাসের জীবন ও রহস্যমৃত্যু নিয়েই তৈরি হয়েছিল এটি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে সমকামী সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ তুলে ২০১০-এর ফেব্রুয়ারিতে সাসপেন্ড করা হয়েছিল আধুনিক ভারতীয় ভাষা বিভাগের অধ্যাপক সিরাসকে। অভিযোগ, সিরাসের ঘরে জোর করে ঢুকে এক রিকশাচালকের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ মুহূর্ত ভিডিয়ো করা হয়। এই গল্প নিয়ে এগোয় ছবিটি। সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র মিলতে সমস্যা হয়েছিল এ ছবির ক্ষেত্রে, জানান ছবির ক্যামেরা অ্যাসিস্ট্যান্ট রামানন্দ সরকার।
আসলে প্রতিটি মেঘে রামধনু খুঁজে নিতে সময় লাগে। সেই সময়টুকুই খুঁজছে বলিউড। কোনও পুরুষকে ‘মেয়েলি’ তকমা দিয়ে ঠাট্টার মতো মোটা দাগের কোনও দৃশ্য নিশ্চয়ই আর দেখা যাবে না বলিউডের ছবিগুলিতে। বরং সমকামকে সমপ্রেম হিসেবেই ভাবতে শিখবেন ছবির কলাকুশলী ও দর্শকরাও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy